কাদের মোল্লার শুনানিতে ২পক্ষের যুক্তিতর্ক

0

image_66766_0ঢাকা: জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন গ্রহণযোগ্য কিনা সে বিষয়ে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে সংবিধান এবং আইন নিয়ে দীর্ঘ যুক্তিতর্ক হয়েছে।

বুধবার সকালে যুক্তিতর্ক শেষে আবেদনের শুনানি অব্যাহত রেখে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বিভাগের বেঞ্চ।

ফলে এ আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি কার্যকরের ওপর চেম্বার আদালতের দেওয়া স্থগিতাদেশ বহাল থাকছে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।

বুধবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে ফাঁসির রায় কার্যকর করার স্থগিতাদেশ বিষয়ে এবং বেলা সাড়ে ১১টা থেকে রিভিউ আবেদনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নে শুনানি শুরু হয়।

রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানিতে অংশ নেন।

শুনানি শুরু হলে আপিল বেঞ্চ প্রথমে ফাঁসির রায় কার্যকর করার আদেশ স্থগিতের বিষয়ে শুনানি গ্রহণ করেন। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের নেতৃত্বে রাষ্ট্রপক্ষ ওই স্থগিতাদেশ বাতিলের আবেদন জানালেও পরবর্তীতে শুধুমাত্র কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি হয়েছে।

শুনানিতে মাহবুবে আলম বলেন, ‘সংবিধানের ৪৭(ক)(২) অনুচ্ছেদে মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজা প্রাপ্ত ব্যক্তির রিভিউ আবেদন করার অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে।’

এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীনে কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবে না।’

এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাদের মোল্লার রিভিউ করার অধিকার নেই। কারণ ১৯৭৩ সালে ট্রাইব্যুনালস আইনের বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে দেওয়া কোনো আদেশ বা সাজা দেশের কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এই আইনটি জাতীয় সংসদ প্রণয়ন করেছে। সুতরাং সংসদে প্রনীত এ আইন অনুযায়ী রিভিউ চলবে না। কোনো প্রতিকারও চাইতে পারবে না।

জবাবে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘রিভিউ কোনো প্রতিকার নয়। এটা সাংবিধানিক ও সুপ্রিম কোর্টের রুলস অনুযায়ী নিজস্ব অর্ন্তনিহিত ক্ষমতা। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদের যে কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে এবং আপীল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যে কোন বিধি-সাপেক্ষে আপিল বিভাগের কোন ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে।’

এখানে সুনির্দিষ্টভাবে আপিল বিভাগের ক্ষমতা বুঝানো হয়েছে। প্রতিকারের কথা বলা হয়নি। এখানে ক্ষমতা হচ্ছে অন্তর্নিহিত বলেও জানান ব্যারিস্টার রাজ্জাক।

এ সময় বিচারপতি এসকে সিনহা বলেন, ‘আদালতের এ ক্ষমতা হচ্ছে শর্তযুক্ত। শর্ত হচ্ছে আইনে (ট্রাইব্যুনাল) বেধে দেওয়া শর্ত।’

একইসঙ্গে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘এ অন্তর্নিহিত ক্ষমতা সংবিধানের ঊর্ধ্বে নয়।’

জবাবে রাজ্জাক বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউ করা যাবে না সেটা কোথাও বলা নেই। এছাড়া সংবিধানের ৪৭ (৩) অনুচ্ছেদে মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩১, ৩৫ ও ৪৪ অনুচ্ছেদের প্রযোজ্য নয় বলে উল্লেখ রয়েছে। এ তিনটি অনুচ্ছেদকে সুনিদিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এখানে ১০৫ অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং ১০৫ বলবৎ থাকবে।’

তিনি সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলেন, ‘কোন ব্যক্তির হাজিরা কিংবা কোন দলিলপত্র উদ্ঘাটন বা দাখিল করিবার আদেশসহ আপিল বিভাগের নিকট বিচারাধীন যে কোন মামলা বা বিষয়ে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের জন্য যেরূপ প্রয়োজনীয় হইতে পারে, উক্ত বিভাগ সেইরূপ নির্দেশ, আদেশ, ডিক্রি বা রিট জারি করিতে পারিবেন।’

