রাজধানীতে দুই সহস্রাধিক ছিনতাইকারী

0

dhaka-cintaikari-1-intro-311x186ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান। কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন। মহাখালী আসতেই ৫ যুবক তার গতিরোধ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অস্ত্র ঠেকিয়ে সাথে থাকা এক লাখ সাড়ে ৯ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। টহল পুলিশ বিষয়টি দূর থেকে দেখতে পেয়ে ছিনতাইকারীদের ধাওয়া করে। ধরা পড়ে তিতুমীর কলেজের দুই ছাত্রলীগ নেতা। তাদের এক দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। তবে টাকা ও অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এটি দুই সপ্তাহ আগের ঘটনা।

মাছ ব্যবসায়ী সোহেল মাহমুদ ভোর সাড়ে ৫টায় ইস্কাটনের বাসা থেকে মোটরসাইকেলে যাত্রাবাড়ী যাচ্ছিলেন। বঙ্গভবনসংলগ্ন পার্কের কাছে এলে একটি সাদা রঙের পিকআপে তিন-চার যুবক তাকে ধাক্কা দেয়। এতে মোটরসাইকেল নিয়ে পড়ে যান সোহেল। যুবকরা সোহেলের পেটে ছুরি ঠেকিয়ে মোটরসাইকেলটি (ঢাকা মেট্রো ল-২৫-০০৮০) পিকআপে তুলে নেয় ও ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

গত ৬ সেপ্টেম্বর বেলা সোয়া ১১টায় বঙ্গবাজার মার্কেটের সামনে পায়ে গুলি করে আমির মিয়া নামে এক ব্যবসায়ীর ১০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা।

আমির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খেলনা ব্যবসায়ী। তিনি মালামাল কিনতে গুলিস্তান থেকে চকবাজারে যেতে লেগুনায় ওঠেন। কিন্তু তার পাশের সিটের যাত্রীরা ছিল ছদ্মবেশী ছিনতাইকারী। তারাই আমিরকে গুলি করে টাকা নিয়ে যায়।

একই দিন রাত সোয়া ১১টায় ধলপুরে মানিক নামে এক বিকাশ ব্যবসায়ীকে গুলি করে তিন লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এভাবেই প্রতিদিন ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। রাত কিংবা দিন একটু অসতর্ক হলেই ছিনতাইকারীদের হাত থেকে রেহাই নেই নগরবাসীর।

নগরীর ৩৫০টি স্পটে দুই হাজারেরও বেশি ছিনতাইকারী সক্রিয় রয়েছে, এ তথ্য জানিয়েছে গোয়েন্দারা। তাদের সাথে যুক্ত হয় মৌসুমি ছিনতাইকারী।

গোয়েন্দারা আরো জানায়, ছিনতাই করতে অপরাধীরা ব্যবহার করছে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশিয় অস্ত্র। ছোটখাটো ছিনতাইয়ের ঘটনার বেশিরভাগই মামলার আওতায় আসছে না। মানুষ হয়রানির ভয়ে থানায় যাচ্ছে না। শুধু হতাহত বা বড় অঙ্কের অর্থ খোয়া যাওয়ার ঘটনাই আলোচনায় আসছে।

বেশিরভাগ ঘটনায় ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার বা টাকা উদ্ধার করতে পারছে না পুলিশ। উদ্ধার হচ্ছে না অস্ত্রও। এমনকি পেশাদার ছিনতাইকারীদের তালিকাও নেই প্রশাসনের হাতে। কিছু থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই।

যারা ধরা পড়ল তাদের কতোজনের সাজা অথবা কতোজন বের হয়ে এসে ফের ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ে তারও কোনো পরিসংখ্যান বা গবেষণা নেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারীদের হাতে। ফলে রাজধানীতে ছিনতাই কমছে না, বরং বেড়েই চলছে।

গোয়েন্দারা জানায়, বিভিন্ন উৎসবে রাজধানীতে ছিনতাইকারীসহ অপরাধীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের ১৫টি গ্রুপকে তারা চিহ্নিত করতে পেরেছে।

তাদের তথ্য অনুযায়ী, ছিনতাইকারীদের নিয়ন্ত্রক সরকারি দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। কিছু ছাত্র নেতাও রয়েছেন। এরা বিভিন্ন সময় আটক হলেও বেশিরভাগ সময় রাখা যায় না। ওপরের তদবিরে তারা ছাড়া পেয়ে যায়। উদ্ধার করা অস্ত্রও ফেরত দিতে হয়।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আরো জানান, গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি ছাত্রলীগ, যুবলীগ, ছাত্রদল ও যুবদলের কিছু থানা পর্যায়ের নেতার নাম এসেছে। এসব নেতার ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছে পুলিশ। গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে বাড্ডার সোহেল, গুলশানের নাসির, ল্যাংড়া বাচ্চু, কাইল্যা সেন্টু, মিরপুইর‌্যা আকতার, এতিম মনির, ইমু, জাকির, আরিফ, সুলতান, জাহাঙ্গীর ও সাগর গ্রুপ। প্রতি গ্রুপে সদস্য ছয়-আটজন।

