২৯ জিম্মি জীবিত ফিরলেন, একজন লাশ হয়ে

0
ইরানে পাচার হওয়া শ্রমিকরা গতকাল ফিরে এলে তাঁদের জড়িয়ে ধরে স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। ছবি : লুৎফর রহমান  (কালেরকণ্ঠ)
ইরানে পাচার হওয়া শ্রমিকরা গতকাল ফিরে এলে তাঁদের জড়িয়ে ধরে স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। ছবি : লুৎফর রহমান (কালেরকণ্ঠ)

বিমানে করে লাশ এলো জুয়েলের। একই বিমানে যাত্রী ছিলেন জুয়েলের খুনি বলে অভিযুক্ত ছয়জনসহ ২৯ সর্বস্বান্ত প্রবাসী শ্রমিক। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশ যখন অভিযুক্ত শ্রমিকদের আটক করার কাজে ব্যস্ত, তখন অদূরে মাটিতে আছড়ে পড়ে আহাজারি করছিলেন জুয়েলের বাবা শাহজাহান মোল্লা। ‘জুয়েলরে টাকার জন্য গরুর মতো পিটাইতো আর বলতো টাকা পাঠাইতে। কিন্তু পোলার জন্য টাকা পাঠাইতে পারি নাই। ওরে মারতে মারতে কয়েকবার বেহুঁশ করে ফেলছিল। মোবাইলে ফোন কইরা আমারে বলতো বাবা আমারে বাঁচাও। সেই দোজখ থেকে পোলা মুক্তি পাইলেও জীবন নিয়া ফিরতে পারল না।’ দালালের নির্যাতনের বিবরণ এভাবেই উঠে আসে সন্তানহারা এক বাবার আর্তিতে। প্রাণ নিয়ে যাঁরা ফিরতে পেরেছেন, তাঁদের স্বজনরাও কান্নাকাটি করছিল।

