দিনাজপুর: ‘দিনাজপুরের মানুষকে বলা হয় বাহের দেশের বা মফিজ দেশের মানুষ। কিন্তু আমার মেয়েকে বেইজ্জত করার কারণে দিনাজপুরের এমন আন্দোলন সংগ্রাম করলো যে সারা বিশ্বের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিল। পুলিশের ফাঁসি হয় এমন কথা আমি আগে কোনোদিন শুনিনি। দিনাজপুরের মানুষ একত্র হয়ে প্রতিবাদ করায় ও বিচার চাওয়ায় আমার মতো গরীবের মেয়ে ধর্ষণ ও হত্যার বিচার হয়েছে। সে সময় দিনাজপুরের মানুষসহ বিভিন্ন সংগঠন এগিয়ে আসার কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা আদালত পর্যন্ত গড়েছিল। শেষ পর্যন্ত দোষী তিন পুলিশের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এই আন্দোলন সংগ্রামে আমাকে কোনদিন একা মনে হয়নি।’
১৯৯৫ সালে পুলিশ হাতে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার ইয়াসমিনের মা ফরিদা বেগম কথাগুলো বলেন।
তিনি আরও বলেন, ‘দিনাজপুরের মানুষ পারে এবং পারে। মা-বোনের ইজ্জত রক্ষায় এ জেলার মানুষ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। সে সময়ের জেলা প্রশাসক এটিএম জব্বার ফারুক ও পুলিশ সুপার মোতালেব হোসেনের সাজা হলে আরো খুশি হতে পারতাম।’
ইয়াসমিনের মা ফরিদা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাকে সাহায্য সহযোগিতা অনেকে করেছে। তবে আমাকে একটি চাকরি দিতে চেয়েও কোনো সরকার আজও চাকরি দেয় নাই।’
২৪ আগস্ট ইয়াসমিন ট্রাজেডির ২০তম বার্ষিকী। এদিনে দেশব্যাপী পালিত হয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। আজ থেকে ২০ বছর আগে ১৯৯৫ সালের এ দিনে দিনাজপুরে একদল বিপথগামী পুলিশের হাতে তরুণী ইয়াসমিন নিমর্মভাবে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়। এ বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের মানুষ। প্রতিবাদী মানুষকে লক্ষ্য করে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। এ ঘটনায় দেশ-বিদেশের কোটি কোটি মানুষের দৃষ্টি নিবন্ধ হয় দিনাজপুরের দিকে।
দিবসটি পালনে সম্মিলিত নারী সমাজ, মহিলা পরিষদ, এমবিএসকে, এডাব ও সিডিএসহ বিভিন্ন সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করে থাকে।
এ ঘটনা মানুষের মনে এখনো নাড়া দেয় দারুণভাবে। এখনো মানুষ প্রতিবাদী প্রতীক হিসাবে ইয়াসমিন ট্রাজেডিকে তুলে ধরে। প্রতিবাদ করে বলা হয় তোমরা কি ইয়াসমিন আন্দোলনের কথা ভুলে গেছ? কিন্তু এ আন্দোলনের অনেক দাবি অপূর্ণ থেকে গেছে। ইয়াসমীন ধর্ষণ ও হত্যার বিচারে তিন পুলিশের ফাঁসি হলেও মৌলিক দাবিগুলো রয়েছে পূরণ না হওয়ার তালিকায়।
এ ব্যাপারে কথা হয় ইয়াসমিন আন্দোলনের প্রথম প্রতিবাদকারী ও আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বর্তমানে দিনাজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপালের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘সে সময়ের গণ জাগরণ সমগ্র বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিল মর্যাদা রক্ষার জন্য দিনাজপুর পারে এবং মর্যাদা রক্ষায় দিনাজপুরের মানুষ সর্বচ্চো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রন্তুত।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের আন্দোলন ছিল না। এ আন্দোলন সমগ্র দিনাজপুরবাসীর আন্দোলনে রূপ নেয়। যার কারণে সেই সময়ের সরকার বাধ্য হয়ে ৮দফা দাবি মেনে নিয়ে সরকার প্রধানের বিশেষ প্রতিনিধি এসে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়।’
প্রতি বছর দিনাজপুরে সর্বদলীয়ভাবে দিবসটিকে পালনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। প্রতিবারের মতো এবারও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-২৪ আগস্ট দিনাজপুর শহরের প্রতিটি ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাচ ধারণ ও শোকর্যালি। এছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পৃথক পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
