[ads1]আনিকা নূর। খুব হিসেব করলে মাত্র ৪ বছর আগে অভিবাসী হয়ে সপরিবারে পাড়ি জমিয়েছেন আমেরিকায়। এই ৪ বছরে একজন মানুষে কি করতে পারে, কতদূর যেতে পারে সেটা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হতে পারে। বয়স এবং পরিবেশও হয়তো বিবেচনায় আসবে এই হিসেব করার ক্ষেত্রে। বিতর্ক হয়তো বহুদূর যাবে। কিন্তু এই ৪ বছরের মধ্যে আনিকা নূর পৌঁছে গেছেন ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে পৃথিবীর সেরা মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা পর্যন্ত। একটি রকেটে মহাকাশে পাঠিয়েছেন বাংলাদেশের পতাকাও। কেমন ছিল সে পথ, খুব সহজ? আসুন, গল্পটা আমরা আনিকা নূরের কাছ থেকেই শুনি-[ads1]
[ads2]‘ঢাকার মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরী থেকে এসএসসি শেষ করার পর ২০১২ সালে রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি দিয়ে জুলাইতে ইমিগ্রেশনে পুরো পরিবার চলে এসেছি আমেরিকায়। রেজাল্ট পাইনি তখনো। ক্যাম্পাসের স্টার স্টুডেন্ট ছিলাম। কিন্তু এইচএসসি’র রেজাল্ট খারাপ হলো। বন্ধুদের মধ্যে শুধু আমার একারই জিপিও-৫ নাই।
আমেরিকায় এসে সবকিছু নতুন ছিল। কথা বুঝতে পারতাম না। কখনো কাজ করিনি আগে-সেটার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়েছে। ৫ জনের পরিবার, বাসা ভাড়া থেকে খাবার পর্যন্ত সবকিছু আমাকেই উপার্জন করতে হয়েছে। কারণ, পরিবারের আর কারো চাকরি ছিল না। এগুলো আমাকে আরো শক্ত করেছে। দুই বছর বন্ধুদের সাথেও কথা বলিনি। এমনকি ফেসবুকেও ছিলাম না।
যখন আমেরিকায় এলাম তখন আমার বয়স ১৯। এসেই জবে ঢুকে গেছি। অড জব যাকে বলে। বাসার একমাত্র উপার্জনকারী সদস্য ছিলাম আমি। একদিকে এইচএসসি’র রেজাল্ট খারাপ, অন্যদিকে ভার্সিটি এ্যাডমিশন নিচ্ছি না। ভয়ংকর ডিপ্রেশনে ছিলাম। জিদ চেপে গেলো মনে। ভার্সিটির এ্যাডমিশনও নিলাম, সাথে ফুল-টাইম জব। এখন বলতে যেমন মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা তার চেয়ে অনেক কঠিন ছিল। হঠাৎ করেই বিয়ে ঠিক হলো, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে হলো। নিউইয়র্ক থেকে ফ্লোরিডা। এর মধ্যে SAT দিতে হলো। স্কলারশিপ নেই, লোন নিলাম হাই ইন্টারেস্ট রেটে। কারণ, কমপক্ষে ১ বছর না হলে সরকার অর্থ সহযোগিতা করে না। এর মধ্যে আমার হাজব্যান্ড এর জব হলো অন্য স্টেটে। এবার ফ্লোরিডা থেকে কলোরাডো। আমিও তখন ভয়ংকর সমস্যায়, ফান্ড নেই কিন্তু অনেক টাকা লোন হয়ে গেছে। দেখলাম স্কলারশিপ ম্যানেজ করতে হবে, না হলে পড়াশোনা বন্ধ। কিন্তু আমার এখানকার কোন সার্টিফিকেট নেই।
এবার ভলান্টারি কাজ করা শুরু করলাম। আমেরিকায় যাদের বৈধভাবে বসবাসের কাগজপত্র নেই, তাদের অংক আর ইংরেজী শেখানো শুরু করলাম। তারা আমার কথা কিছু বুঝতো না। স্প্যানিশ ডিকশনারি নিয়ে বসা লাগতো। এই কাজ দেখিয়ে আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন থেকে ১০ হাজার ডলার স্কলারশিপ পেলাম। ঐ সময় এটা অনেক বড় প্রাপ্তি ছিল। মনে হলো, আমাকে দিয়ে আরো ভালো কিছু হবে।
