এরশাদকে নিয়ে সরকারের চালাকি

0

ershadস্টাফ রিপোর্টার : সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ সিদ্ধান্তে অটল। জনপ্রত্যাশার বাইরে গিয়ে জীবন গেলেও তিনি পাতানো নির্বাচনে অংশ নেবেন না। কিন্তু তাকে নির্বাচনে নিতে সরকার নানান চালাকির আশ্রয় নিচ্ছে। লোভ দেখিয়ে ভয় দেখিয়ে এবং বিভিন্ন হিসেব নিকেষ দেখিয়ে তাকে নির্বাচনে রাখার চেষ্টা করছে। সুজাতা সিং মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর অতীতে মূল্যায়ন করা না হলেও এবার মূল্যায়ন করা হবেও বলেও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিছুতেই কিছু না হওয়ায় যে ভাবেই হোক এরশাদকে ম্যানেজ করতে জাতীয় পার্টির একাধিক মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দিয়েছে। এক মন্ত্রী আর এক উপদেষ্টা জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে ভয়ঙ্কর মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছেন। ১/১১ পট-পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা মাইন্যাস টু ফর্মূলা দিয়ে দুই নেত্রীকে গ্রেফতারের যে থিউরি ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকারের নীতি নির্ধারকদের দিয়েছিলেন; সেই ফর্মূলা প্রয়োগ করে এরশাদকে গ্রেফতার করে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। গণভবনে ওই দুই নেতা এ পরামর্শ দেয়ার পর থেকে এরশাদ গ্রেফতার হচ্ছেন গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়। যমুনার নুরুল ইসলাম বাবুলকে গ্রেফতারের চেষ্টায় এক উপদেষ্টার ইংগিত ছিল বুঝতে পেরে গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছেন জাতীয় পার্টির নেতারা। সুত্রের দাবি দলের মহাসচিব এরশাদের পক্ষ্যে থাকলেও তিনি কৌশলে দু’দিকে রয়েছেন। খবর নির্ভরযোগ্য সুত্রের। এক নেতা বলেন, শেখ হাসিনা জানেন এরশাদ নির্বাচনে থাকবেন না। তারপরও এরশাদ নির্বাচনে থাকবেন আওয়ামী লীগ নেতারা চালাকি করে মিডিয়ায় এই প্রচারণা চালাচ্ছেন। কারণ তারা ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রচারণা চালিয়ে মানুষের দৃষ্টি এরশাদের দিকে রাখতে চাচ্ছেন। তারপর কি হবে তা গতকালও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন। তিনি বলেন, আগামী ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দৃশ্যপটে অনেক নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। যা সে সময়েই আপনারা দেখতে পাবেন। চমকের জন্য অপেক্ষা করেন।
জাতীয় পার্টির মন্ত্রীরা এরশাদের হাতে পদত্যাগ পত্র তুলে দিলেও পর্দার ভিতরে চলছে অন্যখেলা। এরশাদকে নিয়ে শাসন দলের নেতা এবং দায়িত্বশীলরা নানা তদবির চেষ্টা করছেন। দীর্ঘদিন থেকে বঞ্চিত এবং তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন এমন একজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জাতীয় পার্টিকে আবার নির্বাচন নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। ওই নেতা এরশাদের মতের পরিবর্তন ঘটিয়ে আবার ভোটযুদ্ধে নামানোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। আর তার সঙ্গে রয়েছেন ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু, মুজিবুল হক চুন্নুসহ কয়েকজন বিতর্কিত নেতা। এ নেতারা নানাভাবে এরশাদকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এরশাদকে নমনীয় করা যাচ্ছেনা। জাতীয় পার্টির কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা উপজেলা পর্যায়ের নেতারা এরশাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। জাতীয় পার্টির তৃর্ণমূলের নেতাকর্মীরা ১৮ দলের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে