ঢাকা: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার শুরু এ বছরের প্রথম থেকেই। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এ সহিংসতা বেড়েছে বহুগুনে। তার সাথে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় এবং কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর জামায়াত-শিবিরের বেপরোয়া হয়ে ওঠা এ সহিংসতাকে আরো ভয়াবহ রূপ দিয়েছে।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের কঠোর কর্মসূচি এবং পুলিশের সঙ্গে জামায়ত-শিবিরের সংঘর্ষ, দেশব্যাপী নাশকতা, বাসসহ যাত্রীবাহী যানবাহনে পেট্রোলবোমা হামলাসহ নানা সহিংসতায় গত ২৯ দিনে প্রাণ হারিয়েছে ১১১ জন। আহত হয়েছে সহস্রাধিক। নিহতদের মধ্যে যেমন রয়েছে রাজনৈতিক কর্মী তেমনি রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সাধারণ মানুষ। গত এক মাসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪ জন মানুষ এ রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হয়েছে যাদের মধ্যে বেশিরভাগেই সাধারণ নিরীহ জনগণ।
২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিনই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ৭২ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দেয়। শুরু হয় দেশব্যাপী নাশকতা। এর পর একের পর অবরোধের ডাক দেয় ১৮ দল। এসব অবরোধে বেশি তৎপর জামায়াত-শিবির। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে রাজধানীতে অবরোধের তেমন উত্তাপ না থাকলেও ঢাকার বাইরে বেশ জোরালোভাবেই অবরোধ চলছে। রাজধানীতে বিএনপি নেতাকর্মীরা সক্রিয় না হলেও তৃণমূল বেশ তৎপর। অবরোধ চলাকালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের অনেক নেতা হতাহত হয়েছেন। তবে সব জায়গায় সহিংসতার অগ্রভাবে দেখা যাচ্ছে জামায়াত-শিবির।
৭২ ঘণ্টার অবরোধের প্রথম দিন ২৬ নভেম্বর নিহত হয়েছে যান ৯ জন এবং দ্বিতীয় দিন ৯ জন, তৃতীয় দিন ৪ জন এবং শেষ দিন ৪ জন। দ্বিতীয় দফার অবরোধের দ্বিতীয় দিন ১ ডিসেম্বর ৩ জন, ২ ডিসেম্বর ৪ জন, ৩ ডিসেম্বর ৯ জন নিহত হয়, ৪ ডিসেম্বর নিহত হন ৯ জন। ৬ ডিসেম্বর অবরোধ না থাকলেও সহিংসতায় নিহত হয় ২ জন। তৃতীয় দফা অবরোধের দ্বিতীয় দিন ৮ ডিসেম্বর ৩ জন, ৯ ডিসেম্বর ৪ জন, ১০ ডিসেম্বর ১ জন।
এছাড়া ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লা ফাঁসি কার্যকর করার পরদিন থেকে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যায়। ১৩ ডিসেম্বর সংঘটিত সহিংয়তায় নিহত হয় ৭ জন, ১৪ ডিসেম্বর ১১ জন, ১৫ ডিসেম্বর মারা যান আরো ৮ জন এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসেও নিহত হয় ২ জন। এর মধ্যে ফের ৭২ ঘণ্টার অবরোধ দেয় ১৮ দল। চতুর্থ দফার এ অবরোধের প্রথম দিন ১৭ ডিসেম্বর ১ জন এবং বাকি দুই দিন নিহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে পঞ্চম দফা অবরোধের প্রথম দিন ২০ ডিসেম্বর ১ জন, ২২ ডিসেম্বর ১ জন নিহত। এছাড়া ২৪ ডিসেম্বর অবরোধের শেষ দিন সাতক্ষীরায় পুলিশের ছোড়া গুলিতে এক ভ্যানচালক নিহত হয়।
অন্যদিকে ৮ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া কুমারখালী উপজেলা বিএনপি নেতা ও পরদিন যশোর জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া ২০ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল সদর উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ও দাইন্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ফারুককে (৪৭) গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২৮ নভেম্বর সকালে নরসিংদীতে এক ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রদলের নেতারা।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, অবরোধ কর্মসূচির প্রথম দিন মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষ ছাড়াও বিভিন্ন সহিংসতায় সারাদেশে ৯ জন নিহত হয়। এদের মধ্যে কুমিল্লায় অবরোধকারীদের হামলায় এক বিজিবি সদস্যসহ ২ জন নিহত হয়। সাতক্ষীরায় যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের দুই নেতা সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হয়। এছাড়া বগুড়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন বিএনপির এক নেতা। এদিন সিরাজগঞ্জ ও বরিশালের গৌরনদীতে দু’জন পথচারী মারা যান। এছাড়া ফেনীতে ককটেল বিস্ফোরণে দুলাল মিয়া নামে এক সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক মারা যান।
এছাড়া অবরোধের দ্বিতীয় দিন বুধবার (২৭ নভেম্বর) দেশের বিভিন্ন স্থানে মারা যায় আরো ৯ জন। এদিন সাতক্ষীরায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জামায়াতের এক কর্মী এবং রাস্তা অবরোধের জন্য গাছ কাটার সময় গুঁড়ির নিচে চাপা পড়ে এক নারী নিহত হন। এছাড়া সিরাজগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয় আরো দুজন। একই দিন গাজীপুরের কালীগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংঘর্ষে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য নিহত হন। এছাড়া চট্টগ্রামের পটিয়ায় পিকেটারদের ধাওয়ায় নসিমন উল্টে চালক মারা যান। পরে ওই দিন রাতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ককটেলে এক কিশোর নিহত হয়।
