যানজট এড়াতে বাড়ছে হেলিকপ্টার যাত্রা

0

heliহেলিকপ্টারের বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়ছে। বাড়ছে যাত্রী সংখ্যাও। আগে সাধারণত করপোরেট কোম্পানিগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তা এবং তাদের বায়াররা এই সেবা নিতেন। এখন সমাজের উচ্চবিত্তের মানুষের মাঝে হেলিকপ্টার ভ্রমণের আগ্রহ বাড়ছে। চড়াদামে টিকিট কেটে মানুষজন হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। রোগী আনা নেয়ার ক্ষেত্রেও এখন হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হচ্ছে।

শুরুর দিকে দুর্গম এলাকায় ভ্রমণ, সিনেমার শুটিং, উপর থেকে প্রজেক্ট এলাকা পরিদর্শন, ছবি তোলা ইত্যাদি কাজের লক্ষ্য নিয়ে হেলিকপ্টার ভাড়া দেয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে যানজট এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের পছন্দের বাহন হয়ে উঠেছে হেলিকপ্টার।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিনিয়ত বেড়ে যাওয়া অসহনীয় যানজট এড়াতে সামর্থ্যবান ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, হাসপাতাল মালিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা খুঁজছে বিকল্প পথ। এর ধারাবাহিকতায় করপোরেট লেভেলে বৃদ্ধি পাচ্ছে হেলিকপ্টারের ব্যবহার। এছাড়া সিনেমার শুটিং, রাজনৈতিক সভা সমাবেশ, রোগী আনা নেওয়া, বিভিন্ন  কোম্পানির বোর্ড মিটিং থেকে শুরু করে অনেকে বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় আসা যাওয়ায়ও ব্যবহার করছেন হেলিকপ্টার।

বেশ কয়েকটি ব্যবসায়িক গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, অসহনীয় যানজটের কারণে ঢাকার বাইরে কোথাও যেতে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বর্তমানে অনেক কোম্পানির পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে ঢাকার আশপাশের মেঘনা ঘাট, কেরাণীগঞ্জ, সাভার, জামালপুর ইত্যাদি লোকেশনে যানজট এড়িয়ে দ্রুত পৌঁছানোর কাজে হেলিকপ্টার বেশি ব্যবহার হচ্ছে।

স্কয়ার এয়ার লিমিটেড এর নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহক আছে যারা প্রায়ই হেলিকপ্টার ভাড়া নিচ্ছেন। স্কয়ার এয়ার লিমিটেড সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিল ২০১০ থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শুরু করে বর্তমানে পাঁচজন যাত্রী বহনে সক্ষম একটি বেল-২০৭ হেলিকপ্টার দিয়ে মেডিকেল ও সাধারণ দুই ধরনের যাত্রী পরিবহন করছে তারা। প্রতি মাসে গড়ে ছয়টা সাধারণ ট্রিপ এবং চারটা এয়ার এ্যাম্বুলেন্স ট্রিপ থাকে স্কয়ার এয়ারের।

জানা গেছে, দেশে শুরুতে মাসে হেলিকপ্টার ব্যবহারীর সংখ্যা ছিল গড়ে মাসে ৫০০ থেকে এক হাজার জন। এখন তা বেড়ে মাসে পাঁচ থেকে ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

জানা গেছে, শিগগির আরো একটি রবিনসন-৬৬ আসছে তাদের বহরে। সাধারণ কাজের জন্য হেলিকপ্টারের ভাড়া প্রতি ঘণ্টার জন্য এক লাখ টাকা সাথে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স। কিন্তু এয়ার এ্যাম্বুলেন্সের জন্য প্রতি ঘণ্টায় ৯০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়, সাথে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স। এছাড়া ভূমিতে অপেক্ষমাণ চার্জ প্রতি ঘণ্টার জন্য ছয় হাজার টাকা সাথে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স।

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্স নামে একটি কোম্পানি বাণিজ্যিক লাইসেন্স নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে সিভিল এভিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী ৯টি কোম্পানির ১৫টি হেলিকপ্টার রয়েছে। কোম্পানিগুলো আরো সমান সংখ্যক হেলিকপ্টার আনার জন্য সিভিল এভিয়েশনে আবেদন জানিয়েছে।

সিভিল এভিয়েশনের ফ্লাইট অপারেশন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, হেলিকপ্টার ব্যবহারে সরকারের নীতিমালা রয়েছে। সে অনুযায়ী ৯টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে আরো কয়েকটি কোম্পানি লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন। এগুলো যাচাই বাছাই হচ্ছে।

সিভিল এভিয়েশনের সূত্রে আরো জানা গেছে, একটি এয়ারলাইন্স সংস্থার লাইসেন্স পেতে যা যা দরকার হেলিকপ্টারের লাইসেন্স পেতে একই নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়। এনওসি, হেলিকপ্টার ইন্সপেকশন, অফিস ইন্সপেকশন, পাইলট, ক্রু লাইসেন্স ভেরিফিকেশন ও ম্যানেজমেন্টের সক্ষমতা সবকিছু যাচাই বাছাই শেষে এয়ারওয়ার্দিনেস সার্টিফিকেট (এওসি) দেয়া হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এ সেবাটি অনেক ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বাণিজ্যিকভাবে পরিচালণার জন্য সিভিল এভিয়েশনের নীতিমালায় অনেক কঠিন শর্ত থাকায় সম্ভবনাময় এই সেক্টরটি দ্রুত এগোতে পারছে না। প্রতিবার উড্ডয়নের জন্য সিভিল এভিয়েশন থেকে অনুমতি নিতে হয়। জ্বালানী সংকটেও প্রায় সময় ফ্লাইট বন্ধ রাখতে হয়। এটি তাদের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হেলিকপ্টার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কোম্পানি সিকদার গ্রুপের মালিকানাধীন আরএনআর এয়ারলাইন্স। বর্তমানে তাদের তিনটি হেলিকপ্টার রয়েছে। এগুলো হলবেল-৪০৪, আর-৬৬ ও আর-৪৪ হেলিকপ্টার। আরো দুটি আর-৬৬ হেলিকপ্টার শিগগিরই ঢাকায় আসছে।

