রিজার্ভ চুরি নিয়ে নয়া বিতর্ক

0

গোলাম মাওলা রনি

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার যখন চুরি হয়ে গেল তখন পুরো দেশবাসীর সঙ্গে আমিও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কে চুরি করল, কিভাবে করল এসব প্রশ্ন মাথায় নিদারুণভাবে ঘুরপাক খেত এবং হাজার বছরের বাঙালি স্বভাবের পরিপক্বতার কারণে ‘কান নিয়েছে চিলে’র কবিতার মতো আমিও সন্দেহ করতে থাকলাম যে, কেস্ট বেটাই চুরিটি করেছে এবং কেস্টর সঙ্গে রূপ-শ্যাম-যদু-মধুরা নিশ্চয়ই রয়েছে। তারপর বাংলার চোরদের দক্ষতা-সাহস এবং আন্তর্জাতিক চুরি চামারির বিশাল নেটওয়ার্কের কথা কল্পনা করা মাত্র নিদারুণভাবে আতঙ্কিত অনুভব করতে থাকলাম।

রিজার্ভ চুরির ঘটনার সময় বাংলাদেশের গণতন্ত্র হাল আমলের চেয়ে বেশ ভালো ছিল। সরকারের লজ্জা-শরমও কিঞ্চিত অবশিষ্ট ছিল আর পত্রপত্রিকাগুলো এবং টেলিভিশনের টকশোগুলোর প্রচারক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। ফলে আমরা এদিক-ওদিক চিন্তা করার সুযোগ পেলাম না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর যিনি রাখাল বালক হিসেবে ব্যাপক আলোচিত ছিলেন তিনি পড়ে গেলেন মহাবিপদে। প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত হিসেবে যিনি বলতে গেলে মন্ত্রণালয়ের মাতুব্বরী উপেক্ষা করে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী এবং তার অর্থ উপদেষ্টার পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক চালাতেন, সেই তিনি হঠাৎ বন্ধুহীন হয়ে পড়লেন। মানুষের আবেগ-বিরূপ সমালোচনা এবং জনমত উপেক্ষা করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তার প্রিয়জনকে রক্ষা করতে পারলেন না। ফলে আওয়ামী জমানায় শেখ হাসিনার সবচেয়ে দু’জন বিশ্বস্ত অনুগত এবং সম্ভাবনাময় সহযোগীর দ্বিতীয়জন ড: আতিউর পদত্যাগে বাধ্য হলেন- আর প্রথমজন ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন।

ড: আতিউরের পদত্যাগের পর বাঙালির আবেগে ভাটা পড়ল এবং আর অনেক বিষয়াদি হজম করার দুরন্ত হজমোলা বড়ির প্রভাবে লোকজন রিজার্ভ চুরির ঘটনাও হজম করে ফেলল। তারা ভাবল, এ দেশের কিচ্ছু হবে না- কেস্টর কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা কারো নেই। জাতি মহাভাগ্যবান। কারণ কেস্ট মাত্র ৮১ মিলিয়ন নিতে পেরেছে। যদি সে পুরো রিজার্ভই চুরি করে ফেলত তবে কী করার ছিল!

উল্লেখিত ঘটনার কিছু দিন পর আমার এক পরিচিত লোক আন্তর্জাতিক হ্যাকারদের কবলে পড়ে প্রায় ১৫ লাখ টাকা হারিয়ে ফেলেন। তার কম্পিউটার হ্যাক করে হ্যাকাররা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সব ব্যক্তিগত তথ্য, ই-মেল, ডোমেন ইত্যাদির দখল নিয়ে নেয় এবং প্রায় এক মাস ধরে সেই ব্যক্তির পক্ষে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ই-মেল পাঠাতে থাকে এবং তার কাছে আসা সব ই-মেলের উত্তর দিতে থাকে। আমি যার কথা বলছি তিনি একজন আইটি বিশেষজ্ঞ এবং আউটসোর্সিং করে যথেষ্ট আয় করেন। তার যে অর্থ বিদেশ থেকে সরাসরি বাংলাদেশে আসে সেই অর্থের একটি চালান হ্যাকাররা টার্গেট করে এবং অর্থ প্রেরক বার্তা পাঠায় টাকাগুলো জরুরি প্রয়োজনে বাংলাদেশের পরিবর্তে চীনের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করার জন্য। বিগত এক মাসে ই-মেল ফিল্টারিং করে হ্যাকাররা অর্থ প্রেরকের সঙ্গে এমন একটি সম্পর্ক গড়ে তোলে, যার ফলে সর্বনাশ ঘটার আগে কেউই আন্দাজ করতে পারেনি।

