লাদেন হত্যার কাহিনী কি তাহলে মিথ্যা?

0

Ladenওসামা বিন লাদেন হত্যার মার্কিন অভিযানের গল্প কি তবে বানানো ছিল। এতোদিন এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেনি কেউ। কিন্তু এবারে এমন এক ব্যক্তি যুক্তি প্রদর্শন করে অ্যাবোটাবাদের ওই মার্কিন অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাতে সন্দেহের ভাঁজ পড়ছে অনেকের কপালে। তিনি হলেন সিমুর হার্শ। অনুসন্ধানি সাংবাদিকতা জগতে জায়ান্টদের মধ্যে একজন। ক্যারিয়ারের শুরুতে ‘মাই লাই হত্যাযজ্ঞের’ ঘটনা প্রকাশ করে সাড়া ফেলেছিলেন। ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনামে মার্কিন সেনাদের হাতে শ’ শ’ নিরস্ত্র বেসামরিক ব্যক্তি হত্যার ইতিবৃত্ত ছিল সেখানে। এরপর সামনে এনেছেন ইরাকের আবু গারিব কারাগারে মার্কিন সেনাদের হাতে বন্দিদের নির্যাতনের ঘটনা। এবারে তিনি দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা লাদেন অভিযানের আসল ঘটনা ধামাচাপা দিয়েছে। আর তার এ দাবি নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মুখপাত্র নেড প্রাইস এক বিবৃতিতে সিমুর হার্শের দাবি ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেন। সিমুর বলেছেন, ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন নেভি সিলদের অভিযানে ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার যে গল্প হোয়াইট হাউজ শুনিয়েছে সেটা লুইস ক্যারোলের লেখা রূপকথার সামিল। সিমুর হার্শ প্রবন্ধটি লিখেছেন লন্ডন রিভিউ অব বুকসে। তার একটি মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থান থাকার কারণে ওই প্রবন্ধ ব্যাপক আকর্ষণ কেড়েছে ইতোমধ্যে। লন্ডন রিভিউ অব বুকসে প্রকাশ হবার পর ওয়েবসাইটে এতো পরিমান ট্রাফিক বেড়ে যায় যে, চাপ সামলাতে না পেরে সাইটই সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। লাদেন অভিযানের সময় ওবামা প্রশাসনের কর্মকর্তারা যেসব দাবি করেছিলেন সিমুর হার্শের নতুন প্রতিবেদনে তুলে ধরা মূল যুক্তিগুলো অনেকটাই সেগুলোর পরিপন্থী। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেছেন, মার্কিন ও পাকিস্তানি কর্মকর্তারা অ্যাবোটাবাদে লাদেনের অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। লাদেনকে ধরার অভিযানে তারা একে অপরকে সহায়তা করেছেন। এরপর তারা প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার বড় ধরণের এক সম্পৃক্ত হন। আর এতে জড়িত ছিলেন উভয় রাষ্ট্রের বিভিন্নপর্যায়ের কর্মকর্তারা। সিমুর হার্শের প্রবন্ধের প্রধান দাবিগুলো মূলত একজন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তার বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে। ওই কর্মকর্তার নাম অবশ্য প্রকাশ করা হয় নি। তিনি যেসব দাবি করেছেন সেগুলো হলো:
->    ২০১১ সালে উত্তর পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে যে বাড়িতে বিন লাদেন আত্মোগোপন করে ছিলেন এবং যেখানে মার্কিন নেভি সিল অভিযান চালিয়েছিল সেখানে কোন বন্দুকযুদ্ধ হয় নি। বা সিল এজেন্টরা কোন বিপজ্জনক ও অপরিচিত স্থানেও যায়নি। বরং সেটা ছিল সাজানো যেখানে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পাঁচ বছর ধরে লাদেনকে বন্দী রেখেছিল। তারা ¯্রফে লাদেনকে সিল বাহিনীর জন্য সেখানে রেখে দেয় যারা অভিযানের দিন রাতে সেখানে হেলিকপ্টারে পৌঁছায়।
->    অভিযানে সিলদের সঙ্গে ছিল পাকিস্তানের শক্তিশালী মিলিটারি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর একজন এজেন্ট। তিনি অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়ির পুরো এলাকা ঘুরিয়ে দেখান সিল এজেন্টদের। আর সেদিন যে কয়টি গুলি ছোড়া হয়েছিল সেগুলো ছিল শুধু লাদেনকে হত্যার জন্য ছোড়া গুলি। এ ছাড়া কোন গোলাগুলি হয় নি।
->   অভিযানের পর একাধিক মার্কিন কর্মকর্তা বিবৃতি দিয়েছেন যে, সিআইএ বিন লাদেনের এক বার্তাবাহকের গতিবিধি শনাক্ত করে অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়ি পর্যন্ত। আর অবস্থাগত প্রমাণ সাপেক্ষে বিন লাদেন সেখানে আছে বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু এটা সত্যি নয়। ইসলাসাবাদে মার্কিন দূতাবাসে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তথ্য দিয়ে যায় যে, বিন লাদেন অ্যাবোটাবাদে আছে।
->    অ্যাবোটাবাদের বাড়িতে লাদেনের রক্ষণাবেক্ষণে অর্থায়ন করেছে সৌদিআরব।