এখানে সম্পূর্ণ ন্যায় বিচার বলতে আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতার প্রয়োগকে বুঝানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের বিধির কথা উল্লেখ করেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। যেখানে রিভিউ করার বিধান রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এই রায় ট্রাইব্যুনাল দেয়নি। সুতরাং ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়ে রিভিউ নয়। আপিল বিভাগের রায় নিয়ে রিভিউ হয়েছে। সুতরাং এখানে রিভিউয়ে কোনো বাধা নেই।’

তিনি এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ৫৬ ডিএলআরের(ঢাকা ল’ রিপোর্টস) রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আপিল বিভাগ যতুটুক সাজা দিবে ততটুকু কার্যকর হবে । সে ক্ষেত্রে নিন্ম আদালতের বা ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাজা থাকবে না। সুতরাং মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আপিল বিভাগ। সুতরাং আপিল বিভাগের রায় নিয়ে রিভিউ হবে।’

এর আগে সকালে এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের নেতৃত্বে রাষ্ট্রপক্ষ ওই স্থগিতাদেশ বাতিলের আবেদন জানিয়ে শুনানি করেন।

অন্যদিকে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আসামিপক্ষ স্থগিতাদেশের সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন জানান।

কাদের মোল্লার অন্য আইনজীবী খন্দকার মাহাবুব হোসেন জানান, ‘তারা মঙ্গলবার রাতে চেম্বার বিচারপতির কাছে একটি রিভিউ আবেদন জমা দিয়েছেন।’

শুনানিতে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের মামলা। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগে এই মামলায় রায় হয়। ৮ ডিসেম্বর রায় হাতে পাওয়ার পর আমরা রিভিউ আবেদনের প্রস্তুতি শুরু করি।’

তিনি বলেন, ‘রিভিউ করার জন্য অন্য মামলায় যে সুযোগ রয়েছে, সেই একই সুযোগ এই মামলায়ও পাবো বলে আশা করছি। এটা ৪০ বছরের পুরনো ঘটনার মামলা। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার চাই।’

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ঠিক আছে আপনি রিভিউ এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বলেন।’

ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা দুই দিন সময় চাই, আমাদের প্রস্তুতি শেষ হয় নি। আপনারা যে আদেশ দেবেন, আমরা মেনে নেবো। আমাদের ২ দিন সময় প্রয়োজন।’

অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘এই মামলায় রিভিউ চলে না। এটা স্পষ্ট। এই আবেদন বিচার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগের শেষ কার্যদিবস। এরপর সাপ্তাহিক ছুটি শেষে শুরু হবে শীতের অবকাশকালীন ছুটি। এ সময় আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি বসলেও নিয়মিত কোনো আদালত বসেন না। আসামিপক্ষকে দুইদিন সময় দেওয়া হলে রায় বাস্তবায়ন কার্যত আগামী বছর পর্যন্ত ঝুলে যাবে।’

এ সময় প্রধান বিচারপতি ব্যারিস্টার রাজ্জাককে বলেন, ‘গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বলেন, মেরিট আমরা পরে শুনবো। এটাতো খুবই সংক্ষিপ্ত বিষয়। আপনি একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, আপনি সেটা পারবেন। উই আর নট ইন হারি, কিন্তু শুরু করতে দোষ কী?’

জবাবে রাজ্জাক বলেন, ‘আমি পারবো না। এটা পারবেন অ্যাটর্নি জেনারেল। উনি আমার চেয়েও সিনিয়র।’

তখন প্রধান বিচারপতি জানতে চান, ‘এই রিভিউ আবেদনের সিনিয়র অ্যাডভোকেট কে?’

পাতা উল্টে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের নাম দেখার পর আদালত বলেন, ‘আপনিই তো এখানে সিনিয়র অ্যাডভোকেট। আপনি এটার দায়িত্ব স্বীকার করেছেন। আপনি পারবেন, বলেন। উভয়পক্ষই পারবেন। আমরা মেনটেইনেবিলিটি দিয়ে শুরু করি। লেটস স্টার্ট।’

আদালত আবারও রিভিউ বিষয়ক শুনানি করার অনুরোধ জানালে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সময়ের আবেদন জানান। পরে বেলা সাড়ে ১১টায় শুনানির সময় নির্ধারণ করে দেন আদালত। তবে আদালত পরবর্তী সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত চেম্বার বিচারপতির রায় স্থগিতাদেশই বহাল থাকবে বলে জানান।

সাড়ে এগারোটার পর শুনানি দুপুর একটা পর্যন্ত চলে। এরপর আদালত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More