আজ ২৫ মার্চের সেই ভয়াল ‘কালরাত’

0

Innocent-men-killed-by-the-Pakistani-Armyমহান স্বাধীনতার মাস মার্চের ২৫তম দিবস আজ মঙ্গলবার। ১৯৭১ সালের এই দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। তেতাল্লিশ বছর আগে এদিন রাতেই জেনারেল ইয়াহিয়া খানের রক্তপিপাসু সেনাবাহিনী ইতিহাসের অন্যতম বর্বর ও কাপুরুষোচিত গণহত্যার ঘটনা ঘটায়। ভয়াল এই দিনটি তাই আমাদের জাতীয় জীবনে হাতে গোনা কয়েকটির একটি বেদনাঘন দিন। সেই বিভীষিকাময় ঘটনার কারণে ২৫ মার্চের রাতটি ‘কালরাত’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। স্বজন হারানোর বেদনায় সেদিন শোকাতুর হয়ে পড়েছিল গোটা বাঙালি জাতি। প্রতি বছর এ দিনটি এলেই আমাদের হৃদয় কষ্টে ভরে ওঠে, পুরানো ক্ষতচিহ্ন ফের ‘দগদগে ঘা’ হয়ে দেখা দেয়।

টালমাটাল মার্চের এদিন শক্তিশালী মানুষের ঢল নামে মহাননেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সারাদিন প্রায় প্রতিদিন মিছিলের সামনে এসেই তিনি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করেন এবং সবাইকে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য তৈরি হওয়ার আহবান জানান। এদিন তার বাড়িতে সকাল থেকে ৪-৫শ’ সাংবাদিক উপস্থিত হতে থাকেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় দু’শ’ ছিলেন বিদেশী। দুপুর ১২টায় শেখ মুজিব খবর পান, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সদলবলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছেন। তখন আর কারো বুঝতে বাকি রইল না যে, আলোচনা সফল হয়নি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের কার্যক্রম শুরু করবে। সকলের ধারণা ছিল তারা হয়তো শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে সামরিক শাসন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করবে। হয়তোবা রাজনৈতিক দল ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে দেবে। তবে বর্বরোচিত গণহত্যা চালাবে এ দেশের কোনো মানুষ ঘূর্ণাক্ষরেও এ চিন্তা করেনি।

বেলা ১১টায় সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ এবং জেনারেল ওমর রংপুর যান। এ সময় ১৪ ডিভিশন সদর দফতরের জনৈক কর্নেলের হাতে একটি সিল করা প্যাকেট ছিল। রংপুর ২৩ ব্রিগেডের কমান্ডার আব্দুল আলী মালিক তাদের স্বাগত জানান। সেখানে একমাত্র ইপিআর বাঙালি প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন ওয়াজিশকে ছাড়া সকল ইউনিট কমান্ডারদের নিয়ে ব্রিগেডিয়ার মালিক বৈঠক করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে হেলিকপ্টার রংপুর ত্যাগ করে রাজশাহী, যশোর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ক্যান্টনম্যান্ট ঘুরে বিকেলে ঢাকা ফিরে এলো। বাইরে খবর ছড়িয়ে পড়ল পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান ইয়াহিয়ার অন্যতম প্রধান আলোচনাকারী এম আহমদ গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় প্রসিডেন্ট হাউস ত্যাগ করে ইয়াহিয়া খান সরাসরি করাচি চলে গেছেন। রাত পৌনে ৮টায় প্রেসিডেন্টের ঢাকা ত্যাগের কথা প্রথম জানা যায়।

