মনজুরুল ইসলাম
বিএনপির সমাবেশ ঘিরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। এতে মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। শুক্রবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে। ছবি: প্রথম আলো
ঘটনা-১
শনিবার সকালে ও দুপুরে দুই দফায় বিএনপি সমর্থক সন্দেহে ১০-১২ জনকে নীলক্ষেতের তোরণের সামনে আটক করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। মারধর ও মুঠোফোন ঘাঁটার পর তাঁদের পুলিশের হাতে তুলে দেন তাঁরা (প্রথম আলো অনলাইন, ১০ ডিসেম্বর ২০২২)।
ঘটনা-২
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে ছাত্রলীগ। শুক্রবার বিকেলে এক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। এতে সড়কের দুপাশে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয় (আজকের পত্রিকা অনলাইন, ৯ ডিসেম্বর ২০২২)।
ঘটনা-৩
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড দিয়ে ছোট গাড়িও ঢাকায় ঢুকতে দিচ্ছে না পুলিশ। শনিবার দুপুর থেকে পুলিশ অটোরিকশা, লেগুনাসহ ছোট গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়। …গণপরিবহনের পর ছোট গাড়ি চলাচল বন্ধ হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা (প্রথম আলো অনলাইন, ১০ ডিসেম্বর ২০২২)।
ওপরের প্রতিটি ঘটনা ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এবং পুলিশের কর্মকাণ্ডের একেকটি খণ্ডচিত্র। সরকার ও দলের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে গত বুধবার থেকেই তাঁরা মাঠে ছিলেন, তবে শুক্র ও শনিবার তাঁদের তৎপরতা ছিল বেশি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট, এসব তৎপরতায় সাধারণ মানুষ ও যাত্রীরা ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হন, তাঁরা হয়রানির অভিযোগও করেন। প্রশ্ন হলো, বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশের এসব কর্মকাণ্ড কি আইনসংগত হয়েছে?
লক্ষণীয় হলো, এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। তাদের কথা-বার্তা, আচার-আচরণে মনে হয়েছে, তারা যেন ‘আইনের ঊর্ধ্বে’। যখন কোনো দেশে ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের ‘আইনের ঊর্ধ্বে’ মনে করে কিংবা তাদের কর্মকাণ্ডে তেমনটা প্রতীয়মান হয়, সেই দেশের সাধারণ মানুষের ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার না হয়ে উপায় থাকে না।
বাংলাদেশে রাজনীতি বা সংগঠন করার অধিকার একটি সংবিধানসম্মত অধিকার। মৌলিক অধিকার অংশে ‘সংগঠনের স্বাধীনতা’ শিরোনামে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ একইভাবে ‘সমাবেশের স্বাধীনতা’ শিরোনামে ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’
তাহলে বিএনপি বা অন্য কোনো দলের কর্মী হওয়া এবং দলটির সমাবেশে যোগ দেওয়া কোনো ‘বেআইনি’ কাজ নয়; বরং সমাবেশে যেতে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে হলে, সেটা হবে তাদের সাংবিধানিক অধিকারের লঙ্ঘন। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে তেমনটাই হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপি কর্মী সন্দেহে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন কর্তৃক মানুষজনকে মারধরের ঘটনা একই সঙ্গে একটি অপরাধমূলক ও আইন ভঙ্গকারী কর্মকাণ্ড।
তল্লাশির নামে লোকজনকে যানবাহন থেকে নামিয়ে তাঁদের মুঠোফোনের ছবি, মেসেজ ঘাঁটছে পুলিশ। গত বুধবার দুপুরে গাজীপুরের টঙ্গী সেতুর সামনেছবি: প্রথম আলো
‘চলাফেরার স্বাধীনতা’ শিরোনামে সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ তাহলে যারা মহাসড়ক অবরোধ করলেন কিংবা গাড়ি আটকে যাত্রীদের ঢাকায় প্রবেশ করতে না দিলেন না, তারা স্পষ্টতই সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, আইন ভঙ্গ করেছেন।
‘গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ’ শিরোনামে সংবিধানের ৪৩ (খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’ ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ বিভিন্ন স্থানে মানুষজনের মুঠোফোনে থাকা ছবি ও বার্তা যাচাই করেছে, গণমাধ্যমে এমন অনেক খবর এসেছে। মুঠোফোনে যেমন মানুষের ব্যক্তিগত ও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, তথ্য ও ছবি থাকে, তেমনি এটা বর্তমান সময়ে আমাদের যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। রাস্তায় তল্লাশির সময় পুলিশ বা অন্য কেউ মুঠোফোন পরীক্ষা করলে, সেটা ব্যক্তির গোপনীয়তাকে ক্ষুণ্ন করে। এটাও সাংবিধানিক অধিকারের একটি গুরুতর লঙ্ঘন।
যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি মানুষের মুঠোফোন তল্লাশি করছে পুলিশ। ছবিটি গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে উত্তরার কামারপাড়া মোড় থেকে তোলা
১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ কোথায় হবে, তা নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরেই দলটির সঙ্গে সরকার ও পুলিশের টানাপোড়েন চলে। শেষ পর্যন্ত গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয় এবং সমাবেশটি শান্তিপূর্ণভাবে শেষও হয়। নয়াপল্টনে বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেওয়ার পেছনে ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে’—এমন যুক্তি দিয়েছিলেন অনেকে। বাস্তবে দেখা গেল, ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীনেরা যেসব কর্মকাণ্ড করেছে, সেগুলোর অনেক কিছুই মানুষের সাংবিধানিক অধিকারের লঙ্ঘন এবং সেই কারণে তা ‘বেআইনি’। বিরোধী দলকে মোকাবিলার নামে এ ধরনের ‘বেআইনি’ কর্মকাণ্ড আইনের শাসন ও গণতন্ত্রকে আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
লক্ষণীয় হলো, এ বিষয়গুলো নিয়ে সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। তাদের কথা-বার্তা, আচার-আচরণে মনে হয়েছে, তারা যেন ‘আইনের ঊর্ধ্বে’। যখন কোনো দেশে ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের ‘আইনের ঊর্ধ্বে’ মনে করে কিংবা তাদের কর্মকাণ্ডে তেমনটা প্রতীয়মান হয়, সেই দেশের সাধারণ মানুষের ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার না হয়ে উপায় থাকে না।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক