আহমদিয়া মুসলিম জামাতের অনুসারীরা নিজেদের অন্য সকল মুসলমানের মতোই মুসলিম বলেই দাবি করেন।
তবে সুন্নি মুসলিমদের অনেকে আহমদিয়াদের ‘অমুসলিম’ বলে মনে করেন।
ভারতের পাঞ্জাবের কাদিয়ান থেকে এই দর্শনের জন্ম বলে অনেকে এই সম্প্রদায়ের লোকজনকে কাদিয়ানী বলেও বর্ণনা করে থাকেন। এই সম্প্রদায়কে নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশেই বিরোধ রয়েছে। আহলে সুন্নাহ’র অনুসারীরা তাদের মুসলমান বলে মনে করেন না। পাকিস্তানে আহমদিয়াদের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশেও আহমদিয়া জামাতের নানা অনুষ্ঠান ঘিরে একাধিকবার বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার এরকম একটি সহিংসতায় দু’জনের মৃত্যু হয়। সেখানে বহু মানুষ আহত হয়েছে, অর্ধশত বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া আর ভাঙচুর করা হয়েছে।
কিন্তু আহমদিয়া মুসলিম জামাতের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে? তাদের নিয়ে অন্যদের বিরোধের পেছনেই বা কী কারণ?
ভারতের একটি গ্রামে যাত্রা শুরু
বর্তমানে সারা বিশ্ব জুড়ে তাদের লাখ লাখ সদস্য ছড়িয়ে থাকলেও আহমদিয়া মুসলিম জামাতের জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসরের কাছাকাছি একটি গ্রাম – কাদিয়ানে।
‘দি আহমদিয়া মুভমেন্ট’ গ্রন্থে আইয়ুব ইয়োসুফ লিখেছেন, আহমদিয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা গোলাম আহমদ ব্রিটিশ সরকারের চাকরি করতেন।
চাকরির সুবাদে মুসলমান ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সঙ্গে তার মেলামেশা করার সুযোগ হয়েছিল। তবে কয়েক বছর পরে তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করে গ্রাম কাদিয়ানে ফিরে আসেন।
আহমদিয়া মুভমেন্ট নামের আরেকটি বইতে গবেষক ইয়োহানান ফ্রেডম্যান লিখেছেন, ১৮৮০ সালে তিনি তার ধর্মীয় মতবাদের গ্রন্থ বারাহিন-ই-আহমাদিয়া’র প্রথম দুটি অধ্যায় প্রকাশ করেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি নিজেকে দাবি করেন যে, “যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ভুল পথে থাকা মুসলমান সমাজকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য” তিনি ইসলামের একজন সংস্কারক হিসাবে এসেছেন।
এর কয়েক বছর পর ১৮৮৯ সালে তিনি প্রথমবার দাবি করেন, তিনি ইসলামের একজন নবী ঈসা এবং ইমাম মাহদি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন।
বাংলাদেশে আহমদিয়া জামাতের জাতীয় আমির আবদুল আউয়াল বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”ইসলামের নবী মোহাম্মদ (সাঃ) এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী যে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহাদী এবং ঈসা নবীর আগমনের কথা ছিল, তখন একজন ব্যক্তি দাবি করেন, তিনিই সেই প্রতিশ্রুত ঈসা নবী এবং ইমাম মাহাদী। সেই ব্যক্তি হলেন মির্জা গোলাম আহমদ।‘’
‘’তিনি দাবি করেন, তিনি সেই ঈসা ইবনে মারিয়াম, রূপক অর্থে যার আবির্ভাবের ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিল। যিনি মাহাদী, তিনিই ঈসা,‘’ বলছেন আবদুল আউয়াল।
ইয়োহানান ফ্রেডম্যান লিখছেন, “মির্জা গোলাম আহমদ দাবি করেন কোরান ও হাদিসে যে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ ঈসা নবীকে তুলে নিয়ে গিয়েছেন এবং তিনি আবার পরবর্তী ফিরে আসবেন। তিনিই হচ্ছেন ফিরে আসা ঈসা নবী। ”
তবে তিনি এও বলেন, তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ নবী বা আইন-প্রণেতা নবী হিসাবে আসেননি। বরং ইসলামের নবীর বাণী প্রতিষ্ঠা করতে এসেছেন। তার অনুসারীরা তাকে উম্মতি নবী বলেও দাবি করেন।
সেই সময় থেকেই বিতর্ক শুরু হলেও অনেক মানুষ তার অনুসারী হতেও শুরু করে।