এছাড়া মেজর আব্দুল মান্নানের সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্সের তিনটি (দুটি আর-৪৪, একটি আর-৬৬),  স্কয়ার গ্রুপের একটি, চট্টগ্রামের পিএইচপি গ্রুপের একটি, বাংলা ইন্টারন্যাশনালের একটি, বিআরবি কেবলের একটি, মেঘনা গ্রুপের একটি, আরিরান (ইয়াং ওয়াং) গ্রুপের দুটি, এমএএস বাংলাদেশের একটি হেলিকপ্টার রয়েছে।

এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, তিন থেকে চারটি কোম্পানি হেলিকপ্টার নিয়ে আসলেও এখনো এওসি পায়নি। এর মধ্যে বিআরবি কেবল, বাংলা ইন্টারন্যাশনাল ও পিএইচপি এয়ারলাইন্স রয়েছে। এদের প্রায় সবারই আবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বিশাল হ্যাংগারও রয়েছে।

১৯৯৯ সালে আমেরিকার তৈরি একটি রবিনসন (আর-৪৪) মডেলের হেলিকপ্টার নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রা শুরু করে সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্স।বর্তমানে আমেরিকার তৈরি একটি রবিনসন আর-৪৪ এবং একটি র‍্যাভেন-২ হেলিকপ্টার দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্স। এই হেলিকপ্টারগুলো প্রতি ঘণ্টায় ১৯০ কিলোমিটার বেগে ৬০০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে।

হেলিকপ্টারগুলো তিনজন যাত্রী সহ সর্বোচ্চ এক হাজার ১৩৪ কেজি ওজন বহনে সক্ষম। উল্লেখ্য, দ্যা এয়ার ট্রান্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) এর সদস্য সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্স।

সাধারণ আকশ পথে পরিবহনে হেলিকপ্টার ভাড়াপ্রতি ঘণ্টার জন্য ৪৮ হাজার টাকা। কিন্তু সিনেমার শুটিং, লিফলেট বিতরণসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক কাজের জন্য ৩০ শতাংশ হারে বেশি ভাড়া দিতে হয়।

এছাড়া ভূমিতে অপেক্ষমাণ চার্জ প্রথম ঘণ্টার জন্য তিন হাজার টাকা এবং পরবর্তী প্রতিঘণ্টার জন্য পাঁচ হাজার টাকা। তবে বিমানবন্দর ছাড়া অন্য কোন স্থানে হেলিকপ্টার অবতরণ করতে হলে হেলিকপ্টারের সকল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যিনি ভাড়া নিবেন তার।

এছাড়া পুরো খরচের উপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। নূন্যতম ৩০ মিনিটের জন্য হেলিকপ্টার ভাড়া দিচ্ছে বেসরকারি হেলিকপ্টার ভাড়া প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। জ্বালানি খরচ, ইন্স্যুরেন্সসহ সকল খরচ এয়ারলাইন্স বহন করে থাকে।

হেলিকটার ভাড়া প্রদানকারী বিভিন্ন বেসরকারি এভিয়েশনগুলোর কর্মকর্তারা জানান, মূলত সামর্থ্যবান করপোরেট লোকজনই তাদের নিয়মিত গ্রাহক। এছাড়া সিনেমার শুটিংসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজের জন্য তাদের থেকে হেলিকপ্টার ভাড়া নিচ্ছে মানুষ।

সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদ হুসেইন বলেন, “অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে। হেলিকপ্টার পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালা অনুযায়ী কোম্পানিগুলো পরিচালিত হচ্ছে। নীতিমালার মধ্যেই বলা আছে হেলিকপ্টার উড্ডয়নের ৪৮ ঘণ্টা আগে সিভিল এভিয়েশনকে জানাতে হবে। কারণ হেলিকপ্টারের নির্দিষ্ট কোনো রুট নেই। এ কারণে কোনো হেলিকপ্টার আকাশে উড্ডয়ন করলে টাওয়ারকে প্রস্তুত রাখতে হয় যাতে সহজে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়।”

তিনি বলেন, “দেশে নির্দিষ্ট কোনো রুট না থাকায় অনেক সময় পাইলটরা ভুলে অনুমতি ছাড়া অন্য দেশের সীমানায় ঢুকে পড়ে। এটি খুবই বিপদজ্জনক। টাওয়ার প্রস্তুত থাকলে এ সমস্যা এড়ানো সম্ভব। তবে জরুরি প্রয়োজনে ৫, ১০ বা ১৫ মিনিট এমনকি এক ঘণ্টার মধ্যেও অনুমতি দেয়া হয়।”

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More