বিশ্ববিদ্যালয়ে পশুত্বের বর্বরতা

0

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে জ্ঞান চর্চার কারখানা। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে শিক্ষার্থীরা নতুন স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ভর্তির পর তারা এসে পড়েন আদিম যুগের পশুত্বের বর্বরতার মুখে। র‌্যাগিং, গেস্ট রুম, ম্যানার শেখানোর নামে তাদের উপর যে অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন করা হয় তা হিংস্র পশুর বর্বরতাকেও হার মানায়। এ ছাড়াও ম্যানার শেখানো, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, যৌন হয়রানি, দুর্নীতি, প্রশ্নফাঁস, ভর্তি ও সিট বাণিজ্য, শিক্ষককে হেনস্থা হেন কোনো অপরাধ নেই যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হচ্ছে না। র‌্যাগিং নিয়ে হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? আইন এবং হাইকোর্টকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছে পশুত্বের বর্বরতা। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে পরিচিত শিক্ষকরা ‘দলদাসে’ পরিণত হওয়ার কারণে ‘বিবেক’ বন্ধক রাখায় দিনের পর দিন চলছে নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হিংস্র আচরণ। মাঝেমধ্যে দু’একটি নিষ্ঠুর ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশ পেলে হৈচৈ পড়ে যায়। প্রশাসন ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার নামে ‘তদন্ত কমিটি’ গঠন করেন। আধুনিক যুগেও এই নিষ্ঠুরতা চলছে তো চলছেই। নতুন শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পশুত্বের কবলে পড়তেই হবে এটাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের সভাপতি প্রফেসর এ এ মামুন বলেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করবেন তার পরিবেশ শিক্ষাবান্ধব ও নিরাপদ হওয়া দরকার। হলগুলোতে গণরুম এবং র‌্যাগিং দূর করতে হবে। এজন্য প্রতিষ্ঠানের সকল অংশীজনকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী এবং প্রশাসনের সচেতনাই সবচেয়ে বেশি দরকার।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফলাফলের পর ভর্তি পরীক্ষায় লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রতিযোগিতা করে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। এদের মধ্যে পরিবারের আদুরে অনেক সন্তান রয়েছেন যাদেরকে বাবা-মা কখনো গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, বকা পর্যন্ত দেননি। অথচ সেই সন্তানই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর শিকার হচ্ছেন শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের। যার কোনটি ‘র‌্যাগিং’, কোনটি ‘গেস্ট রুম কালচার’ কিংবা ‘আদব’ শেখানোর নামে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন একেকটি সাধারণ শিক্ষার্থী টর্চার সেলে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ এসব নির্যাতনের প্রতিবাদ করছেন, বেশিরভাগই নিরবে সয়ে যাচ্ছেন। আবার কারো কারো ভাগ্য হচ্ছে বুয়েটের আবরারের মতোও। কখনো ছাড়তে হচ্ছে হল, ক্যাম্পাস, কখনো আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়ে অনুগত হতে হচ্ছে নির্যাতনকারীদের, না হলে বরণ করতে হয় আবরার ভাগ্য। কারণ যারা এসব নির্যাতন করেন তারা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। নির্যাতনের বিষয়ে মুখ খুললেই নেমে আসে আরো বেশি নির্যাতন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একক আধিপত্য, ছাত্রলীগের কাছে প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের অসহায় আত্মসমর্পন, নির্যাতন-নিপীড়নের বিচার না হওয়ায় দিনের পর দিন এসব ঘটনা একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেড়েই চলছে বলে মনে করেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। ফলে অনেকেই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পড়াশুনা-প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। দিনাজপুর হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি) প্রতি বছরই ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাচ্ছে একাধিক শিক্ষার্থী। অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় কলেজগুলোতেও একই চিত্র।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং কালচার অনেক পুরোনো। কিন্তু এখন দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং বড় কলেজগুলোতে তা ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকলেই গেস্ট রুম নামের টর্চার সেলে ডেকে কখনো বা রুমে গিয়ে চালানো হয় রাতভর নির্যাতন। কখনো এই নির্যাতন থেকে মুক্তি মেলে, বেশিরভাগ সময়ই যেতে হয় হাসপাতাল পর্যন্ত। আবার এসব ঘটনা কারো কাছে বললে পরবর্তীতে বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা, ছাড়তে হয় হল। ইডেন মহিলা কলেজে তো প্রশাসনের চাইতে ছাত্রলীগের নেত্রীদের ক্ষমতাই বেশি। সেখানে ছাত্রীদের মারধর, বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, অনৈতিক কাজে বাধ্য করা, ‘উপঢৌকন’ হিসেবে পাঠানোর কারণে কিছুদিন আগেও আলোচনায় ছিল ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি। আর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হাতে ফুলপরী নির্যাতনের ঘটনা এখনো তরতাজা। একই চিত্র জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাদ নেই বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য বড় কলেজগুলোও।