এরই মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু পার্টিগুলোর নেতা ওয়ালী খান বলেন, বেজেঞ্জো এবং মিয়া মমতাজ দওলতানা ঢাকা ত্যাগ করেছেন। বিকেলে প্রেসিডেন্টের আইন বিষয়ক পরামর্শদাতা একে ব্রোহীও করাচিতে ফিরে যান। আগের দিন ২৪ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অগ্রগতি না হওয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নয়া ফর্মুলার প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণা বাস্তবানের উদ্দেশে এবং প্রস্তাবিত বৈঠকে যোগদানের জন্য শেখ মুজিবের পরামর্শদাতারা এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন। তাদের ধারণা ছিল ইয়াহিয়া এবং শেখ মুজিবের আনুষ্ঠানিক আলোচনা ব্যর্থ হয়নি। বিভিন্ন প্রশ্নের বিস্তারিত আলোচনার জন্য যখন উভয়পক্ষে পরামর্শদাতাদের মধ্যে বৈঠক অব্যাহত রয়েছে, তখন নয়া ফর্মুলার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিকেলে ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠক হবে, কেননা মুজিব ও প্রেসিডেন্ট পরামর্শদাতাদের বৈঠকে নতুন আবদার সৃষ্টি হয়েছে।

কিন্তু কুচক্রীরা সব কিছু ম্লান করে দিয়ে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম পৈশাচিক হত্যাকা- ঘটায়। ‘কালরাত’ হিসেবে এটি সমধিক পরিচিত। রাত সাড়ে ৯টায় তারা নির্বিচারে ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে, আরমানিটোলা, পিলখানার বিডিআর ক্যাম্পে হামলা চালায়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, দৈনিক পত্রিকা অফিসে বোমা নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগ করে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। অগ্নিসংযোগে সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে বোমাবর্ষণ ও ব্যাপকভাবে লুটপাট চালানো হয়। গভীর রাতে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে বিমানে করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে একটি মিলিটারি কোর্টে তার বিচারের ষড়যন্ত্র শুরু করা হয়। সেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নির্মম স্মৃতি আজো জাতিকে পীড়া দেয়।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রকাশিত ‘স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী স্মারক’ গ্রন্থে বলা হয়, “২৫শে মার্চ সন্ধ্যার আগে করাচি থেকে প্রেরিত ‘দি টাইমস’ ও ‘দি গার্ডিয়ান’-এর সংবাদদাতাদের খবরে বলা হয়, ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে।” একাত্তরের রণাঙ্গনের বীরসেনানী মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম তার ‘১৯৭১ হাজার সশস্ত্র প্রতিরোধ’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেন, “২৫শে মার্চ সকালে ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দফতর পিলখানায় অবস্থারত ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পিটি করার ছলে পিলখানার চারদিকে প্রদক্ষিণ করলো। শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত ইপিআর সৈন্যদের পিলখানার ভেতরে নিয়ে আসা হলো এবং অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। অবশেষে বাঙালি জাতির জীবনে নেমে এলো পঁচিশে মার্চের বিষাদমাখা অন্ধকার। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি জাতিকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য সর্বযুগের সবচেয়ে মর্মান্তিক গণহত্যায় মেতে উঠলো। কাপুরুষের মতো পাকিস্তানী হায়েনার দল অতর্কিত অঘোষিতভাবে ঘুমন্ত জাতিকে আক্রমণ করলো চরম পাশবিকতায়। টিক্কা খানের আদেশ মোতাবেক গণহত্যার নেশায় উন্মত্ত সৈন্যরা রাত ১১ টা ৪৫ মিনিটে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসে। পুরানো বিমান বন্দরের কাছে পাক সৈন্যরা প্রথম ব্রাশ ফায়ারিং শুরু করে। অবিরাম গুলীবর্ষণের ফলে সংগ্রামরত উত্তাল জনতার মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান স্তব্ধ হয়ে যায়। ঘাতক সৈন্যরা অবিরাম গুলীবর্ষণ করতে করতে শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।”

সদ্য স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত রণাঙ্গনের বীরসৈনিক লে. কর্নেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী তার ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১’ গ্রন্থে এ দিনের নির্মমতার কথা তুলে ধরে বলেন, “২৫ মার্চ সকালে জনাব ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে ৪৫ মিনিটব্যাপী এককভাবে এক গোপন বৈঠক করেন। সারা দেশে জনতার উত্তাল তরঙ্গ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়লে সমারিক জান্তা নির্দ্বিধায় রংপুর, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে গুলী চালিয়ে কমপক্ষে ১২০ জনকে হত্যা করেছে বলে খবর পাওয়া যায়।”

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More