রিকশাচালকদের কাছে জিম্মি নগরবাসী!

0

rickshaw_pic1-311x186বেলা ১১টা। টিকাটুলির রাজধানী সুপার মার্কেটের বিপরীত থেকে দুই হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ নিয়ে সালাউদ্দিন স্পেশালাইজড হাসপাতালের নিচে পশ্চিম পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ত্রিশোর্ধ্ব রবিন। সেখানে দাঁড়ানো কয়েকটি রিকশার কাছে গিয়ে একজন চালককে জুরাইন যাবে কি না জিজ্ঞেস করলে চালক হ্যাঁ সূচক উত্তর দেন। ভাড়া কত জানতে চাইলে, রিকশাচালক বলে দেন ৬০ টাকা।

রবিন কিছুটা থমকে গিয়ে বলেন, এত টাকা ভাড়া হয়? এবার চালক বললেন, পোষালে যাবেন নইলে হেঁটে যান। এতে রবিন খেপে গিয়ে চালককে বকাঝকা করলে আশপাশের লোক জড়ো হয়ে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রাজধানী মার্কেট থেকে জুরাইনের সর্বোচ্চ ভাড়া ৩০ টাকা। ঘটনাটি শনিবারের।

ঢাকা শহরে চলাচল করতে গিয়ে অনেকেই প্রতিনিয়ত এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, কিছু গন্তব্যে অনীহা, যাত্রীদের সাথে ভাড়া নিয়ে বাগবিতণ্ডা এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত ঘটছে। চাহিদা মোতাবেক ভাড়া না দিলে যাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহার করতেও দ্বিধাবোধ করছে না রিকশাচালকেরা। অসহায় যাত্রীরা ঝামেলা এড়াতে অনেক সময় তাদের চাহিদা মতো ভাড়া দিয়েও দিচ্ছেন। দিনের পর দিন এই অরাজকতা চলতে থাকলেও এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। ফলে রিকশাচালকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে নগরবাসী।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রিকশা এক সময় গরিবের বাহন হিসেবে পরিচিতি পেলেও সে পরিচয় আজ হারাতে বসেছে। এখন আর অল্প ভাড়ায় চড়া যাচ্ছে না রিকশায়। রিকশা ভাড়ার নির্ধারিত কোনো ভাড়া নেই। চালকেরা তাদের ইচ্ছে মতো যা ভাড়া চাইবে, সেটিই সেসময়ের ভাড়া হয়ে যায়। এ কারণে যাত্রী ও চালকদের মধ্যে প্রায়ই বিবাদ বাধে। পাশাপাশি রয়েছে রিকশা চলাচলে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব। এভাবেই চলছে রাজধানীর রিকশা যাত্রা।

রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, শুধু অলিগলিতেই নয়, ভিআইপি সড়কেও চলছে রিকশা ও ভ্যান। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যানের সংখ্যা। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই পরিবহনটির সংখ্যা যত বাড়ছে ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে পুলিশের বাড়তি উপার্জন। মাঝে মধ্যে বড় যানবাহনের সাথে পাল্লা দিয়ে রাস্তায় ছুটতে দেখা যায় এসব রিকশাকে। যানজট নিরসনের জন্য ভিআইপি সড়কসহ বেশকিছু উল্লেখযোগ্য সড়কে রিকশা, ভ্যান ও অন্যান্য অযান্ত্রিক পরিবহন চলাচল নিষিদ্ধ রয়েছে। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা মানছে না ওইসব যানবাহনের চালকেরা। যাদের দায়িত্ব রয়েছে এগুলো নিয়ন্ত্রণের সেই ট্রাফিক পুলিশও এ ব্যাপারে নির্বিকার।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিদিন নতুন নতুন রিকশা যুক্ত হচ্ছে শহরের রাস্তাঘাটে। আর এই রিকশা এখন প্রশাসন থেকে শুরু করে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের কোটি কোটি টাকা উপার্জনের পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত পাঁচ বছরে তারা অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়েছে রিকশার ভুয়া নম্বর প্লেট বিক্রি করে। আর ওই নম্বর প্লেটকেই বৈধ হিসেবে গণ্য করছে পুলিশ। ওই নম্বর প্লেট যেসব রিকশার রয়েছে তা অবাধে চলতে পারছে রাজধানীতে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবৈধ এই বাণিজ্য চলছে রিকশা-ভ্যান মালিক ও শ্রমিক নামধারী কিছু সংগঠনের ব্যানারে। সহায়তা করছে সিটি করপোরেশন এবং মহানগর পুলিশের কিছু অসৎ সদস্য। ভুয়া ওই নম্বর প্লেট দিয়েই চলছে অন্তত ১০ লাখ রিকশা ও ভ্যান। তবে কত সংখ্যক রিকশা ও ভ্যান এখন রাজধানীতে চলছে তার কোনো হিসাব নেই ঢাকা সিটি করপোরেশন বা ট্রাফিক পুলিশের কাছে। এখন রাজধানীর সব পথঘাট উন্মুক্ত পেয়ে রিকশা ও ভ্যানের সংখ্যা আরো বেড়ে চলছে। বাড়ছে রিকশাচালকের সংখ্যাও।