অথচ বিগত শতকে ছাত্রলীগকে ঐতিহ্যবাহী সংগঠন হিসেবে সকলেই সমীহ করতো। দেশ ও শিক্ষাঙ্গনের অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্রলীগের সাহসী নেতৃত্ব ও অবদান ছিল। সেই সংগঠনটিই এখন শিক্ষার্থীদের কাছে আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ শুধু শিক্ষার্থী নির্যাতনই নয়, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, যৌন হয়রানি, দুর্নীতি, প্রশ্নফাঁস, ভর্তি ও সিট বাণিজ্য, শিক্ষককে হেনস্থা হেন কোনো অপরাধ নেই যা ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ করছে না।

নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক:

যেই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে র‌্যাগিংসহ শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি তারাই আবার র‌্যাগিং বিরোধী ক্যাম্পেইন শুরু করেছে।

জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন বলেন, তারুণ্যের অবক্ষয়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড না থাকা ও র‌্যাগিংয়ের কালচার গড়ে ওঠা এসবই কারণ। তাছাড়া ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া ও এসব ঘটনার কারণ বলা যায়। তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগ শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে। শিগগিরই অপকর্ম থেমে যাবে।

সাম্প্রতিক সময়ে যে বিষয়গুলো ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক মন্তব্য করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, আমরা চাইনা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী সুনামের সংগঠনের নাম কোনপ্রকার অপকর্ম, অপসংস্কৃতি ও অপতৎপরতার সাথে যুক্ত হোক। আমরা যেখানেই কোনোরকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পাচ্ছি সেখানে আমাদের সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অনুরোধ করছি যাতে ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। তিনি বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধ প্রমাণিত হলে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। তবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ৫০ লক্ষ নেতাকর্মীর একটি বড় সংগঠন। তাই সংগঠন পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু মিডিয়ায় অনেক সময় তা অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়।

সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের (চমেক) দুটি কাণ্ড দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ইবিতে ছাত্রীকে রাতভর নির্যাতনের পর বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের কাণ্ড গড়িয়েছে উচ্চ আদালত পর্যন্ত। আর চমেকের কাণ্ডে ভুক্তভোগী দুই শিক্ষার্থীকে আইসিইউতে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। ছাত্রনেতাদের কিছু কিছু কক্ষ টর্চার সেলে পরিণত হয়েছে। অবশ্য এসব ঘটনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তরফে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে; বিভিন্ন অনভিপ্রেত কাণ্ডে ছাত্রলীগ থেকে এ পর্যন্ত ২৫ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

জানা যায়, ১৭ মাস আগেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে মাহাদি জে আকিব নামে এক শিক্ষার্থীর মাথার খুলি থেঁতলে দেয়ার ঘটনায় আলোচিত হয়েছিল সারা দেশে। নিজের সহপাঠীর মাথার খুলি থেঁতলে দিয়ে আলোচনায় আসেন একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগ নেতা অভিজিৎ দাশ। সে সময় শাস্তি হিসেবে তাকে দুবছরের জন্য বহিষ্কার করা হলেও ফিরে এসে এবার অভিজিৎ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আবারও জড়িয়ে পড়েন ছাত্র নির্যাতনের মতো অপকর্মে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চার শিক্ষার্থীকে ডেকে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে ছাত্রলীগের অভিজিৎ বাহিনী। টর্চার রুমে চার জনকে সারারাত পেটানো হয় লোহার রড ও খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে। এদের মধ্যে দুজন ইতোমধ্যে মৃত্যুভয়ে ছেড়েছেন ক্যাম্পাস ও বাকি দুজনকে ভর্তি করা হয় আইসিইউতে। তবে আইসিইউতে গিয়েও আহতদের হুমকি দিয়েছেন অভিজিৎ বাহিনীর সদস্যরা। অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হওয়া দূরের কথা, দম্ভের সঙ্গে আহতদের হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘এখন আইসিইউতে আছিস, নাম বললে মর্গে থাকবি!’ একই ধাচের ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলার পাশাপাশি ক্যাম্পাসজুড়ে এখন ছিনতাই, চাঁদাবাজীতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়িয়ে পড়ছে। ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হলের অন্তত ৫৩ জন আবাসিক শিক্ষার্থী শারীরিক বা মানসিক বা উভয়ই হয়রানির শিকার হয়েছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীদের র‌্যাগিংয়ের অভিযোগে ৫জনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