এরই মধ্যে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছেন। কয়েকটি জেলায় জাতীয় পার্টির নেতারা সরাসরি সব দলের অংশ গ্রহণে নির্বাচনের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আর কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে বয়সে তরুণদের অনেকেই এরশাদের প্রেসিডেন্ট পার্ক নামক বাসায় দিনরাত অবস্থান করছেন। জিয়াউদ্দিন বাবলু আর ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে লাঞ্ছিতের ঘটনায় এরশাদ বিক্ষুব্ধ হয়ে নেতাকর্মীদের বকাঝকা করলেও তারা কোনো ভাবেই এরশাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সফল হতে দেবেন না বলে জানিয়েছেন। যার কারণে আওয়ামী লীগ পন্থী হিসেবে পরিচিত কয়েকজন লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে এরশাদের বাসায় যাচ্ছেন না। গতকাল বিকেলে এরশাদ তার বন্ধু অসুস্থ কবি ফজল সাহাবুদ্দিনকে দেখতে হাসপাতালে যান। তার আগে বাসার সামনে অবস্থানরত সাংবাদিকদের তার বক্তব্য কিছুটা উল্টো ভাবে প্রকাশ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। এরশাদ বলেন, আমি সাবেক প্রেসিডেন্ট, সেনাপ্রধান  ছিলাম। কারাগারে থেকে দুইটি জাতীয় নির্বাচনে ৫ টি করে আসনে প্রার্থী হয়ে প্রতিটিতে নির্বাচিত হয়েছি। গত নির্বাচনেও ৩ আসনে প্রার্থী হয়ে সর্বোচ্চ  ভোট এবং প্রতিদ্বন্দ্বির থেকে সর্বোচ্চ ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়েছি। দেশের মানুষ আমাকে এতো ভালবাসে আর আমি কেন সুইসাইডের কথা বলব। সুইসাইডের কথা সত্য নয়। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণার পর ফিরে দেখি র‌্যাব-পুলিশ বাসা ঘিরে রেখেছে। তাই আমি আশঙ্কা করলাম, তারা আমাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যেতে পারে। নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে আবারো প্রত্যয় ব্যক্ত করে সাবেক এই প্রেসিডেন্ট বলেন, দেশের লাখ লাখ নেতাকর্মী আমার সঙ্গে রয়েছে। জনপ্রত্যাশার বাইরে গিয়ে নির্বাচনে যাব না। তিনি জানান, রওশদ এরশাদের মাধ্যমে মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠিয়ে দেবেন।  কবির ফজল সাহাবুদ্দিনকে দেখে হাসপাতাল থেকে রাতে বাসায় ফিরে উপরে উঠার সময় সাংবাদিকরা ঘিরে ধরলে সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ বলেন, আমি নির্বাচনে যাব না এ কথায় এখনো অনড় এবং অটল আছি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মনোনয়ন পত্র দাখিলের সময়-সীমা বাড়ালে এবং সব দল অংশগ্রহণ করলে তিনি নির্বাচনে যাবেন অন্যথায়  জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে না। আমার দলের কয়েকজন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন এবং মনোনয়নপত্র দাখিলে সময়-সীমা বৃদ্ধি করার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সে অনুরোধে সাড়া দেননি। যদি মনোনয়নের সময়-সীমা বাড়ানো হয় আর সবদল (বিএনপিসহ)  নির্বাচনে না আসে তাহলে নির্বাচনে যাবেন কি না; সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে যাব না; একথাতে এখনো অনড় ও অটল আছি। বিএনপি সব দলের বাইরে নয়।
