জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ।। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক

0

press_news-300x150জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার সমালোচনা করেছেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলেছেন, এ নীতিমালা স্বাধীন গণমাধ্যম ধারণার পরিপন্থি। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বাক-স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ৮টি বিষয়ে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে পার্লামেন্ট বা অন্য কারও ক্ষমতা নেই যাতে তারা বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারে। সংবিধানের সঙ্গে এ ধরনের নীতিমালা সাংঘর্ষিক। নীতিমালায় কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও মূল ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকবে বলেও তারা মত দিয়েছেন। তারা এ নীতিমালাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি হিসেবেও অভিহিত করেন।

অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নীতিমালাটাকে দেখছি ঘোড়ার আগে গাড়ি তৈরি করার মতো। কমিশন না করে নীতিমালা তৈরি হয় কিভাবে? আগে কমিশন গঠন করতে হবে। সেটা প্রয়োগে নীতিমালা তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আলোচনা করতে হবে। আমি সাধারণভাবে এটাই বুঝি। সম্প্রচার নীতিমালায় যে সব ধারা দেয়া হয়েছে ওই সব ধারা কি চিন্তা ও উদ্বেগ থেকে দেয়া হয়েছে আমরা বুঝি। তবে এগুলোর প্রয়োগ অনেক সময় খুবই কষ্টকর এবং একই সঙ্গে বিব্রতকর হবে। এ জন্য জনমনে যাতে কোন ধরনের সংশয় সৃষ্টি না হয় ওই ধরনের নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, নীতিমালায় যত বেশি কথা থাকে তত বেশি সমস্যা তৈরি হয়। শব্দ কম থাকলে তা হতো গণতন্ত্রের জন্য ভাল। পুরো নীতিমালাটি পড়লে বোঝা যায় তা ১৯৭১ সালের স্পিরিটের বিরুদ্ধে যায়। ওই সময় আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম পাকিস্তানের নানা বিধিনিষেধের কারণে। কি বলা যাবে কি বলা যাবে না তা ওই সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। এ নীতিমালার কারণে আমার মনে হয় পাকিস্তানের ওই ধারা ফিরে এলো। কোন ব্যক্তি, মত বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ কথা বলা যাবে না – এমন কথা দিয়ে নীতিমালা তৈরি করলেই মনে হয় সব কিছু ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু যে নীতিমালা গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে সেটাই থাকা দরকার। ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকবে- এটাই নিয়ম। কিন্তু যখনই কোন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় তখন এর অপব্যবহার হবে। এ সরকার হয়তো মনে করছে এটা তৈরি করে কাজে লাগাবে। আসলে কিন্তু তা নয়। কারণ কখনও বর্তমান সরকারও বিরোধী শিবিরে চলে গেলে নীতিমালাটি তার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শাহীদুজ্জামান বলেন, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা যারা তৈরি করছে তাদের জ্ঞান ও মেধা সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কেননা, গণতান্ত্রিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী কোন মানুষ বা সরকার এ ধরনের নীতিমালা তৈরি করতে পারে না। কেউ এ নীতিমালাটি বিবেকের তাড়নায় করেছে এটা বলা অসম্ভব। নীতিমালাটি পক্ষপাতদুষ্ট। এদেশের অতীত ইতিহাসের সঙ্গে নীতিমালাটিকে কোনভাবেই মেলানো যাবে না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে এ ধরনের নীতিমালা নষ্ট করে দেয়। যে সব মূল্যবোধকে তারা প্রাধান্য দেবে যে সব মূল্যবোধ ঠিক কিনা তাদের কে বলবে? জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত কোন সরকারের কাছ থেকে এ ধরনের নীতিমালা কাম্য হতে পারে না।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর দিলারা চৌধুরী বলেন, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার উদ্দেশ্যেই এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকার একটি কমিশন গঠনের কথা বলেছে। কিন্তু ওই কমিশনের কোন বিচার করার ক্ষমতা থাকবে না। কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। সিদ্ধান্ত যা নেয়ার তা সরকারই নেবে। এতে আসল ক্ষমতা সরকারের হাতেই থাকবে। এরপর মিডিয়ার স্বাধীনতা বলতে আর কি থাকে?

সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান বলেন, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদকে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী যে সব কথা বলেছেন আমার বিবেচনায় তা সঠিক ব্যাখ্যা নয়। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বাক-স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার আটটি বিষয়ে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আটটি বিষয়ের বাইরে পার্লামেন্ট বা অন্য কারও ক্ষমতা নেই যাতে তারা বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারে। সম্প্রচার নীতিমালার যে খসড়া আমরা তা সংবিধান নির্দেশিত আটটি বিষয়ের বাইরে। মন্ত্রিসভার এখতিয়ারবহির্ভূত। সংবিধান তাদের এ বিষয়ে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তারা তার অপব্যবহার করছেন। তিনি বলেন, আমি মনে করি মিডিয়ার জন্য একটি নীতিমালা থাকা দরকার। সম্পাদকদের নিয়ে এটা হওয়া উচিত। নিজেদের মধ্য থেকে এ নিয়ে একটি কমিশন হবে। যাতে তারা নিজেরা কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি করবেন। একই সঙ্গে আরোপ করবেন তারা। সরকারের উদ্বেগের ভিত্তি রয়েছে। তাদের উদ্বেগগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। যেমন বৃটেনে মিডিয়াগুলো সরকার থেকে স্বাধীন কিন্তু হাউস অব কমন্সের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই রকম একটি অথরিটি আমাদের দেশেও থাকা দরকার। তবে ওই অথরিটির লাগাম সরকারের হাতে থাকা উচিত নয়। সুপ্রিম কোর্টের বহু রায়ে বলা হয়েছে, নীতিমালার কোন আইনগত কার্যকারিতা নেই। এ ধরনের নীতিমালা সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। সম্প্রচার নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে মিজানুর রহমান খান বলেন, ভারতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিউজ ব্রডকাস্ট স্ট্যান্ডার্ড অথরিটির (এনবিএসএ) আদলে বাংলাদেশেও সুপ্রিমকোর্টের একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নীতিমালা প্রণয়নে সেলফ রেগুলেটরি কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবউল্লাহ বলেন, নীতিমালাটি নিয়ে দেশের সুধী সমাজের লোকজন বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীরা আতঙ্কিত। আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে পারে। কারণ নীতিমালায় এমন কিছু শব্দ দেয়া হয়েছে যার বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই। নীতিমালায় কিছু শব্দের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেয়া নেই। এ কারণে এগুলোর অপব্যবহারের খুবই আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, নতুন নীতিমালার কারণে দেশের গণতন্ত্র এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে। এদেশের মিডিয়ার এমন কোন আচরণ দেখি না যার ফলে এ রকম একটি নীতিমালা এবং এরপর আইন প্রণয়নের প্রয়োজন পড়ে। এর মাধ্যমে মূলত মিডিয়ার পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর চেষ্টা হচ্ছে। সূত্র : মানবজমিন-অনলাইন

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More