ইডেন কলেজ: কিছুদিন আগে ইডেন কলেজে ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনা বেশ আলোচিত ছিল। যেখানে ছাত্রীনিবাস পুরোপুরি ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। তারা টাকা নিয়ে ছাত্রীদের ওঠান। দলীয় কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করেন, তারা যা বলবে সে অনুযায়ী চলতে হবে, না হলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। যার নেতৃত্বে ছিলেন ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রীভা। গত আগস্টে দুই ছাত্রীকে রাতভর নির্যাতন করা হয় এবং তাদেরকে বিবস্ত্র করে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। গত ২১ ফেব্রুয়ারি ইডেন কলেজের ছাত্রীনিবাসে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী মহুয়া আক্তারকে মারধর করেন ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রোকসানা আক্তার। এছাড়া ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না গেলে, কিংবা নেত্রীদের কথা মত না চললে কলেজটিতে ছাত্রী নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে অহরহই।

হাবিপ্রবি: র‌্যাগিংয়ের নামে ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে গত ৪ বছরে দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) অন্তত ৪ জন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। এর মধ্যে গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে গেছেন স্থাপত্য বিভাগে ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রিয়াদ হাসান। এর আগে গত বছর ফিসারিজ অনুষদের ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সানাউল্লাহ্, তার আগের বছর এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০তম ব্যাচের শাহরিয়ার এবং তারও আগের বছর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফকির আলমগীর সিয়াম র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে যান।

রিয়াদ হাসানের বাবা মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘বড় ভাইদের সালাম না দিলে গায়ে হাত তুলবে- এটা কোন ধরনের আচরণ! সবাই তো ওখানে লেখাপড়া করতেই গেছে। তা না করে সন্ত্রাসী আচরণ করা তো ঠিক না। এ বিষয়ে স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারম্যান আবু তৈয়ব মো. শাহরিয়ার জানায়, রিয়াদের ঘটনায় ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা তার নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করবো। আমরা কখনোই চাই না যে কোনো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এভাবে চলে যাক।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগ। গত এক বছরে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে নির্যাতন, হুমকি প্রদান, ভয়ভীতি প্রদর্শন, সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও আবাসিক শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক হল থেকে বের করে দেওয়া এমনকি স্বাধীনতা দিবসের খাবার লুট করার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এসব ঘটনার লিখিত অভিযোগ পাওয়া সত্ত্বেও জড়িত কাউকে স্থায়ী শাস্তির আওতায় আনেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আর শাস্তি না হওয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।

একের পর এক শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর মামুনুর রশীদ বলেন, র‌্যাগিং নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সংলগ্ন মেসগুলোতে নিয়মিত টহল দিচ্ছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের স্থায়ী বহিষ্কারের বিধান রাখা হয়েছে।

জানা যায়, গত এক বছরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অন্তত ৪২টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এছাড়া নির্যাতনের শিকার হয়েও প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়নি এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে শতাধিক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে ১৩টি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। তার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে মাত্র ৬টির। তবে কোনো ঘটনায় ছাত্রলীগের কাউকে শাস্তির আওতায় আনেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দু-একটি ঘটনার বিচার হলেও সেগুলো ছিল সাময়িক।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে এক সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাত্রকে হলরুমে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে একই হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সোলাইমান ও তাদের অনুসারীরা। শুরুতে তাকে শিবির ট্যাগ দিয়ে পেটানো হলেও পরে যখন জানা যায় সে সনাতন ধর্মাবলম্বী তখন সংখ্যালঘুতার সুযোগ নিয়ে তাকে আরেক দফা পেটানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী কৃষ্ণ রায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ও হল প্রভোস্টের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এর আগেও চলতি বছর ১৯ জানুয়ারি শাহ মাখদুম হলের সামিউল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধর ও টাকা ছিনিয়ে নেয়া, ২২ জানুয়ারি শহীদ শামসুজ্জোহা হলের জাকির হোসেন নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে তার নিজের কক্ষ থেকে বের করে দেয়াসহ একই রকমের নানা অপরাধ ও নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটিয়ে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। দেশজুড়ে ছাত্রলীগের শিক্ষার্থী নির্যাতনের প্রতিবাদে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বোহা চত্বরে প্রতীকী অনশনে বসেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন খান।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) দুই শিক্ষার্থী মানসিক নির্যাতন ও মারধর করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রলীগ নেতা। তাঁদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি একজনকে মারধর এবং অপরজনকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে ইনস্টিটিউটের তৃতীয় ব্যাচের সভাপতির কাছে ওই দুই শিক্ষার্থী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। ইনস্টিটিউটের অভিযোগ তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান বরাবর দেওয়া লিখিত অভিযোগ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের মন্নুজান হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আতিফা হক শেফা এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আতিকুর রহমান এতে নেতৃত্ব দেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, দেশজুড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আবাসিক প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের বের করে দেওয়া হচ্ছে। এটা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। তিনি বলেন, নিরাপদ পরিবেশে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করবে এটাই প্রত্যাশিত। তবে, ক্যাম্পাসগুলোতে ইদানীং যেসব নৈরাজ্যমূলক ঘটনা ঘটছে, এতে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে শঙ্কিত।

ফরিদ উদ্দিন খান আরো বলেন, কোনো প্রশাসনই শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিষয়ে তৎপর নয়। তারা শুধু মিটমাটের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী। এটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। যারা প্রশাসনে আছে তাদের বুঝতে হবে তারা সব শিক্ষার্থীর অভিভাবক। তাদের নিশ্চুপ থাকাটা কাম্য নয়। তারা যদি দায়িত্বপালনে ব্যর্থ হন তাহলে সময় এসেছে দায়িত্ব থেকে তাদের সরে আসার।

এদিকে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী কলেজের সাংবাদিকসহ অন্তত ৩০ শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়। ওইদিন রাতে রাজশাহী কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসের ই ও বি ব্লকের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কক্ষে ঢুকে মারধর এবং কয়েকজনকে ছাত্রলীগের ‘টর্চার সেল’ হিসেবে পরিচিত এফ ব্লকের বারান্দায় নিয়ে মারধর করা হয়। সেখানে প্রত্যেককেই চড়-থাপ্পড় মারা হয়। রাজশাহী কলেজে পড়েন না, ছাত্রলীগের এমন নেতাকর্মীরা মারধরে অংশ নেন। কলেজ ছাত্রলীগের নেতারা বহিরাগতদের সহায়তা করেন।

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা: গত ১২ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে শেখ হাসিনা হলের একটি কক্ষে আটকে রেখে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীরা। ভুক্তভোগী ছাত্রী জানান, গণরুমে নিয়ে তাকে চড়, লাথি, ঘুষি মেরে বিবস্ত্র করা হয়। রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত তার ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। ঘটনার পর ভূক্তভোগী শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের জন্য ভিসির সাথে দেখা করে দাবি জানান ওই ছাত্রলীগ নেত্রী।

ভূক্তভোগী ওই ছাত্র অভিযোগ করে বলেন, আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিচ্ছিল আর এর ফাঁকে ফাঁকে চালাচ্ছিল শারীরিক নির্যাতন। কিল, ঘুষি, থাপ্পড় কোনোটাই বাদ রাখেনি। কাপড় আটকানোর আলপিন দিয়ে পায়ের ঊরুতে ফুটাচ্ছিল। নির্যাতনের সময় আরেক ছাত্রী মুঠোফোন দিয়ে ভিডিওধারণ করেন। একপর্যায়ে বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণ করা হয়। কাঁদতে কাঁদতে তিনি পা ধরে ক্ষমা চাইলেও তাঁরা কোনো কথা শোনেননি। বরং বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণের সময় হুমকি দেওয়া হয়। বলা হয় এই কথা কাউকে জানালে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। আপুরা মারার সময় বলছিল “মুখে মারিস না, গায়ে মার যেন কাউকে দেখাতে না পারে।”’

