কেরানীগঞ্জে ‘তৈরি’ হচ্ছে আই ফোন

0

i phoneশুধু নাম লিখতে পারে সুমন। কিন্তু তাতে কী? হাতের নিমিষেই তৈরি করছে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলফোন। রাজধানী লাগোয়া কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় সুমনরাই তৈরি করছে চীনের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলফোন সেট। গায়ে লাগানো থাকছে সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডের নাম ও স্টিকার।

মোবাইলফোন তৈরির কারিগর মো. সুমন। জিঞ্জিরার বাসস্ট্যান্ড মোবাইলফোন মার্কেটের মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কারিগর। মোবাইলফোনের নামীদামি ব্র্যান্ডের খুচরা যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় রাজধানীর গুলিস্তান পাতাল মার্কেট ও হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজায়। খরিদ করা এই যন্ত্রাংশ দিয়ে এখানে নিমিষেই তৈরি হচ্ছে অবিকল অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল। তারপর এসব মোবাইলফোন চলে যাচ্ছে রাজধানীর কিছু মার্কেটে। বিক্রি হচ্ছে চীনের ফোন হিসেবে।

সুমন জানায়, ৭ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িত। যে কোন মোবাইলফোনের সার্ভিসিং করা তার কাছে কোন ব্যাপার নয়। এমনকি নতুন যন্ত্রাংশ দিয়ে যে কোন কোম্পানির অবিকল মোবাইলফোন তৈরি করাও তার নিত্যনৈমিত্যিক কাজ।

প্রথমে এই পেশায় যখন পা রাখে, তখন বিনা বেতনে কাজ করতো। ৭ বছরের ব্যবধানে এখন নামীদামি কারিগর। স্থানীয় ভাষায় এসব কারিগরদের বলা হয় ইঞ্জিনিয়ার। নিমিষেই তৈরি করে ফেলে যে কোন ধরনের মোবাইলফোন সেট। এসব কারিগরের তৈরি করা মোবাইল দেখে চেনার কোন উপায় নেই যে এটা আসল নাকি জিঞ্জিরার তৈরি।

সুমন বলেন, আমাদের দোকান মালিক গুলিস্তানের ফোন মার্কেট থেকে মোবাইলের ক্যাসিং, ব্যাটারি, চার্জারসহ নানা পার্টস কিনে আনে। এছাড়া, বাজার থেকে অর্ডার দিয়ে তৈরি করে প্যাকেজিং প্যাকেট ও ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি কার্ড। তারপর বাসায় বসে কারিগর রেখে ফিটিং করা হয়।

এছাড়া, যে টুকটাক মালামাল লাগে তা নিজেরাই বানিয়ে ফেলার মতো কারিগরও আমাদের আছে। তিনি আরও জানান, এগুলো সরাসরি বানানো যায় না। কারণ বিভিন্ন সময় বাজারের দোকানগুলোতে অভিযান চলে। আপনি নিতে চাইলে কমপক্ষে ২০০ সেটের অর্ডার দিতে হবে। এর বাইরে কেউ কাজ ধরবে না। তিনি বলেন এই মোবাইলগুলো বানাতে সাধারণত মার্কেটের দামের চেয়ে অর্ধেক খরচ হয়। আর নামীদামি ব্র্যান্ড হলে ব্যবসায়ীরা অনেক লাভ করতে পারে। তবে এটায় অনেক ঝুঁকি থাকে।

জিঞ্জিরার কাঠুরিয়া এলাকার গুলশান হলের পাশে আরেকটি মোবাইলফোন মার্কেট। গত সোমবার এই মার্কেটের নিচে খাবার হোটেলে বসে কথা হয় হোটেলের এক কর্মচারী জসীম উদ্দিনের সঙ্গে। মোবাইল তৈরির বিষয়ে কথা ওঠাতেই জানতে চায় আমি কোন ডিলার কিনা? কৌশলে তার কাছে নতুন দোকানদার বলে পরিচয় দিয়ে জানতে চাই বিস্তারিত।

তখন জসীম উদ্দিন জানান, এই মার্কেটেও মোবাইল ফোন তৈরি হয়। তবে এখানের চেয়ে বেশি তৈরি হয় মূল জিঞ্জিরাতে। বাসস্ট্যান্ড এলাকা হল মূল জিঞ্জিরা।