প্রত্যেক দলে রয়েছে একাধিক মোটরসাইকেল। তবে ছিনতাইকারীদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের নিবন্ধন নেই। দিনে ছিনতাইয়ে ব্যবহার করা হয় মোটরসাইকেল। রাতে নামে প্রাইভেট কার নিয়ে।

মিরপুর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া ও উত্তরায় ছিনতাইকারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে খলিফা গ্রুপ। মতিঝিল ও ওয়ারী এলাকার নেতৃত্বে মকবুল গ্রুপ। পুরান ঢাকা ও পোস্তগোলায় রয়েছে ঠাণ্ডু গ্রুপ। কাঙ্গালী জাকির ক্রসফায়ারে মারা গেলেও তার গ্রুপের সদস্যরা ভাগ হয়ে কয়েকটি গ্রুপে কাজ করছে। ডলার লিটন ও কাউয়ুম গ্রুপেরও নাম রয়েছে।

রাজধানীতে ছিনতাই স্পট

রাজধানীতে তিন শতাধিক ছিনতাইয়ের স্পট রয়েছে। এসবের মধ্যে শতাধিক স্পটে নিয়মিত ছিনতাই হয়। এসব স্পটের মধ্যে মালিবাগ মোড়ের এসবি অফিসের সামনে, কাকরাইল মোড়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ১ নম্বর গেট, কমলাপুর রেলস্টেশনের আশপাশ, পীরজঙ্গি মাজার, শান্তিনগর মোড়, ইস্টার্ন প্লাস মার্কেটের আশপাশ, মিরপুর-১ নম্বর গোলচত্বর, টেকনিক্যাল মোড়, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, মহাখালী কাঁচাবাজারের সামনে, তিব্বত মোড়, মোহাম্মদপুরের আরঙ্গজেব রোড, কাঁটাশুর, ধানমন্ডির ৮ নম্বর ব্রিজ মোড়, ফার্মগেটসংলগ্ন ইন্দিরা রোড ও টিঅ্যান্ডটি কার্যালয়ের পেছনের গলি, বনানী কাঁচাবাজার রোড, বনানীর সাবেক ঢাকা গেট, গুলশান লেকপাড়, গুলশান নিকেতন, গুলশান শুটিং কাবের সামনে, কাকলী মোড়, রামপুরা ব্রিজ, মেরুল বাড্ডা বাজার, উত্তর বাড্ডা থানা রোডের মুখে, খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ রেলগেট, ফার্মগেট, যাত্রাবাড়ী মোড়, দয়াগঞ্জ মোড়, কাজলারপাড়, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, জনপথ মোড়, ধলপুর সিটিপল্লী, উত্তরার জসীমউদদীন রোড, হাউজ বিল্ডিং, রামপুরা ব্রিজ, মগবাজার মোড়, জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, কমলাপুর রেলওয়ে হাসপাতাল রোড, নটর ডেম কলেজ গেট থেকে আলহেলাল পুলিশ বক্স, ফকিরাপুল গরম পানির গলি, খিলগাঁও ওভারব্রিজ, পল্টন বিএনপি অফিসের সামনে ভাসানী গলি, রাজারবাগ টেলিকম ভবনের সামনের রাস্তা, শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রের সামনের সড়ক, মানিক মিয়া এভিনিউ, আগারগাঁও ক্রসিং, গাবতলী বাস টার্মিনাল, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও মোড়, আইডিবি ভবনের সামনে, বাড্ডা নতুনবাজার, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া, সদরঘাট, বাবুবাজার ও হাতিরঝিল প্রজেক্ট। এসব এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন মানুষ।

পুলিশের তালিকার বাইরেও থাকা দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর কবরস্থান রোড, যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের আশপাশ, মানিকনগর, মীরহাজীরবাগ ঘুন্টিঘর, জুরাইন বালুর মাঠ, পশ্চিম ধোলাইরপাড়, কদমতলী ওয়াসা রোড, শ্যামপুর থানার পেছনে, নামা শ্যামপুর, কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেটের পাশের সড়কে প্রায়ই ছিনতাই হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, “মাদকের কারণে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। মাদকের টাকা জোগাতেই এক শ্রেণির যুবক ছিনতাইয়ের কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে বস্তির বখাটেদের পাশাপাশি ভদ্র পরিবারের সন্তানও রয়েছে।”

তিনি আরো বলেন, “ছিনতাইকারীদের পুলিশ ধরলেও খুব সহজেই জামিন পেয়ে ছিনতাইয়ে ফিরে আসছে।”

তবে পুলিশের তৎপরতায় এখন ছিনতাইয়ের ঘটনা অনেক কমে এসেছে বলে দাবি করেন উপকমিশনার মাসুদুর রহমান।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More