ঢাকা: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। আর এ প্রেক্ষিতেই জুলাই মাসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, ফেনীসহ বিভিন্ন অঞ্চল টানা বৃষ্টি ও বন্যায় ডুবলেও উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট রংপুর, নীলফামারী ও দিনাজপুরে দেখা দেয় এর ভিন্ন চিত্র। অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমেও এই এলাকাগুলো পুড়েছে খরতাপে। একই দেশে প্রকৃতির সে কী ভিন্নরূপ! এছাড়া টানা বৃষ্টিতে প্রতিবছর দেশের ভূতত্ত্বেও কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটছেই।
এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম বলে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাপলক্রফট।
সম্প্রতি এ প্রতিষ্ঠানে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ১৯৬টি দেশের ওপর জরিপ চালিয়েছে ম্যাপলক্রফট। এতে দেখা যায় বিশ্বব্যাপী ৩২টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। এরপর যথাক্রমে সিয়েরালিওন ও নাইজেরিয়া।
পোল টু প্যারিস কাম্পেইনের পরিচালক ড. ড্যানিয়েল প্রাইস বলেন, ‘নিচু দেশ হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ হওয়ায় এ ঝুঁকির পরিমান আরো বেশি বলেও জানিয়েছেন তিনি।’
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ভূতাত্ত্বিক প্রভাব সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ূন আখতার বলেন, ‘টানা বৃষ্টির কারণে প্রতিবছর দেশের ভূতত্ত্বে কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটছেই। কারণ অতি বৃষ্টিতে যেমন পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটছে তেমনি সমতল ভূমিতেও ধ্বস নামছে। এছাড়া অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে উজান থেকে আবার পলি এসেও জমি উঁচু হয়। এ বছর ক্যাচমেন (ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী) এরিয়ায় অনেক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বরফ গলে যাচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে আমাদের দেশের পদ্মা ও মেঘনাসহ অন্যান্য নদীগুলোতে প্রায় ১০০ গেটাটন পানি প্রবাহিত হয়। এই পানির ভারে প্রতিবছর বাংলাদেশ রেফারেন্স প্লেন থেকে প্রায় ৬ সেন্টিমিটার নিচের দিকে নামে।’ তিন থেকে চার মাস এ অবস্থায় থাকে বলেও জানান ঢাবির এই অধ্যাপক।
এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন আর ঋতুর বিবর্তনের ধারায় এবার সময়ের আগেই চলে আসে বর্ষা। এছাড়া অন্যান্য কয়েক বছরের তুলনায় এবার টানা বৃষ্টিও হয়েছে বেশি। জুনে হঠাৎ করেই দেশের অনেক স্থানে দেখা দেয় বন্যা। চলতি বর্ষা মৌসুমে উজানের ঢলে কক্সবাজার, নেয়াখালী, মহেশখালী, বগুড়া, সারিয়াকান্দি, শেরপুর, সাতক্ষীরা, ফেনী ও হবিগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যায়। সঙ্গে টানা বৃষ্টি যুক্ত হওয়ায় প্লাবিত হয় শত শত গ্রাম। সারাদেশে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পরেন। তলিয়ে যায় লক্ষাধিক হেক্টর ফসলি জমি।
কৃষিভিত্তিক দেশ হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশে ঝুঁকি ও ক্ষতির পরিমাণ যে বেশি তার প্রমাণ করতেই যেন বন্যায় তলিয়ে গেছে এই লক্ষাধিক হেক্টর ফসলি জমি।
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হামিদুর রহমান বাংলামেইলকে বলেন, ‘বাদলা অবস্থার কারণে এবার আউশ, আমন, শাক ও মরিচসহ কয়েকটি ফসল মিলিয়ে ১ লাখ ১৭ হাজার ৮১৪ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া বীজতলাও নষ্ট হয়েছে। ৩১ জেলার মধ্যে চট্টগ্রামে ক্ষতির পরিমাণ বেশি।’ ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা লাঘব করতে সরকার আমনের চারা বিতরণ করবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ‘আগস্ট মাসের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় স্বাভাবিক বন্যা হতে পারে। বঙ্গোপসাগরে ১ থেকে ২টি মৌসুমী নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। চলতি মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শাহ আলম বাংলামেইলকে বলেন, ‘বর্ষাকাল শেষ হয়নি। তাই বৃষ্টি হবেই। আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর এই তিন মাসে কমপক্ষে ৩ থেকে ৭টি মৌসুমী নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু (বর্ষা) বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিতে পারে।’