রাতের কথা কাউকে জানালে ওই ছাত্রীরা তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেন বলে অভিযোগ করেন তিনি বলেন, এ কথা কাউকে বললে হল থেকে বের করে দেবে বলে শাসায়। এই ঘটনার পর নির্যাতিত ছাত্রী মুখ খুললে তা আলোচিত হয়। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছে।

এদিকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন ২৭ নারী অধিকারকর্মী। তারা এক বিবৃতিতে বলেন, আশ্চর্যজনক হলেও সত্য আমাদের নারী শিক্ষামন্ত্রী পদত্যাগ করা তো দূরে থাক, এখন পর্যন্ত একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। একই অবস্থা নারী প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্য, সংরক্ষিত আসনের বাইরের নারী এমপি ও মূলধারার নারী নেত্রীদের। সম্ভবত তারা আশা করছেন গত বছর ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে জুনিয়র সহপাঠীদের পার্টির নেতা বা ব্যবসায়ীদের কাছে যৌন উপভোগের জন্য যেতে বাধ্য করার তদন্তটি যেভাবে “ম্যানেজ” হয়ে গিয়েছিল, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটিও একইভাবে “ম্যানেজ” হয়ে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: মানবাধিকার বিষয়ক ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্টস এগেইনস্ট টর্চার (স্যাট) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হলের অন্তত ৫৩ জন আবাসিক শিক্ষার্থী শারীরিক বা মানসিক বা উভয়ই হয়রানির শিকার হয়েছে। এ সময় বিভিন্ন সংবাদপত্রের তিন ক্যাম্পাস সংবাদদাতাকেও লাঞ্ছিত করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ হামলার ঘটনার পেছনে ‘রাজনৈতিক কারণ’ কাজ করেছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বেশির ভাগ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, গত এক বছরে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৩০ জন শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করা হয় এবং ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে না আসায় ২৫ জনকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়।

সম্মেলনে বক্তৃতাকালে স্যাটের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সালেহ উদ্দিন সিফাত বলেন, নির্যাতনের ২৬টি ঘটনার মধ্যে চারটি ক্ষেত্রে খুবই নামমাত্র ও অকার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এই ধরনের নির্যাতনের ঘটনা শারীরিক ও মানসিকভাবে স্পষ্টতই ফৌজদারি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সংশ্লিষ্ট হলের প্রভোস্ট এবং হাউস টিউটররা ঘটনার জন্য তাদের দায়িত্ব উপেক্ষা করতে পারে না। সমস্যা সৃষ্টিকারীরা ভুক্তভোগীদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলি জোরপূর্বক চেক করার কিছু ঘটনা উল্লেখ করে সিফাত বলেন, কোনও সঠিক, আইনি এবং ন্যায্য পদ্ধতি বজায় না রেখে কেউ অন্য কারো ব্যক্তিগত ডিভাইস চেক করতে পারে না। এটি একজনের গোপনীয়তা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম স্তর। এসময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে র্যাগিং ও গেস্টরুম নির্যাতন বিরোধী আইন প্রণয়নের দাবি জানান।

ঢাবি ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, যখন যেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটে তখন সেখানে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এটি একটি স্থায়ী এবং চলমান ব্যবস্থা। কোথাও কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলে সেখানে সংশ্লিষ্ট হল প্রশাসন এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।