নিহত ইয়াসমিনের মা শরীফা বেগম ২৪ আগস্ট তার বাড়িতে ফকির, মিসকিনদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ও দোয়া খায়েরের আয়োজন করেছেন।
সেদিন যা ঘটেছিল:
১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট ভোরে ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী হাছনা এন্টারপ্রাইজ নৈশ কোচের সুপার ভাইজার ইয়াসমিন নামে এক তরুণীকে দিনাজপুরের দশমাইল মোড়ে নামিয়ে দেয়। এক চায়ের দোকানদারকে বলে সকাল হলে তরুণীটিকে যেন দিনাজপুর শহরগামী বাসে উঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সেখানে পৌঁছে নৈশ্য টহল পুলিশের একটি পিকআপভ্যান। পুলিশ সদস্যরা চায়ের দোকানে বেঞ্চে বসে থাকা তরুণী ইয়াসমিনকে নানা প্রশ্ন করে এক পর্যায়ে দিনাজপুর শহরে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে জোরপূর্বক পুলিশভ্যানে তুলে নেয়। এরপর তারা দশমাইল সংলগ্ন সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ রাস্তার পাশে ফেলে রেখে চলে যায়।
এ ঘটনায় দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে দোষীদের শাস্তির দাবি করা হয়। ২৬ আগস্ট রাতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী জনতা কোতোয়ালি থানা ঘেরাও করে। ২৭ আগস্ট সকাল থেকে প্রতিবাদী মানুষরা শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। দুপুর ১২টার দিকে কয়েক হাজার জনতা বিক্ষোভ মিছিল সহকারে দোষীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি প্রদান করতে যায়। এ সময় পুলিশ বিনা উস্কানিতে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে ৭ জনকে হত্যা করে। আহত হয় প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ। শহরের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শহরে নামানো হয় বিডিআর। দিনাজপুর থেকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি ৩টি আদালতে ১শ ২৩ দিন বিচার কাজ শেষে ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মতিন মামলার রায় ঘোষণা করেন।
মামলার রায়ে আসামি পুলিশের এএসআই মঈনুল, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পুলিশের পিকআপভ্যান চালক অমৃত লাল বর্মণের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান ‘৯৫-এর ৬ (৪) ধারায় ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন। আলামত নষ্ট, সত্য গোপন ও অসহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এএসআই মঈনুলকে আরো ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
অপরদিকে, দণ্ডবিধির ২০১/৩৪ ধারায় আলামত নষ্ট, সত্য গোপন, অসহযোগিতার অভিযোগে অভিযুক্ত আসামি দিনাজপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেব, ডা. মহসীন, এসআই মাহতাব, এসআই স্বপন চক্রবর্তী, এএসআই মতিয়ার, এসআই জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের খালাস দেন।
চাঞ্চল্যকর ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় ৮ বছর পর অর্থাৎ ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
মামলার অন্যতম আসামি গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার বিশ্রামপাড়া গ্রামের জসিম উদ্দীনের ছেলে এএসআই মাইনুল ও নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার চন্দনখানা গ্রামের খতিবুর রহমানের ছেলে কনস্টেবল আব্দুস সাত্তারকে রংপুর জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ১ সেপ্টেম্বর ২০০৪ সালের রাত ১২টা ১ মিনিটে।
অপর আসামি নীলফামারী জেলার সদর উপজেলার রাজপুর গ্রামের লক্ষ্মীকান্ত বর্মণের ছেলে পিকআপ ভ্যান চালক অমৃত লাল বর্মণ রংপুর জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয় ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৪ সালের রাত ১২টা ১ মিনিটে।
বাংলামেইল২৪ডটকম