ফ্যাসিবাদী সরকারের ভিন্নমত দমনে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গুম, ক্রসফায়ার কিছুটা দৃশ্যত কিছুটা হ্রাস পেলেও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে গুপ্ত হামলা ও হত্যার ঘটনা। গত দুই মাসে বিভিন্ন জেলায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ১১ জন স্থানীয় নেতা গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন। প্রত্যেকটি হত্যার ধরণ প্রায় একই রকমের। হেলমেট পরিহিত ব্যক্তিরা মোটরসাইকেল অথবা মাইক্রোতে করে এসে গতিরোধ করে কাউকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আবার কাউকে গতিরোধের পরপরই হত্যা করে চলে গেছেন খুনিরা।
১. গুপ্ত হত্যার সর্বশেষ শিকার হয়েছেন গত ৫ নভেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউপি চেয়ারম্যান এবং জামায়াত ইসলামীর স্থানীয় নেতা মাহবুবুর রহমান মাহবুব। ওইদিন সন্ধ্যায় তাঁর নিজের ফার্মেসি থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার পথে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে। স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ফেসুবক পেজে পোস্টে বলা হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা এলোপাথাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেছে জামায়াত ইসলামী মনোনীত রংপুরের মিঠাপুকুর পায়রাবন্দ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মাহবুবার রহমানকে।’
২. গত ২৯ অক্টোবর রাতে ৭ থেকে ৮টার মধ্যে গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছে এরশাদ আলী দুলাল (বয়স ৪৮, পল্লী চিকিৎসক, রাজশাহী)। রাজশাহীর চন্দ্রিমা থানার পারিলা ইউনিয়নের কৃষ্টগঞ্জ বাজারে নিজ চেম্বার থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় খুনিরা। ৭/৮ জন খুনি একটি সাদা হাইস মাইক্রোবাসে করে এসে তুলে নিয়ে যায় এই পল্লি চিকিৎসককে। তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর লাশ পাওয়া যায় শাহ মখদুম থানার সিটি হাট এলাকায়। লাশের শরীরের আঘাতের চিহ্ন অনুযায়ী ধারণা করা হয় তাঁকে রড ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে আঘাত করা হয়েছিল। বাম পায়ের ফিমার হাড় ভাঙ্গা অবস্থায় পাওয়া গেছে।
৩. রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ গোলাম কাজেম আলী আহমাদকে হত্যা করা হয় ২৯ অক্টোবর রাত পোনে ১২টায়। বর্ণালি মোড়ে অবস্থিত পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চেম্বার শেষে বাসায় ফেরার পথে নাম্বার বিহীন সাদা রংয়ের হাইস মাইক্রোবাস দিয়ে মোটরসাইকেলের গতিরোধ করা হয়। এক পর্যায়ে খুনিরা উপর্যুপরি তাঁর বুকে ছুরিকাঘাত করে। এতে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যান তিনি। লাশের শরীরের বাম পার্শ্বে ৩টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই মাইক্রোবাসেও খুনির সংখ্যা ছিল ৭ থেকে ৮ জন।
৪. নাটোরের লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম-সম্পাদক মাসুদ রানাকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয় ৩ নভেম্বর রাত ১১টায়। তাঁকে নিজ বাড়ির সামনে থেকে রাত সাড়ে ১০টার দিকে তুলি নিয়ে যাওয়া হয় ডিবি পরিচয় দিয়ে। সাদা মাইক্রোবাসে করে এসে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। মুমূর্ষু অবস্থা তাকে গোপালপুর আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজের পাশে ফেলে যায় খুনিরা। পরবর্তীতে হাসপাতালে নিলে ঘণ্টাখানেক পরই ডাক্তাররা মৃত ঘোষণা করেন।
৫. ভোলায় শফিকুল ইসলাম নামে একজন গুপ্ত হত্যার শিকার হন ৩০ অক্টোবর। পূর্ব ইলিশা গ্রামে ছুরিকাঘাতে গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন তিনি।
৬. নাটোর লডাঙ্গা উপজেলা জামায়াত সেক্রেটারি ফজলুর রহমান গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন ২৭ অক্টোবর, রাত সাড়ে ৯টায়। ৪-৫ জন হেলমেটধারী হোন্ডায় এসে নলডাঙ্গা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে তাঁর মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। তাঁকে চাইনিজ কুড়াল ও চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের পাশাপাশি দুই পায়ের রগ কেটে দেয়।
৭. নলডাঙ্গার নরশৎপুর ওয়ার্ড জামায়াত নেতা পল্লী চিকিৎসক আলাউদ্দিন গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন ২৫ অক্টোবর। হেলমেটধারিরা এসে তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে নির্বিঘ্নে চলে যায়।
৮. নলডাঙ্গার ভট্টপাড়া মসজিদের ইমাম নুরশাদ আলীকে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ একদল হেলমেটধারী এসে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এসময় আঘাতে তাঁর হাতের হাড় ভেঙ্গে গেছে।
৯. নাটোর নলডাঙ্গা উপজেলার খাজুরা ইউনিয়নের জামায়াত আমির মোশাররফ হোসেনকে ৩০ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে তুলে নিয়ে যায় একদল সন্ত্রাসী। তারা সাদা মাইক্রোতে এতে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। দুই হাত ও দুই পা ভেঙে দেওয়ার পর মৃত ভেবে তাঁকে উপজেলার সাধনাগর বিল এলাকায় ফেলে যায়।
১০. ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যায় রাজশাহীতে মো. রাজু নামে একজন চিকিৎসক গুপ্ত হামলার শিকার হন। বোয়ালিয়া থানাধীন ঝাউতলা মোড়, আমানা হাসপাতালের সামনে এই ঘটনা ঘটে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়।
১১. নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা জামায়াত সেক্রেটারি মো. ইয়াকুব গুপ্ত হামলার শিকার হন ২৮ অক্টোবর। ঢাকার সমাবেশ থেকে ফেরার পথে দাগনভূঞা উপজেলার দুধমুখা বাজার এলাকায় তাঁর উপর হামলা চালানো হয়। এসময় তাঁকে ব্যাপক মারধর করা হয়। এতে তাঁর মাথা ফেটে যায় এবং হাত ও হাঁটু ভেঙ্গে যায়।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মরিয়ে হয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীদের উপর এরকম পরিকল্পিত গুপ্ত হামলা চালাচ্ছে বলে মনে করেন ঘটনার ভিকটি পরিবার গুলো।