সূত্র জানায়, সরকারি কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও রাজধানীতে রিকশাচালকের সংখ্যা ১৫ লাখের কম হবে না।

সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও রিকশা-ভ্যান মালিক-শ্রমিক সংগঠন সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে বর্তমানে কমপক্ষে ১০ লাখ রিকশা-ভ্যান, ঠেলাগাড়ি ও ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে। কিন্তু বৈধ লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ৮৭ হাজার। এই লাইসেন্সও অনেক পুরনো। এরমধ্যে রিকশা ৭৯ হাজার ৫৫৪টি, ভ্যান আট হাজার। বাদ বাকি ঠেলাগাড়ি ও ঘোড়ারগাড়িসহ অন্যান্য অযান্ত্রিক বাহন।

১৯৮৬ সালে শেষ লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। অজ্ঞাত কারণে গত প্রায় ২৮ বছর ধরে সিটি করপোরেশন থেকে কোনো বৈধ লাইসেন্স ইস্যু করা হচ্ছে না। আর পুরনো লাইসেন্স নবায়নও করা হচ্ছে না। এই সুযোগে একটি সংঘবদ্ধ চক্র বিভিন্ন সংগঠনের নামে রিকশা-ভ্যানের লাইসেন্স দিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ঢাকা মহানগর এলাকায় রিকশা মালিক ও শ্রমিকদের নামে ২৮টি সংগঠন রয়েছে। এরাই মূলত রাজধানীর রিকশা ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এসব সংগঠনের পক্ষ থেকেই দেয়া হচ্ছে নম্বর প্লেট।

ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি, দক্ষিণ) সূত্র জানায়, জনবল সঙ্কট, আইনি জটিলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতার কারণে সব সময় অবৈধ রিকশা আটক সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দিন দিন পুরো ঢাকা শহরে অবৈধ রিকশার সংখ্যা বাড়ছেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মোহাম্মদপুরবাসী এক রিকশা মালিক দিবারতা.কমকে জানান, ১৯৮০ সালের পর ডিসিসি আর নতুন কোনো রিকশার লাইসেন্স দেয়নি। কিন্তু মালিকেরা নতুন নতুন রিকশা বানিয়ে তা নগরীতে চালাচ্ছে। এর বেশির ভাগই অবৈধ লাইসেন্সের মাধ্যমে প্লেট লাগিয়ে চালানো হচ্ছে। আর প্রতিনিয়ত অসহনীয় যানজটের কারণ এ রিকশাগুলোই।

ডিসিসিতে রিকশার লাইসেন্স নবায়ন, নতুন লাইসেন্স ইস্যু ও নামজারিসহ এ বিষয় অন্যান্য কাজকর্ম পরিচালনার জন্য হুইল ট্যাক্স শাখা থাকলেও ডিসিসি দুই ভাগ হওয়ার পরে তা প্রায় অকার্যকর। নগরীতে লাখ লাখ অবৈধ রিকশা চলাচল করলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তা আটক করছে না। ডিসিসি দক্ষিণ মাঝে মধ্যে অবৈধ রিকশার বিরুদ্ধে অভিযাগ চালালেও তা খুবই নগণ্য। অভিযানে দায়িত্বপ্রাপ্তরা জানান, ডাম্পিং সমস্যা, ট্রাক সঙ্কটসহ নানা সমস্যার কারণে এই আটক অভিযান ব্যাহত হচ্ছে।

সম্প্রতি রাস্তায় বাড়ছে ব্যাটারিচালিত রিকশাও। জানা গেছে, এগুলো চলছে পুলিশকে টাকা দিয়ে। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ টাকার বিনিময়ে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের অনুমতি দিয়ে থাকে। প্রতি মাসে রিকশাপ্রতি ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা দিতে হয় পুলিশকে।

রিকশা মালিক জানান, তার রিকশাগুলো চলছে মোহাম্মদপুর ও এর আশপাশের এলাকায়। ওই এলাকার ছয়টি থানাকে তার টাকা দিতে হয় মাসে মাসে। টাকা না দিলে রিকশা আটকে দেয়।

ঝিগাতলা বাসিন্দা ফারজানা আক্তার দিবারতা.কমকে  জানান, রিকশা চলাচল অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ায় রাজধানীর ভিআইপি সড়কসহ প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে এখন যানজটের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এদিকে মৈত্রী পরিবহনের গাড়িচালক ইলিয়াস হোসেন দিবারতা.কমকে  বলেন, ঢাকায় এত সংখ্যক রিকশা আগে কখনো দেখা যায়নি। রিকশার কারণে কোনো কোনো এলাকায় রাস্তা দিয়ে হাঁটাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More