শিক্ষার্থীদের এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যখন শিক্ষার্থীরা আসে তখন তাদের মাথার উপর ছাদ হয়ে দাঁড়ায় কিছু পলিটিক্যাল গডফাদার। তখন তাদের ছত্রছায়ায় সব ধরনের অপরাধ করে বেড়ায় এসব মেধাবী শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সিস্টেম চলে আসছে, যেখানে কাগজে-কলমে একটা প্রশাসনিক বডি থাকলেও কার্যত ক্ষমতার অধিকারী ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন। সুতরাং এসব থেকে উত্তরণ তখনই সম্ভব হবে যখন দেশের রাজনৈতিক ব্যাবস্থায় পরিবর্তন আসবে, আইনের শাসন থাকবে; গণতন্ত্র থাকবে। তা না হলে ৫০ বছর ধরে চলে আসা নৈরাজ্য কোনোদিনও বন্ধ হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর রহমান বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের থাকতে হয়, হল এবং ক্লাসরুমগুলো ওভার ক্রাউডেড। এমনও আছে যে, হলে তিন ধাপে আলাদা আলাদা সিফট হয়ে শিক্ষার্থীদের ঘুমোতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের এই রাগ বা ক্ষোভের পেছনে এই বিষয়টার একটা বড় প্রভাব পড়ে। শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের একটা দূরত্ব এখানে দৃশ্যমান, শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো টেক কেয়ার করা হয় না। ফলে একটা চাপা কষ্ট শিক্ষার্থীদের মনে সবসময়ই থাকে। এর ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের উপর ক্ষমতার প্রয়োগ দেখানোর হীন মানসিকতা থেকে এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে। এছাড়া প্রসাশনের উপযুক্ত পদক্ষেপের অভাবে এই বিষয়গুলো বন্ধ হচ্ছে না বলেও জানান তিনি। বলেন, রাগ মানুষের একটি সহজাত ধর্ম। কিন্তু এই রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা মানুষের মানবিক গুণাবলী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় ৭১ হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. আব্দুল বাছির বলেন, এখানে দুটো বিষয় রয়েছে। প্রথমত শিক্ষার্থীরা ছাত্র নেতাদের সহায়তায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে হলের গণরুমগুলো উঠে। এবং সেখানের যে মূল্যবোধ তা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের সাথে যায় না। দ্বিতীয়ত আমরা হলের প্রভোস্ট ও হাউজ টিউটররা খুব একটা হলে যাই না। সে কারণে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সান্নিধ্য পাওয়ার যে বিষয় ছিল সেখানে একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে- এটা আমি বিশ্বাস করি। তিনি বলেন, আমাদের মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় হলগুলোতে সিট সংখ্যা অনেক কম। এই বাস্তবতা যতদিন আছে ততদিন আমাদের একটু ভুলবোঝাবুঝি হবে। আমরা অনুরোধ করি যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা যেন হলে সিট পাওয়ার আগ পর্যন্ত কারো মাধ্যমে হলে না উঠে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, আমাদের কাছে যখনই কোনো অভিযোগ এসেছে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি এবং নিচ্ছি। শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুরোধ থাকবে যেন, তারা সব বিষয় আমাদের সাথে শেয়ার করে। এরকম মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাছে এগুলা কেউ আশা করেনা। তারপরও এরকম একটি সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেও কারো ভিতরে যদি এরকম মন-মানসিকতা তৈরি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আমাদের যতটুকু করণীয় আছে আমরা তা করছি।

জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেষর মানস চৌধুরী বলেন, গেস্টরুম বা গণরুমের এই নির্যাতনগুলো ক্ষমতার বা কর্তৃত্বের অনিরাপত্তাবোধ থেকেই শুরু হয়। কিছুকাল আগেও যারা ম্যানার শেখাতেন এবং মারধর করতেন তাদের আলাদা করা যেত। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে বোধহয় উভয়ে এককে পরিণত হয়েছে। এটিকে ক্যাম্পাসের সীমাহীন এলোমেলো প্রশাসনের ফলাফল হিসেবেই বর্ণনা করা যায়। শুধুমাত্র একটা দিনকে আলাদা না করে যদি দশ-বিশ বছরের প্রবণতাকে দেখি তখন দেখা যাবে এই পাওয়ার নেটওয়ার্ক বা সিনিয়রদের দ্বারা শক্তি প্রয়োগের বিষয়টিকে প্রশাসকেরা কোন না কোনভাবে মদদ দিয়েছেন। মূলত তারা এটি করছেন প্রশাসকেরা পপুলার থাকবার স্বার্থে। ফলে হলেগুলোতে যে নির্যাতন হয় সেটা প্রশাসনের বিপর্যয় হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়।

উৎসঃ   ইনকিলাব
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More