উল্লেখিত ঘটনা জানার পর আমি হ্যাকারদের দৌরাত্ম্য, কৌশল এবং নেটওয়ার্ক সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা লাভ করলাম এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ক্ষেত্রে কী কী ঘটেছে তাও আন্দাজ করলাম। ফলে ড: আতিউরের জন্য কিছুটা হলেও মন খারাপ হলো। কারণ আরো অনেক সবজান্তা শমসেরের আমিও সভা-সমিতি-সেমিনার-টকশোতে গিয়ে পাইকারি হারে তাকে সমালোচনা করেছি। কিন্তু পরে চিন্তা করলাম, আওয়ামী লীগের ভাগ্য তথা কপালের সঙ্গে ড: আতিউরের কপালের একটা সংযোগ নিশ্চয়ই রয়েছে। কারণ এই দলটি যতবারই ক্ষমতায় এসেছে ততবারই ব্যাংক-বীমা-শেয়ার মার্কেট অথবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হয়েছে, যার বেশির ভাগই সত্য কিন্তু কিছু ঘটনা ছিল একেবারে বানোয়াট- ডাহা মিথ্যা এবং নির্মম দেশী-বিদেশী চক্রান্তের ফসল যার তিনটি ঘটনা সংক্ষেপে আপনাদের বলব।

প্রথমটি ছিল শেখ কামাল কর্তৃক কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডাকাতির গুজব। জাসদের মুখপাত্র দৈনিক গণকণ্ঠে ঘটনাটি এমনভাবে প্রচারিত হয়েছিল, যার দায়মুক্তি আজও ঘটানো সম্ভব হয়নি। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি এবং আবুল হোসেনের সম্পৃক্তি নিয়ে দেশী মিডিয়ার হইচই, বিশ্বব্যাংকের বিরূপ আচরণ এবং সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে আবুল হোসেন কেবল মন্ত্রিত্ব হারাননি। আরেকটু হলে হয়তো গ্রেফতার হয়ে যেতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে কানাডার আদালতে প্রমাণ হয় যে কথিত ঘুষ গ্রহণের অভিপ্রায় মিথ্যা। আর তৃতীয় ঘটনা হলো, রিজার্ভ চুরির ঘটনার তদন্ত শুরুর আগেই গভর্নর ড: আতিউরের পদত্যাগ।

আজ বহুদিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা মনে এলো মূলত কয়েকটি কারণে; যার সাথে আমাদের জাতীয় স্বার্থ-স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সুনাম সুখ্যাতি জড়িত। দেশের ডলার সঙ্কট, সরকারের চরম সঙ্কোচনমূলক আমদানি নীতি, নজিরবিহীন অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, মানুষের মনে প্রবল সরকারবিরোধী ঘৃণা, আওয়ামী বিদ্বেষ, সামাজিক বিসংবাদ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধুহীনতা, পশ্চিমা চাপ, আইএমএফের ৬৭ শর্ত, বেকার সমস্যা, ব্যবসা বাণিজ্যে দেউলিয়াত্ব ইত্যাদি হাজারো সমস্যার সাথে মোদির গুজরাট কেলেঙ্কারি এবং ভারতের আদানী গ্রুপের কেলেঙ্কারির সাথে তাল মিলিয়ে দেশের মূল ধারার কয়েকটি পত্র-পত্রিকা যখন পুরনো রিজার্ভ চুরি নিয়ে নতুন করে প্রচার-প্রপাগান্ডা শুরু করেছে তখন কেন জানি আমার মনে ভয় হচ্ছে যে, আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক অর্থ দানবদের রাহুগ্রাসে পড়তে যাচ্ছে।

