একেবারে সাদামাটা অনাড়ম্বরভাবে জীবনের ৯২টি বছর পার করে এসে ৯৩-এ পা রাখলেন বলিউড অভিনেতা দিলীপ কুমার ওরফে মহম্মদ ইউসুফ খান। বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা শুক্রবার পা রাখলেন ৯৩ বছর বয়সে। আজ শনিবার অর্থাৎ ৯৩ বছর ১ দিন বয়স হলো দিলীপ কুমারের। শুক্রবার জন্মদিনে চুপচাপ অনেকটাই নির্লিপ্তভাবেই অভিনেতার পরিবারে পালন হয়ে গেল তাঁর জন্মদিন। কিন্তু কেন? সেই রহস্যের উত্তর অবশ্য দিলীপ কুমারের স্ত্রী তথা একসময়কার ডাকসাইটে অভিনেত্রী সায়রা বানু দিয়েছেন। সায়রা বানু বলেন, ‘যখনই আমরা খুব ঘটা করে ওর জন্মদিন পালন করেছি, ঠিক তার পরের দিনই অসুস্থ হয়ে পড়েছে ও। বয়সও তো যথেষ্ট হলো। তাই শুধু শুধু ঝুঁকি নিয়ে কী লাভ!’ এ ছাড়া সম্প্রতি চেন্নাইয়ে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে যে ভয়াবহ ও মর্মান্তিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেখানে নিজের জন্মদিনের ব্যক্তিগত আনন্দকে একেবারেই জাহির করতে চাননি দিলীপ কুমার।
১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর। পাকিস্তানের পেশোয়ারে জন্মগ্রহণ করেন এই দিকপাল অভিনেতা। বিশ্ব চলচ্চিত্রের এই অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রায় ছয় দশক ধরে মাত করে রেখেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দা। তিনি অভিনয় করেছেন মোট ৬০টি ছবিতে। ভারত সরকারের তরফে তিনি পেয়েছেন পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ এবং দাদাসাহেব ফালকে সম্মান। স্বয়ং সত্যজিৎ রায় তাঁকে বলেছিলেন, তিনিই পৃথিবীর ‘মেথড অ্যাক্টিং’-এর শেষ কথা।
দিলীপ কুমার ঠিক কেমন ধরনের অভিনেতা ছিলেন তা বলতে গেলে হয়তো বলতে হয়, হলিউডে তিনি জন্মালে হয়তো গ্রেগরি পেক, গ্যারি কুপার, ওমর শরিফ কিংবা রবার্ট ডি নিরোর মতো অভিনেতাকে পেছনে ফেলে দিতে পারতেন। কিংবদন্তি এই অভিনেতা ভারতীয় সিনেমাজগতে আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৪৪ সালে। তাঁর প্রথম ছবি ছিল ‘জাওর ভাতা’। দিলীপ কুমার তাঁর সারা জীবনে প্রায় সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সেই জন্যই তাঁকে ভারতের শ্রেষ্ঠ বৈচিত্র্যময় অভিনেতাদের একজন বলা হয়। ১৯৫৫ সালে ‘দেবদাস’ ছবি থেকেই তাঁর প্রতিভার সঙ্গে পরিচয় ঘটতে শুরু করে দর্শকের। ১৯৬১ সালে নিজস্ব প্রোডাকশনে তৈরি ‘গঙ্গা যমুনা’ ছবি বক্স অফিসে রীতিমতো সাড়া জাগায়। এই ছবিতে দিলীপ কুমারের বিপরীতে নায়িকা ছিলেন বৈজয়ন্তীমালা। দিলীপ কুমার-বৈজয়ন্তীমালা জুটি তারপর একটানা সাতটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। যা আজও মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কাছে একটা রেকর্ড। দিলীপ কুমার অভিনীত ‘মুঘল-ই-আজম’ ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে তাঁর স্থান পাকা করে দেয়। ঐতিহাসিক এই ছবি নির্মিত হয় ১৯৬০ সালে। সেলিম-আনারকলির প্রেম কাহিনী নিয়ে তৈরি এই ছবিতে সেলিমের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দিলীপ কুমার, যা আজও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের তালিকায় রয়ে গেছে।
দিলীপ কুমারের অসংখ্য সিনেমার মধ্যে বাঙালি পরিচালক তপন সিনহার ছবি ‘সাগিনা মাহাতো’ ছিল অন্যতম। এই ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দিলীপ কুমার। শুধু তপন সিনহাই নন, বাঙালি পরিচালক বিমল রায়, নীতিন বোস, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় অভিনেতা ছিলেন দিলীপ কুমার। এসব পরিচালকের কাছ থেকেই দিলীপ কুমার বাংলা শিখেছিলেন এবং বাংলাটাও বলতে পারতেন ঝরঝরে। ১৯৬৩ সালে পরিচালক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পারি’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন দিলীপ কুমার। সেটাই ছিল তাঁর প্রথম বাংলা ছবি। দিলীপ কুমারের এই ছবিটাও হয়তো ভারতীয় সিনেমায় মাইলফলক হয়ে থাকবে। অনবদ্য আরেকটি ছবির নাম ‘শক্তি’। এই ছবিতে বাবার ভূমিকায় দিলীপ কুমার এবং ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন।
দিলীপ কুমার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে জোয়ার ভাটা, প্রতিমা, মিলন, জুগনু, শাহীদ, নদীয়া কে পাব, মেলা, ঘর কি ইজ্জত, অনোখা পেয়ার, শবনম, আন্দাজ, জোগান, বাবুল, আর্জু, তরানা, হলচল, দিদার, সঙ্গদিল, দাগ, আন, শিকন্ত, ফুটপাত, অমর, উড়ন খাটোলা, ইনসানিয়ত, দেবদাস, আজাদ, নয়া দৌড়, মুসাফির, আহুদি, পয়গাম, কোহিনুর, লিডার, দিল দিয়া দর্দ লিয়া, রাম অউর শ্যাম, সংঘর্ষ, আদমি, সাগিনা মাহাতো, গোপী, দাস্তান, অনোখা মিলন, সাগীনা, ফির কব মিলোগি, বৈরাগ, ক্রান্তি, বিধাতা, শক্তি, মজদুর, দুনিয়া, মশাল, ধরম অধিকারী, কর্মা, কানুন আপনা আপনা, ইজ্জতদার, আগ কা দরিয়া, সওদাগর, কিলা প্রভৃতি।
৯২টি বছর পেরিয়ে কেমন আছেন এই প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা? স্ত্রী সায়রা বানু জানিয়েছেন, শেষ কয়েক মাস তাঁর শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো না থাকলেও এখন ভালোই আছেন তিনি। রোজ বিকেলে হাঁটতে বের হন। সময় পেলে টিভিতে খেলা আর খবর দেখেন। ভালোবাসেন ধ্রুপদী সংগীত শুনতে। আর সময় পেলেই অন্যের ভালো চেয়ে প্রার্থনা করেন ঈশ্বরের কাছে।