কাদিয়ান গ্রাম থেকে প্রচার শুরু হওয়ার কারণে অনেকে এর অনুসারীদের কাদিয়ানি বলেও বর্ণনা করে থাকে।
কিন্তু এই মতবাদ গ্রহণ করেনি অবিভক্ত ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি ইসলামের অনুসারীরা।
মির্জা গোলাম আহমেদ ১৯০৮ সালে মারা যান। তাকে নিজ গ্রামে সমাহিত করা হয়।
আহমদিয়া জামাতের বিস্তার
অক্সফোর্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনলাইনের তথ্য অনুসারে, মির্জা গোলাম আহমদের মৃত্যুর পর নেতৃত্ব নিয়ে ১৯১৪ সাল নাগাদ এই মতবাদে বিশ্বাসীদের মধ্যে বিভক্তি দেখা গিয়েছিল। বড় অংশটি মির্জা গোলাম আহমদের ছেলে বশীর-উদ-দ্বীন মাহমুদ আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত হতে শুরু করে, যে অংশটিকে বলা হতো কাদিয়ানি।
আরেকটি ছোট অংশ মাওলানা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে লাহোরে অবস্থান নিয়ে কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করে, যারা পরিচিতি পায় লাহোরি নামে। যদিও এই অংশের ধ্যান-ধারণা অনেকটা সুন্নি মুসলমানদের কাছাকাছি। তারা মির্জা গোলাম আহমদকে ইসলামের একজন নবী নয়, বরং সংস্কারক বলে মনে করে।
গবেষক আইয়ুব ইয়োসুফ লিখেছেন, তার মৃত্যুর আগে থেকেই এই সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা বাড়ছিল। ১৮৯৬ সালে যেখানে এই মতবাদে বিশ্বাসীর সংখ্যা ছিল ৩০০ জন, ১৯১৮ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ হাজারে।
পরবর্তীকালে তারা যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তার ঘটায়। সেসব জায়গায় মসজিদ স্থাপন প্রাধান্য পেয়েছে।
এমনকি ১৪৯২ সালে স্পেন থেকে মুর মুসলমানদের বিতাড়িত হবার পর সেদেশে প্রথম মসজিদ স্থাপন করেন আহমদিয়ারা, ১৯৮২ সালে।
যদিও আহমদিয়া সম্প্রদায় দাবি করে, সারা বিশ্বে তাদের ২০ কোটির বেশি অনুসারী রয়েছে। তবে সুন্নি মুসলমানদের দাবী, এই সংখ্যা এক কোটির বেশি হবে না।
বাংলাদেশে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জাতীয় আমির আব্দুল আউয়াল জানিয়েছেন, ১৯০২ সালের দিকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের দুই ব্যক্তি কাদিয়ানে গিয়ে এই মতবাদের অনুসারী হন।
তবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম আহমদিয়া জামাত প্রতিষ্ঠা হয় ১৯০৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়।
কেন আহমদিয়াদের সঙ্গে বিরোধ সুন্নিদের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম খাদেমুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, আহমদিয়ারাও অন্য মুসলমানদের মতো কোরান অনুসরণ করা, নামাজ-রোযা পালন থেকে শুরু করে অন্যান্য নিয়মকানুন অনুসরণ করে থাকে।
‘’কিন্তু তাদের সঙ্গে সুন্নি মুসলমানদের বড় পার্থক্য হলো, সুন্নিরা ইসলামের শেষ নবী বলে মোহাম্মদকে মনে করেন। এর পরে আর কোন নবী আসবেন না। কিন্তু আহমদিয়ারা মনে করেন, তাদের মির্জা গোলাম আহমদ ঈসা বা ইমাম মাহদি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন,‘’ তিনি বলছেন।
দেশ ভাগের পর ১৯৪৭ সালে আহমদিয়া সম্প্রদায় ভারতের কাদিয়ান থেকে তাদের সদর দপ্তর পাকিস্তানের রাবওয়ায় নিয়ে যায়।
কিন্তু সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা তাদের বিরোধিতা করতে শুরু করে। সেদেশের বিভিন্ন আদালতে তাদের বিশ্বাস নিয়ে মামলা মোকদ্দমাও চলে।
ধর্মীয় নেতাদের চাপে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো সংবিধান সংশোধন করে আহমদিয়াদের ‘অমুসলিম’ বলে ঘোষণা করেন। এক দশক পর আরেকটি আইন করে তাদের মসজিদে নামাজ পড়া বা ধর্মচর্চার যেকোনো রকম প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়।
‘ইসলাম অ্যান্ড দি আহমদিয়া জামাত’ বইয়ে সিমন ভ্যালেন্টিন লিখেছেন, এসব সত্ত্বেও সহিংসতা থেকে বিরত থাকার ওপর সবসময় গুরুত্ব দিয়েছে এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা। তারা ধর্ম প্রচারে জোরালো কর্মসূচিও নিয়েছে।
কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা বাধার মুখোমুখি হয়েছে।
দু’হাজার আট সালে ইন্দোনেশিয়ায় আহমদিয়াদের ওপর ব্যাপক হামলা করে উগ্রবাদীরা। সেই সময় তাদের চলাচলেও বিধিনিষেধ আরোপ করে দেশটির সরকার।
ধর্ম বিশ্বাসের কারণে সৌদি আরবেও তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের কেউ সেখানে হজ পালন করতে গেলে তাকে আটক কিংবা দেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে।
বাংলাদেশেও একাধিকবার আহমদিয়া জামাতের কর্মসূচি বা অনুষ্ঠানকে ঘিরে সহিংসতা, বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।
বাংলাদেশে আহমদিয়া জামাতের জাতীয় আমির আবদুল আউয়াল বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’খাঁটি ধর্মের যখন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেয়া হয়, তখন ধর্ম ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় বলে তারা বিরোধিতা করে।‘’
‘’ইসলামের কোরান, কলেমা, নামাজ, হজ, যাকাত, রোজা – সবরকম বিশ্বাসের সঙ্গে আমরা একমত। শুধু তফাৎ হলো, প্রতিশ্রুত মহাপুরুষের আগমন নিয়ে। ইসলাম ধর্মের দলাদলি ঘুচাতে, ধর্ম ব্যবসা নিরোধে, নিজেদের আবার সতেজ মুসলমান বানানোর জন্য যে ব্যক্তির আগমনের কথা স্বয়ং মহানবী বলেছেন, আমরা তাকে মেনেছি। অন্যরা বলছেন, তিনি আসবেন বটে, কিন্তু এখনো আসেননি,‘’ বলছেন আবদুল আউয়াল।
তিনি বলছেন, ‘’তিনি উম্মতি নবী হওয়ার দাবিদার। তিনি মহানবীর অনুসরণ করেন, অনুকরণ করেন বলে আল্লাহর কাছে গৃহীত হয়েছেন।‘’
পঞ্চগড়সহ উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলায় আহমদিয়া জামাতের অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি সুন্নি ইসলামপন্থী সংগঠনের সাথে মিলে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ‘সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণ পরিষদ’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে।
আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সুন্নিদের বিরোধ কোথায় জানতে চাইলে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’রসুল (সাঃ) শেষ নবী, তারপরে কোন নবী আসবে না। ঈসা (আঃ) আসবেন, কিন্তু আসবেন উম্মত হিসাবে। ওরা রসুলকে নবী মানে ঠিক, কিন্তু তাদের বিভিন্ন ধারায় (মির্জা গোলাম আহমদকে) উম্মতি নবী বলে, ঈসা ইবনে মরিয়ম বা ইমাম মেহেদি বলে। তারা রসুলকে নবী বলে, তারপর বলে নবীর পরে আবার নবী গোলাম আহমদ কাদিয়ানি। এখানেই বিরোধ।‘’
‘’যারা রসুল (সাঃ)-কে শেষ নবী মানবে না, তাদের ঈমান থাকে না, তারা মুসলমান হতে পারে না,’’ তিনি বলছেন।
কিন্তু তারা তাদের মতো বিশ্বাস নিয়ে থাকলে, কারও সমস্যা তৈরি না করে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে সমস্যা কোথায়, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘’তারা তো আলাদা ধর্ম দাবি করছে না। তারা তো নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করছে। তাদের আকিদাগত, ঈমান বা বিশ্বাসগত যে মত প্রকাশ করে, সেই সূত্রে তারা মুসলমান থাকতে পারে না।‘’
‘’হিন্দুরা যখন পূজা করে, আমরা তো বিক্ষোভ মিছিল করি না। আরও অন্য ধর্মের যারা আছে, তাদের ব্যাপারেও আমরা আপত্তি নেই। আমরা এটাও বলছি, তারা কাদিয়ানি নামে বা আহমদিয়া সম্প্রদায় নামে প্রোগ্রাম করুক, মিছিল করুক, যা ইচ্ছা তাই করুক, কোন সমস্যা নেই। কিন্তু মুসলমান নাম তারা ব্যবহার করতে পারবে না। মুসলমান নাম ব্যবহার করতে চাইলে, রসুল শেষ নবী, তারপরে আর কোন নবী আসবে না, সেটার ওপর ঈমান আনতে হবে,’’ বলছেন সুন্নি আন্দোলনকারী নেতা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।