জনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করছি : আইজিপি, তফসিলের পর থেকে নিহত ১১৫ দেশব্যাপী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা

0

Rangpur-Hartal copyদেশব্যাপী ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কখন কী ঘটে যায় সেই আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে মানুষ। দিন যত যাচ্ছে মানুষ ততই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। এমনিতেই গত ২৫ নভেম্বর দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে নিহত হয়েছেন অন্তত ১১৫ জন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকেই এখনো হাসপাতালে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। সূত্র জানায়, যতই দিন যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ততই নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। যৌথবাহিনীর অভিযানে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে পড়ছে বলে জানা যায়। অপর দিকে বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে আসছে একের পর এক অবরোধ কর্মসূচি। সর্বশেষ গতকাল টানা চতুর্থ দফার অবরোধ শেষে আবারো আগামীকাল শনিবার সকাল থেকে ঘোষণা করা হয়েছে টানা ৮৩ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি। এ দিকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়ে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছেন, জনজীবনে অনেক স্বস্তি ফিরে এসেছে। সামনে পরিস্থিতি আরো ভালো হবে। তিনি বলেন, জনস্বার্থ সমুন্নত রেখে আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব আইনানুগভাবে পালন করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করছে।
গত ২৫ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে দেশব্যাপী বিরোধী দলের ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। ২৬ নভেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুটি এবং বিশেষ দিবস ছাড়া প্রায় সব দিনই অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। সূত্র জানায়, টানা অবরোধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পুরো দেশ। অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা ও যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে নিরাপত্তাব্যবস্থা। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এক দিকে জ্বালাও-পোড়াও, অপর দিকে গুলি-টিয়ার শেল। সাধারণ মানুষ এসব কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। ইতোমধ্যে যারা হতাহত হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই হয়তো গুলিতে, না হয় অগ্নিদগ্ধ হয়ে। আন্দোলন স্তব্ধ করতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বেপরোয়া গুলি চালাচ্ছে। এতে সাধারণ পথচারীও প্রাণ হারাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত কয়েক দিন ধরে দেশের ১৭টি জেলায় শুরু হয়েছে যৌথবাহিনীর অভিযান। গত রাত থেকে ঢাকায়ও এই অভিযান শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। যৌথবাহিনীর এই অভিযানে সারা দেশে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ্মীপুর ও সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই নানা অভিযোগ উঠেছে।
গ্রেফতার অভিযান চালাতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে সংঘর্ষে এসব নিহতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু নিহতদের পারিবারিক এবং ১৮ দলীয় জোট সূত্র জানায়, তাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে লক্ষ্মীপুর জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ডাক্তার ফয়েজ আহমদকে গত শুক্রবার রাতে নিজ বাসা থেকে ধরে বাড়ির ছাদে নিয়ে হাত-পা বেঁধে গুলি করে হত্যার পর লাশ ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেয়া হয়। গত ১৪ ডিসেম্বর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আটজন। ১৫ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন স্থানে র‌্যাব-পুলিশ ও বিজিবির গুলিতে নিহত হয়েছেন আটজন। ১৬ ডিসেম্বর সাতক্ষীরায় যৌথবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন জামায়াতের দুই কর্মী। গত রোববার রাতে লক্ষ্মীপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে নিহত হয়েছেন সদর উপজেলা দিঘলী ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবুল (৩৫) এবং বিএনপি কর্মী খোরশেদ আলম (৩২)।. অভিযোগ পাওয়া গেছে, যৌথবাহিনীর সদস্যরা তাদের আটকের পর গুলি করে হত্যা করেছে। লক্ষ্মীপুর সদর থানার ওসি মো: ইকবাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, র‌্যাবের সাথে গোলাগুলির একপর্যায়ে বাবুল ও খোরশেদ নিহত হয়েছেন। গত মঙ্গলবার সকালে লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার বটতলী এলাকা থেকে আব্দুল মান্নান ও জহিরুল ইসলাম নামে দুই বিএনপি কর্মীর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সূত্র জানায়, গত রোববার রাতে ওই এলাকায় যৌথবাহিনীর অভিযানের পর থেকেই তারা নিখোঁজ ছিলেন। ১৮ দলের একাধিক নেতা বলেছেন, টার্গেট করেই এই খুন করা হয়েছে।
