আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ‘শবেবরাত’ বলা হয়। শবেবরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। শব মানে রাত, বরাত মানে মুক্তি; শবেবরাত অর্থ মুক্তির রজনি। ‘শবেবরাত’-এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাত’, লাইলাতুম মুবারাকা। হাদিসে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্যরজনি বলা হয়েছে। তবে বিশ্ব মুসলমানের কাছে এ রাত ‘শবেবরাত’ নামেই বেশি পরিচিত। শবেবরাত সম্পর্কে আল কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের। নিশ্চয়ই আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে। নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী।’ (সুরা দুখান, আয়াত ১-৩) এ আয়াতের তাফসির সম্পর্কে বরেণ্য মুফাসসির আল্লামা শেখ আহমদ ছাভি (রহ.) বলেন, ‘ওই বরকতময় রজনি হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত।’ তাবেয়ি ইকরামা (রহ.) ও অন্য তাফসিরকারকের মতও, ‘সেই বরকতময় রাত হলো মধ্য শাবান তথা শবেবরাত।’ (তাফসিরে ছাভি, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪০) জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) এ আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘আর বরকতময় রাত হলো লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা শাবানের মধ্যরাত তথা শবেবরাত। কেননা এ রাতে উম্মুল কিতাব কোরআন শরিফ সপ্তম আসমান থেকে দুনিয়ার আসমানে তথা প্রথম আসমানে নাজিল হয়েছে।’
(তাফসিরে জালালাইন, পৃষ্ঠা ৪১০) ইমাম আবু জাফর আত-তাবারি (রহ.) বলেন, ‘তাবেয়ি হজরত ইকরামা (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মধ্য শাবানের রাতে বছরের সব ব্যাপার চূড়ান্ত করা হয়, জীবিত ও মৃতদের তালিকা লেখা হয় এবং হাজিদের তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকা থেকে পরে একজনও কমবেশি হয় না।’ (তাফসিরে তাবারি, খন্ড ১০, পৃষ্ঠা ২২) ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘এ রাতের চারটি নাম আছে- লাইলাতুম মুবারাকা, লাইলাতুল বারাআত, লাইলাতুস সাক, লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান।’ (তাফসিরে কুরতুবি, খন্ড ১৬, পৃষ্ঠা ১২৬) ইমাম বাগাভি (রহ.) লেখেন, ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ শবেবরাতের রাতে সব বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন এবং শবেকদরের রাতে তা সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববান ফেরেশতাদের কাছে ন্যস্ত করেন।’ (তাফসিরে বাগাভি, খন্ড ৭, পৃষ্ঠা ২২৮) শবেবরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে সহি হাদিসেও অনেক বর্ণনা এসেছে। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে, আমার ধারণা হলো, তিনি ওফাত পেয়েছেন।
আমি তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা! তোমার কী এ আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রসুলুল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সিজদা দেখে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, না জানি আপনি ওফাত পেয়েছেন? নবীজি বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলই ভালো জানেন। তখন নবীজি বললেন, এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত; এ রাতে আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২) হজরত আয়েশা (রা.) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, নবীজি এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন।
প্রিয় নবী তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া বকরির পশমের সংখ্যার পরিমাণের চেয়েও বেশিসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি) একদিন প্রিয় নবী আয়েশা (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আয়েশা! শাবান মাসের মধ্যরাতের মর্যাদা ও ফজিলত সম্পর্কে তুমি কী জানো? তিনি আরজ করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ শাবান মাসের মধ্যরাতের মর্যাদা কী? আল্লাহর হাবিব উত্তরে বললেন, আগামী এক বছরে কতজন আদমসন্তান ভূমিষ্ঠ হবে এবং কতজন আদমসন্তান মৃত্যুবরণ করবে তা এ রাতে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এ রাতে তাদের আমল মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থাপন করা হয় এবং তাদের রিজিক অবতীর্ণ কিংবা নির্ধারণ করা হয়।
(ফাজায়েলুল আওকাত) হজরত আবু মুসা আশয়ারি (রা.) রসুলে কারিম থেকে বর্ণনা করেন। রসুলে পাক ইরশাদ করেন, মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ রহমত নিয়ে আবির্ভূত হন এবং তার সমস্ত বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মুশরিক বা শত্রুতা পোষণকারী ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না। (ইবনে মাজাহ) হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো; কেননা এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে রহমত নিয়ে অবতরণ করেন এবং আহ্বান করেন; কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিকপ্রার্থী আছো কি? আমি রিজিক দেব; আছো কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব। এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ) পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, দুরুদ, সালাম, মিলাদ, কিয়াম, ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে শবেবরাতকে আমাদের মুক্তির এবং নাজাতের অসিলা বানিয়ে নিই। আগামী বছরের তাকদির যেন আল্লাহতায়ালা আমাদের জন্য শুভ এবং সুন্দর করে দেন। সব মুসলমান যেন ভাই ভাই হয়ে জীবনযাপন করতে পারি, সেই তৌফিক আল্লাহ আমাদের দিন।
মুফতি মুহাম্মদ এহছানুল হক মোজাদ্দেদী
bd pratidin