চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) প্রধান ছাত্রাবাসে নির্যাতনের শিকার চার ছাত্র ক্যাম্পাসে ফিরতে এখনো ভয় পাচ্ছেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ অভয় দিলে তাঁরা ক্যাম্পাসে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়ে এক ছাত্র এখনো ঘুমের মধ্য চিৎকার করে উঠছেন বলে জানিয়েছে তাঁর পরিবার।
নির্যাতনের শিকার ছাত্ররা কলেজের এমবিবিএস ৬২ ব্যাচের। তাঁদের অভিযোগ, ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে তাঁদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের ১৭-সি কক্ষে মারধর করা হয়। ‘বড় ভাইয়া’ ডেকেছেন বলে চারজনকে পর্যায়ক্রমে ওই কক্ষে নিয়ে যান ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। পরে তাঁদের ওপর নির্যাতন করা হয়।
চার ছাত্রের মধ্যে আবু রাইয়াত ও মোবাশ্বির হোসেন নির্যাতনের ঘটনার পর বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। দুদিন আগে তাঁরা বাড়ি থেকে লিখিত অভিযোগ কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর পাঠিয়েছেন। এর আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অপর দুই ছাত্র সাকিব হোসেন ও জাহিদ হোসেন লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন।
রাইয়াত ও মোবাশ্বিরের লিখিত অভিযোগেও তাঁদেরকে বেদম মারধর করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগে তাঁরা বলেছেন, ক্রিকেট স্টাম্প, পাইপ ও লাঠি দিয়ে তাঁদের হাত–পাসহ শরীরে বিভিন্ন স্থানে বেদম মারধর করা হয়েছিল। তাঁদের মুঠোফোনও রেখে দেওয়া হয়।
অভিযোগ উঠেছে, নির্যাতনের ঘটনার পর দুই সপ্তাহের বেশি সময় গড়ালেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে এখনো কথা বলতে পারেনি তদন্ত কমিটি।
রাইয়াত মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে কলেজ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। আমি আমার অভিযোগ পাঠিয়ে দিয়েছি। আমাকে ভোর চারটায় ডেকে নিয়ে মারধর করা হয়েছিল। আমাকে যখন কক্ষে নিয়ে যায়, তখন সাকিব ও জাহিদকে সেখান থেকে বের করে আনা হচ্ছিল। তাঁদের চোখেমুখে তখন নির্যাতনের চিহ্ন ছিল।’
ঘটনার পর দিন ৯ ফেব্রুয়ারি রাইয়াত ও মোবাশ্বির বাড়ি চলে যান। রাইয়াত কুমিল্লার এবং মোবাশ্বির নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা। রাইয়াত চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। গত মঙ্গলবার তিনি হাসপাতাল থেকে কুমিল্লার বাসায় ফেরেন।
এখনো শরীরে ব্যথা রয়েছে এবং হাত–পায়ের ক্ষত শুকায়নি উল্লেখ করে রাইয়াত বলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতি করি না। আমার মুঠোফোনে শিবিরের সম্পৃক্ততার তথ্য রয়েছে বলা হচ্ছে। এটা সঠিক নয়। এখন কলেজে যেতেও ভয় পাচ্ছি। কর্তৃপক্ষ না বলা পর্যন্ত যাব না।’
একই কথা বললেন রাইয়াতের বাবা আবু জামাল। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ছেলেকে এখন ক্যাম্পাসে পাঠাব না। খুব ভয় পাচ্ছি। আগে অধ্যক্ষ কী বলেন দেখি। তাঁরা যদি অভয় দেন, তখন ক্যাম্পাসে পাঠাব।’
এদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন সাকিব ও জাহিদ গত রোববার বাড়ি চলে গেছেন। সাকিবের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী এবং জাহিদের বাড়ি ঢাকার সাভারে। তাঁরাও ক্যাম্পাসে এখনই আসছেন না বলে জানালেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের পর তাঁরা ক্যাম্পাসে ফিরতে চান।
জাহিদের বাবা ফরহাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলের মধ্যে এখনো ট্রমা (মানসিক আঘাত) কাজ করছে। ঘুমের মধ্যে চিৎকার দিয়ে ওঠে। আপাতত বাড়িতে ছুটিতে আছে। (কলেজ কর্তৃপক্ষ) নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে ক্যাম্পাসে পাঠাব।’
নির্যাতিত ছাত্রদের লিখিত অভিযোগে যাঁদের নাম এসেছে তাঁদের মধ্যে অভিজিৎ দাশ, জাকির হোসেন, ইমতিয়াজ আলম, রেয়াজুল ইসলাম, সাজু দাশ, সৌরভ ও আকাশ অন্যতম। অভিজিৎ দাশ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেন। এই মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের আরেকটি পক্ষ রয়েছে। সেই পক্ষটি সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী।
চার ছাত্রকে মারধর করা হয়নি দাবি করে অভিজিৎ দাশ আগেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ওই চারজন ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের কাছ থেকে সব ধরনের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁদের শাসানো হয়েছিল।
এদিকে নির্যাতনের ঘটনায় গঠন করা তদন্ত কমিটিকে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিকেলের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় ৭ কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়েছিল। তদন্ত শেষ করার জন্য কমিটির সদস্যরা আরও বাড়তি সময় চান। মূলত অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটি এই ঘটনার তদন্ত করছে। এই কমিটির সদস্য সংখ্যা ৯ জন।
অভিযোগ উঠেছে, নির্যাতনের ঘটনার পর দুই সপ্তাহের বেশি সময় গড়ালেও অভিযুক্তদের সঙ্গে এখনো কথা বলতে পারেনি তদন্ত কমিটি। বাড়ি ফেরার আগে তদন্ত কমিটির সদস্যরা সাকিব ও জাহিদের সঙ্গে হাসপাতালের কেবিনে গিয়ে আলাদাভাবে কথা বলেন। এর আগে দুজনই লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন।
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান চমেক উপাধ্যক্ষ মো. হাফিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অপর দুই ছাত্র তাদের লিখিত অভিযোগ পাঠিয়ে দিয়েছে। তদন্তকাজ এগিয়ে চলছে। সবার সঙ্গে কথা বলে আমরা প্রতিবেদন দেব। আরেকটু সময় লাগবে।’