একদিন আমার ভার্সিটির নিউজ বোর্ডে নাসার একটা বিজ্ঞপ্তি দেখলাম। একটা প্রজেক্ট বানাতে হবে যেটা মহাকাশে যাবে। এই কাজটাতে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। একটা টিম গঠন করলাম। প্রোগ্রামিং শিখলাম, ইলেকট্রনিক্স শিখলাম নিজে নিজে। আমার ফিল্ড বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। সে হিসেবে বায়োলজি রিলেটেড কিছু করা আমার জন্য তুলনামূলক সহজ ছিল। কিন্তু কঠিন কাজ করার সিদ্ধান্ত যেহেতু নিয়েছি, সেহেতু করতেই হবে। নাসার সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো দেখা শুরু করলাম। দেখলাম ওরা ফাঙ্গি (ফাঙ্গাস) পাঠিয়েছে মহাকাশে- যেটার ৬০% সারভাইভ করেছে। আমরা এর পরবর্তী ধাপ চিন্তা করলাম। ফাঙ্গি নিজের খাবার নিজে বানাতে পারে না। আমরা ভাবলাম, ফটোসিনথেসিস করে, এমন কিছু নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করি। নাসাতে এই প্রস্তাব দিলাম। তারা এটা গ্রহণ করে বড় একটা ফান্ড দিলো। কলেজ থেকে ল্যাবরেটরীতে কাজ করার অনুমতি মিললো, যেখানে প্রফেসররা ছাড়া আর কেউ যায় না। কিন্তু সেখানে আমরা ৪ জন গিয়ে কাজ করার অনুমতি পেলাম।[ads1]
[ads2]ততদিনে আবার ক্যাম্পাস স্টার হয়ে গেছি। কলেজেই ম্যাথ টিউটরিং এর একটা চাকরি নিলাম। প্রি-এ্যালজেবরা থেকে ক্যালকুলাস 3 পড়াই। সময়গুলো ক্লাস, গবেষণা আর চাকরির মধ্যে ভাগ হয়ে গেলো। অর্থাৎ সিভি ভারী করা চেষ্টা চলতে লাগলো। ৪ মাস সময়কালের একটা গবেষণা নাসাতে পাঠালাম। ‘হট এয়ার বেলনে’ সেটা ১ লাখ ফিট দূরত্বের মহাকাশে পাঠানো হলো। একটা সার্টিফিকেট পেলাম, পেলাম আরেকটা স্কলারশিপ। নাসার ওয়েবসাইটে আমাদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলো।
‘রকঅন’ খুবই প্রতিযোগিতামূলক একটা ওয়ার্কশপ। ভবিষ্যতে মহাকাশে কিছু করার জন্য হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এখানে। এবার পুরো আমেরিকা থেকে ৬৮ জনকে নিয়েছে ‘রকঅন’ ওয়ার্কশপে। সেখানে ফ্যাকাল্টি আছে, স্টুডেন্ট আছে, ইঞ্জিনিয়াররা আছে। তবে স্টুডেন্ট হিসেবে চান্স পাওয়া খুব কঠিন। আমার টিমের ৪ জন থেকে আমি একাই চান্স পেয়েছি। নাসার ফ্যাকাল্টিতে রেখেছে আমাদের। তাদের সব কাজ দেখিয়েছে। রেঞ্জ কন্ট্রোল থেকে মহাকাশ যান পাঠানো পর্যন্ত। সেখানে নাসার বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের প্রেজেন্টেশন ছিল।[ads1]
[ads2]‘রকঅন’ এর কর্মশালায় টিমের সদস্যদের কাউকে আমি আগে চিনতাম না। ৬ জনের টিমে আমি একমাত্র মেয়ে ছিলাম। ওরা এক মূহুর্তের জন্য আমাকে অসম্মান করেনি। আসার পথে বিমানবন্দরে ভিন্ন চোখে তাকিয়েছে মানুষ। যে নিরাপত্তা তল্লাশি অন্যদের জন্য একবার হয়, আমাকে সেটা ৩ বার করেছে। এমনকি আলাদা একটা ঘরে নিয়ে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষা করেছে ২ জন অফিসার। ওরলান্ডোর ঘটনার পর অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা এগুলো। কিন্তু খুব অপমানজনক ছিল। শেষ পর্যন্ত ওদের শীর্ষ কর্মকর্তা এসে সরি বলে গেছে।
টিমে একজন আফ্রিকান ছিল, ইউক্রেনিয়ান ছিল একজন, ইন্ডিয়ান ছিল একজন আর আমি। এছাড়া বাকি সবাই আমেরিকান হোয়াইট। মেক্সিক্যান ২/৩ জন ছিল। কিন্তু তাদের জন্ম আমেরিকাতেই। সত্যি বলতে কি, এই কাজ করতে গিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হলো তাতে মনে হচ্ছে, তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে গেলে আমাদের আরো ৩ গুণ বেশি চেষ্টা করতে হবে। কারণ, এমনিতেই অভিবাসীদের জন্য অনেক কিছু কঠিন। আর ধর্মপ্রাণ মুসলিম হলে আরো কঠিন। একটু ভুল করলেই বিশাল ড্রামা শুরু হয়।