বহুল আলোচিত রিজার্ভ চুরি যেমন নজিরবিহীন ঘটনা তার চেয়েও নজিরবিহীন ঘটনা হলো চুরি যাওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ইতোমধ্যে ১৫ মিলিয়ন ডলার ফেরত পাওয়া গেছে ফিলিপাইনের আদালতের আদেশের মাধ্যমে। বাকি অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা যখন নিশ্চিত হতে চলেছে তখন সিআইডির একটি প্রতিবেদন তৈরি এবং রিজার্ভ চুরির ঘটনার সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যোগসাজশ খুঁজে পাওয়া নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যে দুর্ঘটনা তার ঠিক ৮ বছর পর কেন ফেব্রুয়ারি মাসে সিআইডির রিপোর্ট নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে রিজার্ভ চুরির বিষয়ে মার্কিন আদালতে চলমান মামলা নিয়ে কিছু বলে নিই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকাররা ৮১ মিলিয়ন ডলার হ্যাক করে যা আমরা প্রথম জানতে পারি ফিলিপাইনের সংবাদমাধ্যম থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংক আইন মোতাবেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্টে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনসহ আরো ১৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলাটি চলতে পারে না এই দাবি করে অভিযুক্তরা পাল্টা মামলা করে যাকে আইনের ভাষায় মোসন টু ডিসমিস বলা হয়। মার্কিন ফেডারেল কোর্ট দীর্ঘ শুনানির পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে রায় দেয় এবং কোর্ট মামলাটি নিয়মিত শুনানিন জন্য নিউ ইয়র্ক কাউন্টি সুপ্রিম কোর্টে স্থানান্তর করে। বিবাদিরা নতুন কোর্টে পুনরায় মামলা খারিজের জন্য আবেদন করে যা দীর্ঘ শুনানির পর রায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে আসে।

২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের ১৩ তারিখে নিউ ইয়র্ক কাউন্টি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের নৈতিক বিজয়ের সূচনা হয় এবং রিজার্ভ চুরির মামলাটি এখন যথানিয়মে মার্কিন আদালতে চলতে আর কোনো বাধা রইল না; ফলে রিজার্ভের বাকি অর্থ ফেরত পাওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরির পাশাপাশি রিজার্ভ চুরি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে দুর্নাম বদনাম ছড়িয়ে পড়েছিল তা রুখে দেয়ার বা সুনাম ফিরে পাওয়ার অথবা কেন্দ্রীয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার একটি নজির সৃষ্টি হয়।

মার্কিন আদালতের রায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য সম্মানের এবং আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য স্বস্তিকর। আমরা যারা রিজার্ভ চুরির বিষয়ে কেস্ট বেটাই দায়ী বলে জোর চিৎকার করেছিলাম তারা যখন চুপ হয়ে যেতে শুরু করেছিলাম ঠিক তখন সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের গলার চিৎকারকে আরো শক্তি জোগাতে শুরু করেছে। পত্র-পত্রিকায় যেটা প্রকাশিত হয়েছে তার মোদ্ধাকথা হলো, সিআইডি রিজার্ভ চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত দায়বদ্ধতার অভিযোগ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, যাদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তা, একজন নির্বাহী পরিচালক। (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), একজন জিএম যিনি বর্তমানে ডিপুটি গভর্নর, চারজন যুগ্ম পরিচালক (এদের দুজন ডিজিএম), তিনজন ডিজিএম (দুইজন বর্তমানে জিএম) এবং তিনজন উপপরিচালক।

সিআইডির প্রতিবেদনটি আদালতে দাখিলের জন্য সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন এবং আজকের এই নিবন্ধ লেখার তারিখ অর্থাৎ ৮ ফেব্রুয়ারি অবধি সরকারি অনুমোদন মেলেনি। ফলে নানা রকম নতুন গুজব ক্রমেই ডালপালা বিস্তার করছে। এক দিকে মার্কিন আদালতের ইতিবাচক রায় অন্য দিকে সিআইডির প্রতিবেদনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পিকে হালদারের অর্থপাচারের সঙ্গে অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের মধ্যে চাপা উল্লাস শুরু হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরেও নানামুখী গুঞ্জন দেখা দিয়েছে যার সবকিছুই শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে বিব্রত করবে এবং ঝামেলায় ফেলে দেবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

উৎসঃ   নয়াদিগন্ত
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More