২৮ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ১৯ জন দগ্ধ হয়। এতেও বেশ কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কমপক্ষে চারজন মারা যায়।
এছাড়া ৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সহিংসতায় প্রাণ হারায় আরো ৯ জন। এদের মধ্যে সাতক্ষীরায় ৩ জন, চট্টগ্রামে ২ জন, চাঁদপুরে ২ জন , নোয়াখালীতে ১ জন। এছাড়া একই দিন সীতাকুণ্ডে আরো একজন নিহত হয়।
পরদিন ৪ ডিসেম্বর (বুধবার) অবরোধ সহিংয়তায় নিহত হয় আরো ৯ জন। এর মধ্যে গাইবান্ধায় ৪ জন, সাতক্ষীরায় ১, কিশোরগঞ্জে ১ এবং ফেনীতে ১ জন। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক অগ্নিদগ্ধ মারা যান। একইদিন পুলিশে ধাওয়ায় প্রাণ হারান নবাগঞ্জের যুবদল নেতা।
অন্যদিকে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের পর যেন চলমান সহিংসতায় ঘৃতাহুতি দেয়া হয়। চলমান আন্দোলন আরো ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের পরদিন ১৩ ডিসেম্বর (শুক্রবার) অবরোধ না থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষে জামায়াত-শিবিরসহ ৭ জন নিহত হয়। এর মধ্যে নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, যশোর ও খুলনায় ৭ জন। এদের মধ্যে শিবিরের ৩ জন, আওয়ামী লীগের ২ জন, যুবদলের ১ জন রয়েছে। এছাড়া একইদিন এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও নিহত হন।
পরদিন ১৪ ডিসেম্বর (শনিবার) সারাদেশে নিহত হন ১১ জন। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় এদিন সবচেয়ে বেশি লোক মারা যায়। এদের মধ্যে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ৫ জন এবং নীলফামারীতে ৫ জন। এছাড়া সিলেটের কানাইঘাটে আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এছাড়া ১৫ ডিসেম্বর (রোববার) সারাদেশে নিহত হয় আরো ৮ জন। এদের মধ্যে লালমনিরহাটের পাটগ্রামে ৪ জন, জয়পুরহাটে ৩ জন ও লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে ১ জন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো একজন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসেও মারা যায় ২ জন।
এছাড়া সর্বশেষ মঙ্গলবার ২৪ ডিসেম্বর সাতক্ষীরায় পুলিশের গুলিতে হাফিজ নামে এক ভ্যানচালক নিহত হয়েছেন।
এ হলো কেবল গত ২৯ দিনের হতহতের ফিরিস্তি। দুই রাজনৈতিক দলে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে প্রাণ বিলাচ্ছে সাধারণ মানুষ। একপক্ষ জিদ রক্ষার জন্য সংবিধান আঁকড়ে চোখ বন্ধ করে আছে আর অন্যপক্ষ ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। এসব সহিংসতা, প্রাণহানী তাদের নজর এড়িয়ে যায় সহজেই।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আমল মজুমদার দিবার্তাকে বলেন, ‘দেশে আজ দুটো কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে- একটি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল। অন্যটি যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর করা। যারা যুদ্ধাপরাদধীর রায় মানছে না তারা দেশে সহিংসতা করছে। একইভাবে একটি শ্রেণী তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। আর এদের মোকাবিলা করছে আইনৃঙ্খলা বাহিনী।’
তার মতে, ‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে একটি ঐতিহাসিক ভুল করেছে সরকার। আজ যদি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল না করতো যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে কেউ আন্দোলন করতে পারতো না। জনগণ তাদের পুলিশের হাতে তুলে দিতো। দেশের রাজনৈতিক জটিলতা নিরসন না করলে প্রাণহানী আরো বাড়তে থাকবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করা উচিৎ।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দিবার্তাকে বলেন, ‘এর আগেও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। তবে এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। এটার মূল কারণ হলো দুই নেত্রীর বিপরীতমুখী অবস্থান। কেউ ক্ষমতা যেতে চাই, কেউ ক্ষমতায় থাকতে চায়।’
রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বন্ধের উপায় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, দুই নেত্রীর বিপরীমুখী অবস্থান থেকে সরে আসতে এবং জণগণের স্বার্থে সমঝোতায় যেতে হবে। আর সব চেয়ে বড় যে বিষয়টি হলো সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখা। যদি দেশে যদি সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা হয়, তাহলে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটবে না।’