জসীম জানায়, এই মার্কেটসহ জিঞ্জিরার কয়েকটি মার্কেটে এমন কারিগর আছে, যারা ঢাকা থেকে খুচরা যন্ত্রাংশ কিনে এনে এখানে ফিটিং করে। তবে সরাসরি মোবাইল তৈরি করে না। কারণ মোবাইলের খুচরা যন্ত্রাংশ তো আর বাংলাদেশে তৈরি হয় না।

গত সপ্তাহের শুক্রবার জিঞ্জিরার কাঠুরিয়া এলাকার এক চায়ের দোকানদার মো. নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে জানান, এখানকার কারিগররা যে নকল মোবাইলফোন তৈরি করতে পারে বা করে, সেটা কখনও স্বীকার করবে না। আপনাকে কারো মাধ্যমে যেতে হবে। একই সঙ্গে তিনি জানান, দুই একটা সেটের জন্য তারা কাজ ধরেন না। অনেকগুলো সেটের অর্ডার দিলে তারা কাজ করে দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জিঞ্জিরার আগানগর, বাঁশপট্টি, কাঠপট্টি, থানাঘাট, ফেরিঘাট, বাসস্ট্যান্ড মার্কেট ও গুলশান সিনেমা হলের সামনে হাবীব কমপ্লেক্সসহ এই এলাকার কিছু বাসাবাড়িতে তৈরি হয় এসব পণ্য। স্যামসাং, লিনোভো, এইচটিসি, লাভা, মাইক্রোম্যাক্স, পাইলট, সিনিজু, রিগ্যাল, আই ফোন, ম্যাক্সিমাস ও জেটিইসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলের নকল কারখানা এখানে। পরে গোপনে এই পণ্যগুলো ছড়িয়ে দেয়া হয় মার্কেটে।

ঢাকার পাইকারি মোবাইল মার্কেট বলে পরিচিত গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট ও হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, একাধিক দোকানে মোবাইলের ক্যাসিং, ব্যাটারি, চার্জারসহ নানা খুচরা যন্ত্রাংশ বিক্রি হচ্ছে। এত পরিমাণ খুচরা যন্ত্রাংশ কারা কেনে জানতে চাইলে গুলিস্তান পাতাল মার্কেটের বিক্রেতা বলেন, এটা সার্ভিসিংয়ের মেকাররা কিনে নিয়ে যায়। মানুষের মোবাইল সেটের এসব যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে এগুলো দিয়ে সেটার সার্ভিসিং করে। এছাড়া, ঢাকার বাইরের কিছু ব্যবসায়ী আমাদের কাছে এই মালামালের অর্ডার দেয়। এখান থেকে কিনে নিয়ে তারা কি করে সেটা আমরা জানি না। আমাদের কাজ শুধু চায়নার এই সামগ্রীগুলো এনে দেয়া। সেটা আমরা করি।

শুধু মোবাইলফোন নয়, জিঞ্জিরার আগানগর, বাঁশপট্টি, থানাঘাট, ফেরিঘাট এলাকার বাসাবাড়িতে গোপনে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট কারখানা, যেখানে তৈরি হচ্ছে ফ্লাক্স, ওয়াটার হিটার, শ্যাম্পু, সাবান, আফটার শেভ লোশন, ত্বকে ব্যবহারের ক্রিমসহ বিদেশী জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের নকল পণ্য। চায়না ফ্লাক্স তৈরিতে শুধু রিফিল (ফ্লাক্সের ভেতরের কাচের অংশ) বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। বাকিগুলো জিঞ্জিরাতেই বানানো হয়। ফ্লাক্সের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বানানোর মতো মেশিন এই পল্লীর অনেকেরই রয়েছে। এখানে কারিগররা সেগুলো তৈরি করে ফিটিং করে। পরে বাজারে ছেড়ে দেয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে একটা ফ্লাক্সের বডি বানাতে ১০ থেকে ১২ টাকা খরচ পড়ে। আর রিফিল বাইরে থেকে আনতে খরচ ৭০ থেকে ৮০ টাকা। সবমিলে একটা ফ্লাক্স ১০০ টাকার ভেতরে প্রস্তুত করা যায়। যা বাজারে কমপক্ষে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। এছাড়া সিলভারের কাঁচামাল কিনে এনে এখানে তৈরি হয় পাতিল, কড়াই ও বিভিন্ন ধরনের কিচেন সামগ্রী।

জানা যায়, রাজধানীঘেঁষা কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা এলাকায় ছোট-বড় দুই হাজার কারখানা রয়েছে। দেশজুড়ে একই আদলের শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে ৪০ হাজারেরও বেশি। সূত্র: মানবজমিন

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More