->    পাকিস্তানী এক আর্মি ডাক্তার বিন লাদেনের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন যা প্রমাণ করেছিল যে লাদেন অ্যাবোটাবাদে ছিল। ওই প্রমাণ যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়া হয়েছিল। কাজেই সেখানে লাদেন ছিল কিনা তা নিয়ে অভিযানের পরে ওবামা প্রশাসনের কর্মকর্তা সেসব তথাকথিত অনিশ্চয়তার কথা বলেছেন তা মিথ্যা।
->    সিমুর হার্শের মতে সবথেকে ‘ডাহা মিথ্যা’ হলো পাকিস্তানের সবথেকে সিনিয়র দুই সামরিক নেতা- সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানি ও আইএসআই মহাপরিচালক জেনারেল আহমেদ সুজা পাশাকে অ্যাবোটাবাদে মার্কিন অভিযানের বিষয়ে আগে থেকে জানানো হয় নি।
সংক্ষেপে সিমুরের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তার শীর্ষ অনেক উপদেষ্টারা ওই অভিযানের প্রায় সবকিছু নিয়েই মিথ্যা বলেছেন। যে অভিযানের অনুমোদন দেয়াটা কিনা প্রেসিডেন্ট ওবামা অন্যতম অর্জন বলে বিবেচিত।
সিএনএন-এ লিখিত প্রতিবেদনে সংবাদ সংস্থাটির জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক পিটার বার্গেন সিমুর হার্শের যুক্তি ও দাবিগুলো খ-ন করেছেন। তিনি লিখেছেন, লাদেন অভিযান নিয়ে সিমুর হার্শের বক্তব্য আবোল তাবোল অর্থহীন কথাবার্তা। এসব দাবি অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আর সাধারণ বোধশক্তির সঙ্গে এককথায় অসঙ্গতিপূর্ণ। অ্যাটোবাদে লাদেনকে হত্যা করতে ছোড়া গুলি ছাড়া আর কোন গোলাগুলি হয় নি সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমন দাবিতে ওই মিশনে থাকা দুই সিল এজেন্ট ম্যাট বিসোনেট এবং রবার্ট ও’নেইলের ঘটনার বিবরণ উপেক্ষা করা হয়। তারা জনসমক্ষে বলেছেন যে, ওই রাতে আরও কয়েকজন নিহত হয়। এর মধ্যে লাদেনের দুই দেহরক্ষী, তার এক ছেলে, এবং এক দেহরক্ষীর স্ত্রী ছিল। তাদের বিবরণ অনেক মার্কিন কর্মকর্তার বিবরণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যারা আমার সঙ্গে বা অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। বার্গেন আরও লিখেছেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়ি গুড়িয়ে দেয়ার আগে বাইরে থেকে সেখানে যাওয়া একমাত্র ব্যক্তি ছিলাম আমি। পুরো বাড়ির অবস্থা ছিল ল-ভ-। সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ভাঙা কাচ। বাড়ির অনেকগুলো স্থানে ছিল অনেক গুলির চিহ্ন। যেসব স্থানে বিন লাদেনের সহচর আর পরিবারকে উদ্দেশ্য করে গুলি করেছিল সিল সদস্যরা। আর একটি ক্ষেত্রে গুলি বিনিময় হয়েছিল তার একজন দেহরক্ষীর সঙ্গে। ঘটনাস্থল থেকে প্রমাণ মেলে, লাদেন হত্যার রাতে অনেক গুলি ছোড়া হয়েছিল। সাধারণ বোধশক্তি থেকে যে কেউ বুঝবে যে অ্যাবোটাবাদে থাকাকালীন বিন লাদেনের খরচ সৌদি আরব বহন করেছে এমন ধারণা হাস্যকর। লাদেনের মূল লক্ষ্য ছিল সৌদি রাজ পরিবারকে উৎখাত করা যে কারণে ১৯৯৪ সালে তার সৌদি নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল। সৌদি আরব তাদের সবথেকে বড় শত্রুর খরচ কেন বহন করবে? সাধারণ ধারণা থেকে এও বোঝা যায়, লাদেন যদি পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী থাকতো আর মার্কিন সরকার যদি সেটা জানতো তাহলে দু’দেশের সবথেকে সহজ উপায় হতো মার্কিনীদের হাতে গোপনে লাদেনকে হস্তান্তর করা। পাকিস্তানে মার্কিন সেনা অভিযান চালানো নয়। পাকিস্তানীরা এর আগে একাধিকবার কয়েকজন আল কায়েদা নেতাকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ৯/১১ এর অপারেশনাল কমান্ডার খালিদ শেখ মোহাম্মদ ও অপর গুরুত্বপূর্ণ আল কায়েদা নেতা আবু ফারাজ আল লিবি। এমন আরও কিছু পাল্টা যুক্তি তুলে ধরে পিটার বার্গেন প্রশ্ন করেছেন কেন ওই ঘটনা ধামা চাপা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। বার্গেন আরও লিখেছেন, সিমুর হার্শ তার ১০হাজার শব্দের লেখায় সূত্র হিসেবে একমাত্র যে ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন তিসি আসাদ দুররানী। যিনি ৯০ এর দশকের শুরুতে আইএসআই প্রধান ছিলেন। লাদেন অভিযান হবার প্রায় দু দশক আগে। সিমুর দুররানীকে তার নানা যুক্তির প্রতি সহমত বলে তুলে ধরেন। তার লেখা পড়ার পর আমি দুররানিকে ইমেইল করেছিলাম। দুররানি বলেছেন, লাদেন অ্যাবোটাবাদে লুকিয়ে ছিল আর সে বিষয়টি আএসআই জানতো তেমন কোন প্রকার তথ্যপ্রমাণ নেই। কিন্তু তারপরও তিনি এ ধারণা করতে পারেন যে এর সম্ভাবনা থাকতে পারে। এটা সিমুরের দাবির পক্ষে জোরালো কোন সমর্থন নয়। প্রতিবেদনে শেষে বার্গেন লিখেছেন, নিশ্চিতভাবে সব ধরণের বিষয়ই সম্ভব। কিন্তু সাংবাদিকতা এবং ইতিহাস রচনা ক্ষেত্রে তথ্যপ্রমাণকে দেখা হয় সম্ভাবনাকে নয়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More