দুপুরে সংকট নিরসনে সরকারের সঙ্গে জাতীয় পার্টির আলোচনা চলছে বলে জানান দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। অনেকদূর এগিয়ে গেছি, আশা করছি একটি স্থায়ী সমাধান হবে। আমরা কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই না। তবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না, যা বিবেকবর্জিত ও দেশের মানুষের স্বার্থ ক্ষুন্ন করে। পদত্যাগ করার পরও সরকারের সঙ্গে আলোচনা কেন এমন প্রশ্নে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেন, সরকার তো সরকারই। সরকারের সঙ্গে আলোচনা হতেই পারে, এতে দোষের কিছু নেই। সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যোগাযোগ হতেই পারে। আমরা সরকারের সঙ্গে দেশ পরিচালনা করেছি, দীর্ঘদিন আমরা সরকার চালিয়েছি। পদত্যাগটা যেন সৌজন্যমূলক হয়। রুহুল আমিন হাওলাদারের এধরণের রহস্যজনক বক্তব্যে দলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হন। সারাদেশ থেকে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা ফোন করে জানতে চান পদত্যাগে বিবেক বর্জিতের কি আছে? এরশাদ নির্বাচনে যাবে না এটাই শেষ কথা। তবে এরশাদকে নির্বাচনে নেয়ার চেষ্টায় দুই নেতার মিশন চলছে। জাতীয় পার্টির একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, মহাজোট সরকারের সময় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু পাওয়ার স্টেশন, ভিওআইপিসহ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা নিয়েছেন। মুজিবুল হক চুন্নু স্পীকারকে ব্যবহার করে অনেক সুবিধা নিয়েছেন। তারা যেভাবেই হোক সরকারের সঙ্গে থেকে যেতে চাচ্ছেন। আর মহাসচিব এরশাদের বাইরে যাবেন না কিন্তু তিনি অন্যকারণে হেনস্তা হতে পারেন সে ভয়েই সরকারকে চটাতে চাচ্ছেন না। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা জানান, মহাসচিব দলীয় নেতাকর্মীরা যাতে তাকে ভুল না বোঝেন সেটা বোঝানোর চেষ্টা করছেন। তবে প্রেসিডিয়াম সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান এবং কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন সদস্য ইনকিলাবকে জানান, মহাসচিব কোনোভাবেই এরশাদের আদেশ নির্দেশের বাইরে যাবেন না। এক নেতা বলেন, পাতানো নির্বাচনে যাওয়ার কারণে স্যারের (এরশাদ) ইমেজের ক্ষতি হয়েছে। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধার করেছেন। এখন তিনি কোনো চাপ এবং কারো কথায় সিদ্ধান্তের বদল করবেন না। তিনি জানান, জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নিতে ঘরে বাইরে ষড়যন্ত্র চলছে। এরশাদ নিজে সে ষড়যন্ত্রেও সঙ্গে প্রতিনিয়ত একাই যুদ্ধ করছেন। এ যুদ্ধে তার সঙ্গে দলের লাখ লাখ নেতাকর্মী রয়েছে। তিনি সফল হবেন। দিনরাত শতাধিক সাংবাদিক তার বাসায়। বের হলেই তার মন্তব্য জানতে চাওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি একই কথা বার বার বলছেন। তারপও তাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে। পুলিশ-র‌্যাব আর সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বিব্রত এরশাদের রাতে দুই শর্তে নির্বাচনে যাওয়ার বক্তব্য প্রসঙ্গে একজন নেতা বলেন, এটা এক অভাবী পুত্রের মাকে বিক্রী করার কাহিনীর মতো। পুত্র ঘোষণা দিলেন, আমি আমার মাকে বিক্রী করবো। এ ঘোষণার পর অসহায় মা কাঁদতে কাঁদকে ছেলেকে বলেন, আমি তোকে জন্ম দিয়ে মানুষ করেছি। তুই আমাকে বিক্রী করে দিবি? মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে ছেলে বললো, মা আমি তোমার এমত দাম চাইবো যাতে কোনো ক্রেতা এদিকে ঘেষতে না পারে। নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে এরশাদের দুই শর্ত অনেকটা সেই মাকে বিক্রী করতে চাওয়া ছেলের গল্পের মতোই। জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে ফিরিয়ে আনতে এরশাদকে নিয়ে সরকার যে চালাকি করছে; উল্টো এরশাদও নিচের অবস্থানে অটল থাকতে ঘরে বাইরের ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় চালাকি করে দুই শর্ত দিয়েছেন।

সূত্রঃ ইনকিলাব

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More