এ দিকে যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় অভিযানের নামে ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত মঙ্গলবার সাতক্ষীরার আদরদাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আনারুলের বাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সময় সাংবাদিকেরা ছবি তুলতে চাইলে যৌথবাহিনীর সদস্যরা সাংবাদিকদের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া যায়। গত সোমবার রাতেও শ্যামনগরে অভিযানের সময় উপজেলার খানপুর বাজারে আব্দুর রশিদের চায়ের দোকান ভাঙচুর করা হয়। একই সময় খানপুর জামে মসজিদে প্রবেশ করে মাইক ও ব্যাটারি ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে। সোমবার রাতে সাতক্ষীরার তালা উপজেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক গাজী সুজায়েত আলী, সহকারী সেক্রেটারি অধ্যাপক ইদ্রিস আলী, কর্মপরিষদ সদস্য রেজাউল করিম, অ্যাডভোকেট বাসারাতুল্লাহ আরোঙ্গী বাবলাসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার বাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া যায়।
হতাহত ও গ্রেফতারের পাশাপাশি গুমাতঙ্কও ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। গত ২৮ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি খালেদ হাসান সোহেল, ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি আনিসুর রহমান ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো: বিপ্লব এবং ৮০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মিঠুকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। গত ২ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার সূত্রাপুর ও বংশাল থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ ছাত্রদল কোতোয়ালি থানার সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রায়হান সেন্টু, বংশাল থানার সহসভাপতি সোহেল, ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি মো: জহির ও সাধারণ সম্পাদক মো: পারভেজ, ৭২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সহসভাপতি ও কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের সদস্য সাব্বির, বংশাল থানা ছাত্রদলের সদস্য মো: চঞ্চল, ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সদস্য মো: কালু, ৭০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সদস্য ও কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাফরান হোসেন উজ্জ্বল এবং ৭১ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি ও বংশাল থানা ছাত্রদলের সদস্য মো: সোহেলকে ধরে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে ৭০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সদস্য ও কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাফরান হোসেন উজ্জ্বল এবং ৭১ নম্বর ওয়ার্ডের সহসভাপতি ও বংশাল থানা ছাত্রদলের সদস্য মো: সোহেলকে শাহবাগে গাড়িতে আগুনের মামলায় শাহবাগ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকিদের খোঁজ নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
গত ৪ ডিসেম্বর গুলশানে আমেরিকান দূতাবাসের সামনে থেকে র‌্যাব পরিচয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রদল কর্মী আসাদুজ্জামান রানা, মাযহারুল ইসলাম রাসেল ও আল আমিনকে আটক করা হয়।
গত ২৭ নভেম্বর রাতে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি লাকসাম বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ও লাকসামের সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজকে কালো পোশাকধারী লোকজন ধরে নিয়ে যায়। সে থেকে তারা নিখোঁজ রয়েছেন। গত ২৭ নভেম্বর রাজধানীর উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন জামায়াত কর্মী মেহেদী হাসান ফারুকী (৩৩)।.গত ৮ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডার নিজ বাসা থেকে গ্রেফতারের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন শিবির নেতা তিতুমীর কলেজের ছাত্র জামাল উদ্দিন।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় পাঠাগার সম্পাদক মফিজুর রহমান আশিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জিয়াউর রহমান গত ৫ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন।
এ দিকে গত ১৪ নভেম্বর রাজধানীর খিলক্ষেত থানার ওসি শামিম হোসেন কাউকে কিছু না বলে লাপাত্তা হয়ে যান। জানা গেছে, শামীম পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তা শামিমের পালানোর বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। অনেকে মন্তব্য করেছেন, ভয়ে শামীম পালিয়েছেন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More