আমাদের কাজ ছিল সাউন্ডিং রকেট এর জন্য কিছু যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করা। এর জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করেছে নাসা। এটা ৭ দিনের একটা ওয়ার্কশপ ছিল। কিন্তু এটা অনেক কঠিন ছিল। কারণ, আমরা জানতাম না যে, কি করতে হবে। সবচেয়ে অবাক করা মূহুর্ত ছিল যখন তারা বললো যে, আমরা রকেট বানানো দেখবো এবং রকেটের বডিতে স্বাক্ষর করতে পারবো। আসলে খুবই মূল্যবান মূহুর্ত এটা। আরো চমক অপেক্ষায় ছিল। রকেটে ১১ গ্রাম ওজনের মধ্যে কোন স্মারক (স্যুভেনির) পাঠানোর অনুমতি দেয়া হলো আমাকে। বাংলাদেশের একটা ফ্ল্যাগ দিলাম, আমেরিকার একটা ফ্ল্যাগ দিলাম আর পরিবারের একটা ছবি।
২৪ জুন-সকাল ৬:০৫ টা।
আটলান্টিকের ঠিক পাশে রকেট উৎক্ষেপন করা হয়েছে। ১৫০০ ফুট দূর থেকে আমরা সেটা দাঁড়িয়ে দেখেছি। মহাকাশে প্রায় ৬ লাখ ফুট দূরত্বে পাঠানো হয়েছে রকেটটি। ঠিক সিনেমায় দেখা দৃশ্যের মতো। কিন্তু সেটা আমার সামনে হয়েছে। অসাধারণ টিম ছিল আমার। মাত্র ১০ সেকেন্ড আমরা দেখতে পেরেছি রকেটটা। এটা আমার জীবনের সেটা ১০ সেকেন্ড। নাসা এখন আমার কাছে ঘোরের মতো হয়ে গেছে। নাসার লোগোওয়ালা এত জিনিস এখন আমার কাছে যে, পরিচিতরা দুষ্টমি করে বলে- নাসার উচিত ওদের বিজ্ঞাপন করার জন্য আমাকে টাকা দেয়া। উৎক্ষেপন করা রকেট আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সেখানকার সব ডাটা কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের দেয়া হয়েছে। আনন্দের ব্যাপার হলো, আমরা গবেষণা করে যা যা তৈরি করেছিলাম মহাকাশে তার সবগুলোই কাজ করেছে। নাসার একমাত্র নোবেল বিজয়ী John C Mather আমাদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।[ads1]
[ads2]মজার একটা কাজ করেছি। কয়েকজনকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত শুনিয়ে দিয়েছি। যথেষ্ট পাগলামি, যথেষ্ট মজা করেছি। বাংলাদেশের নামও শোনেনি এমন কিছু মানুষের কাছে একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে পেরেছি, এটাই আমার জন্য বিশেষ ব্যাপার ছিল। যখন রকেট উৎক্ষেপন করা হচ্ছিল তখন কেমন যে লাগছিলো! ঐটাতে আমার সিগনেচার, আমার পতাকা, আমার পরিচয়-ভাষা প্রকাশ করতে পারবো না। আমি যে রকেটের গায়ে সাক্ষর করেছি, নাসা এটা সবসময় সংরক্ষণ করবে। এমনকি এটা তাপমাত্রা বা অন্য কোনভাবে নষ্ট হবে না। এটা আমার জন্য অনেক বড় কিছু।[ads1]
[ads2]এরপর বেশ কিছু প্রজেক্ট থেকে আমাকে ডাকছে। কিন্তু কোনটার ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। এগুলোর কোন একটাতে কাজ করবো। আর আমার নিজেরও কিছু পরিকল্পনা আছে। টিনএজারদের নিয়ে কাজ করতে চাই। ওদেরকে মহাকাশ সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলার জন্য। এমন প্রোজেক্টে টাকা দেয় নাসা। আগস্ট পর্যন্ত সময় আছে। আমি যতটুকু জানি তা দিয়ে- এখনই শুরু করতে পারি। কিন্তু তারপরও ভাবনার জন্য একটু সময় নিচ্ছি। এটা কমপক্ষে এক থেকে দেড় বছরের কাজ। ভার্সিটি, চাকরি, সংসার-সবমিলিয়ে কতটা সময় বের করতে পারবো তার উপর নির্ভর করবে সিদ্ধান্ত।’
সূত্রঃ প্রবাস বার্তা