শরীয়তপুর জেলার শখিপুরের মোল্লাকান্দি গ্রামের মাছ বিক্রেতা শাহজাহান মোল্লা। তিন ছেলের মধ্যে সবার বড় জুয়েল মোল্লা। অভাবের সংসারে সচ্ছলতা আনতে দুবাই যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন জুয়েল। ধারদেনা করে তিন বছর আগে দুবাই পাঠানো হয় জুয়েলকে। কিন্তু দুবাই যে টাকা আয় হয়, তাতে ঋণের টাকা শোধ করে সংসারের জন্য কিছুই থাকে না। ওই অবস্থায় বাংলাদেশি দালালের খপ্পরে পড়েন জুয়েল। লক্ষাধিক টাকা উপার্জনের লোভে দুবাই ছেড়ে গ্রিসের উদ্দেশে যাত্রা করেন তিনি। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই জুয়েলের স্বপ্নের মৃত্যু হয়। তাঁকে গ্রিসে না নিয়ে ইরানের বন্দর আব্বাস শহরে আটকে রেখে দালালরা পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে না পারায় চলে দিনের পর দিন নির্যাতন। সেই জুয়েল মোল্লা অবশেষে লাশ হয়ে ফিরেছেন বাংলাদেশে। গতকাল রবিবার সকালে এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি বিমানে করে ইরান থেকে বাংলাদেশে আসে তাঁর লাশ। শরীয়তপুরের জুয়েল মোল্লা লাশ হয়ে দেশে ফিরলেও শত নির্যাতন শেষে জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পেয়ে জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছেন আরো ২৯ জন বাংলাদেশি শ্রমিক। তাঁরাও গতকাল একই ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। জীবিত ফেরত আসা শ্রমিকদের মধ্যে আটক করা হয় ছয়জনকে। ফেরত শ্রমিকরা জানান, ইরানে জিম্মিকারীদের হাত থেকে পালিয়ে তাঁরা ধরা দেন ইরানি পুলিশের কাছে। এরপর বাংলাদেশ দূতাবাস তাঁদের মুক্তির ব্যবস্থা করে এবং তাঁদের রাখা হয় দূতাবাসের কর্মকর্তা আরিফুর রহমান অপু ও জিয়াউর রহমানের অধীনে।
শ্রমিকরা জানান, জুয়েল মোল্লার কথা ধরেই দালালদের মাধ্যমে দুবাই থেকে গ্রিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুনামগঞ্জের আসামপুরের হাসান আলীর ছেলে জরিফউল্লাহ, মাদারীপুরের সরদারকান্দি গ্রামের শামসু সিকদারের ছেলে লালন মিয়া, ফেনীর দাগনভূঁইয়ার আব্দুস সোবহানের ছেলে ইয়াসিন, মাদারীপুরের সরদারকান্দির কালাম শরীফের ছেলে মানিক, কক্সবাজারের বাহাতাড়ার জাফরুল ইসলামের ছেলে নুর মোহাম্মদ ও দক্ষিণ শিলাখানীর আবুল মনসুরে ছেলে সলিম উল্লাহ। মুক্তি পাওয়ার পর এ নিয়ে ছয়জন জুয়েলের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। গত ১৪ ডিসেম্বর তাঁদের উপর্যুপরি কিল-ঘুষিতে মারা যান জুয়েল। এ ঘটনায় ইরানের পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করতে চাইলে দূতাবাস কর্মকর্তারা শ্রমিকদের দেশে ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। সেখানকার পুলিশ বিষয়টি নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করেনি। গতকাল বিমানবন্দরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই অভিযুক্ত ছয়জনকে আলাদা করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। পরে তাঁদের সিআইডি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সিআইডির অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক শাহ আলম অভিযুক্ত ছয়জনকে জুয়েল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটক করা হয়েছে উল্লেখ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ছয়জনকে বিমানবন্দরে আটকে রেখেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বাকিদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
জানা যায়, পুলিশের অপরাধ দমন বিভাগ (সিআইডি), ইরানের বাংলাদেশ দূতাবাস ও রাইটস যশোরের সহযোগীতায় তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। ছেলের লাশ বুঝে নিতে গতকাল বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন জুয়েল মোল্লার বাবা শাহজাহান মোল্লা। লাশ পৌঁছার খবর পেয়েই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘দেশে ফেরার জন্য ধারদেনা করে ২৮ হাজার টাকা দিয়ে টিকিটও পাঠানো হইছিল। আমার পোলায় ফিরল, কিন্তু ফিরল লাশ হয়ে।’ বলেই মাটিতে গড়িয়ে কাঁদছিলেন তিনি।
অমানুষিক নির্যাতন এবং মুক্তিপণ দিয়ে হলেও জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছেন যশোরের শার্শার বসতপুরের সোনা মিয়ার ছেলে রুহুল আমিন। বিমানবন্দরে বোন জাহানারা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে রুহুল বলেন, ‘দালালরা টর্চার সেলে রেখে টাকার জন্য মারধর করত। শুধু পানি আর শুকনা রুটি দিত, সেটাও আবার দিনে একবার। মারতে মারতে ওরা অজ্ঞান করে ফেলত, জীবনেও ভাবিনি জীবন নিয়ে দেশে ফিরতে পারব।’ জানা যায়, ছেলের জন্য দুশ্চিন্তা করতে করতে অসুস্থ হওয়ার পর ১০ দিন আগে মারা যান তাঁর বৃদ্ধ বাবা সোনা মিয়া।
রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী ধনিয়ার আহমদ মিয়ার ছেলে পারভেজ রানা বলেন, ‘এখনো যে বেঁচে আছি, এটা বোনাস লাইফ। গ্রিসে লাখ টাকা বেতনের চাকরি দেওয়ার কথা বলে আমাদের ৩০ জনকে দালালরা দুবাই ও ওমান এবং ইরানের বন্দর আব্বাসে নিয়ে আটকে রেখে চালায় নির্যাতন। টাকা না দিলে বিদ্যুতের তার, পাইপ, রড দিয়ে পিটাইতো। অনেকের শরীরে গরম ইস্ত্রি দিয়ে ছেঁকা দিত। নির্যাতন থেকে বাঁচতে দালালদের হাতে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলাম।’
মাদারীপুর রাজৈর কানাইপুর গ্রামের মজিবুর রহমান বাওয়ানীর ছেলে রাকিব বাওয়ানী। তিনি বলেন, ‘ছেলেকে জিম্মিদশা থেকে মুক্তি করতে ভিটেমাটি বন্ধক রেখে চার লাখ টাকা বিকাশ এবং এসএ পরিবহনের মাধ্যমে পাঠাইছি।’ ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘বাবারে আমার বাড়িঘর কিছু দরকার নাই, তোমারে জীবিত ফিরা পাইছি- এটাই আমার সান্ত্বনা।’ কুমিল্লার মুরাদনগরের যাত্রাপুর গ্রামের নসু মিয়ার ছেলে রফিকুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের কিছু দালালের সঙ্গে মিলে ইরানের দালালরা আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। তিনি এখানকার সিন্ডিকেটকে ধরার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
সর্বস্বান্ত অবস্থায় আরো যাঁরা ফিরেছেন তাঁরা হলেন- কুমিল্লার ওলি উল্লাহ, আল আমীন, জয়নাল আহমদ, কক্সবাজারের নুরুল হক, কুমিল্লার কামাল হোসেন, গোপাল বিশ্বাস, চট্টগ্রামের আরশাদ মিয়া, নাজমুল দোহা, আব্দুল মান্নান, শেখ আলম, পিরোজপুরের মাঈনুল হোসেন, ফেনীর জামাল হোসেন, মৌলভীবাজারের আলিমউদ্দিন, কালা মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জুয়েল মিয়া, সোহেল মিয়া, সোহাগ ও আনোয়ার হোসেন।
মানবাধিকার সংগঠন রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইরানে আটক রফিকুল ইসলামের বড় ভাই ওয়াসিমের কাছ থেকে বিষয়টি জানতে পেরে এই বিষয়ে প্রশাসনের সহযোগিতা নিই। বিষয়টি স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ইরানের বাংলাদেশ দূতাবাস এবং অপরাধ দমন বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) শাহ আলমকে লিখিতভাবে জানাই। এরপর থেকে সিআইডির একটি টিম মাঠে নামে। সবার সহযোগিতার কারণে শেষ পর্যন্ত এসব শ্রমিককে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।’
সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) শাহ আলম বলেন, ‘চক্রটিকে সমূলে উপড়ে ফেলার জন্য আমাদের একটি টিম মাঠে কাজ করছে। ইতিমধ্যে ইরানের বাংলাদেশি দালালদের কিছু সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More