শেষ কথাটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। কিন্তু পাকিস্তান শারীরিক প্রতিবন্ধী দলের এক কর্মকর্তা যখন পাশ থেকে যোগ করেন, ‘আরে ও তো এক হাতে মোটরসাইকেলও চালায়…’, মাতলুব কোরেশির কথায় অবিশ্বাস করেন কীভাবে? এভাবেই যে লেখা হয় জীবন জয়ের গল্প।
মাতলুব কোরেশি দেখিয়েছেন, একটা হাত নিয়েও সেঞ্চুরি করা যায়বয়স তখন পাঁচ কি ছয় বছর। স্কুল ছুটির পর সামনের দোকানে ছেলেটা গেল কিছু খেতে। ফেরার পথে রাস্তা পার হওয়ার সময়ই দুর্ঘটনা। চলন্ত এক ট্রাকের প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে গেল ছেলেটি। ট্রাকের চাকা চলে গেল তার ডান হাতের ওপর দিয়ে। চিকিৎসকেরা অনেক চেষ্টা করেও ভাঙা হাড় জোড়া লাগতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত কেটেই ফেলতে হলো হাতটা।
সেই ছেলের জীবন এরপর কেমন হতে পারে? এক হাত নেই, নিশ্চয়ই অন্যের অনুকম্পায় বেঁচে আছে! কিছু করার সামর্থ্য নেই বলে নিগৃহীত সবখানে! বাস্তবে তা নয়। পাকিস্তানের মুলতানের ২৮ বছর বয়সী মাতলুব কোরেশি বরং একটা ইতিহাসের নাম। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরিটা যে তাঁরই!
শৈশবেই বদলে যাওয়া জীবনের কথা বলতে গিয়ে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে কাল কিছুটা ভারাক্রান্ত লাগল মাতলুবের কণ্ঠ, ‘ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ ছিল আমার। তবে মাত্র ৫-৬ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় আমার একটা হাত চলে যায়। স্বাভাবিক মানুষের সঙ্গে ক্রিকেট খেলাটা তাই কঠিন ছিল।’
তারপরও ১৯৯৯ বিশ্বকাপ মাতলুবের মনোজগতে আনে একটা বড় পরিবর্তন। চোখে ভাসতে থাকে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। মনের আয়নায় আদর্শ হিসেবে দাঁড় করান সাঈদ আনোয়ারকে। তাঁকে দেখেই বাঁ হাতে ব্যাটিংয়ের ইচ্ছা জাগে। কিন্তু যাঁর একটা হাত নেই, ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখা কি তাঁকে মানায়? মাতলুবের কথায় ফিরে এল শুরুর সময়ের চ্যালেঞ্জ, ‘১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর থেকেই খেলার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ি। কিন্তু তখনো পাড়া-মহল্লায় খেলতাম। আমাদের তেমন মর্যাদা ছিল না, শারীরিক প্রতিবন্ধী বলে কেউ দাম দিত না।’
শারীরিক প্রতিবন্ধীদের আলাদা ক্রিকেট শুরু হওয়ার পর বদলে যেতে থাকে চিত্র, ‘এখন আমাদের অনেক মর্যাদা দেওয়া হয়। মানুষ এখন পছন্দও করে। আগে স্বাভাবিক লোকেরা আমাকে খেলায় নিতে চাইত না। এখন নেয়।’ প্রতিবন্ধীদের ক্রিকেটটা এখন দেশে দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে বলে ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রচণ্ড আশাবাদী তিনি, ‘পাকিস্তানকে দেখে আফগানিস্তান, ভারতের পর বাংলাদেশও এ ধরনের দল গঠন করেছে। অন্যান্য দেশও এগিয়ে আসছে। এটা খুব ভালো লক্ষণ।’
মাতলুব পাকিস্তানের শারীরিক প্রতিবন্ধী দলে আছেন ২০০৭ সাল থেকে। ২০১০ সালে দলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর সফর করেছেন। তবে চমকটা দিলেন ২০১২ সালে দুবাইয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ‘ওটা ছিল আমাদের প্রথম আন্তর্জাতিক সিরিজ এবং তাতে আমি প্রথম সেঞ্চুরি করি (১১৩*)’—নিজের কীর্তির কথা বলছিলেন ইনজামাম-উল-হকের শহরের এই ক্রিকেটার।
ওই সিরিজের সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছিলেন মাতলুব। কিন্তু শুধু বাঁ হাতে ব্যাট চালিয়ে কীভাবে সম্ভব হলো তা? মাতলুবের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর অনেক সহজ, ‘মানুষের মধ্যে সাহস আর আত্মবিশ্বাস থাকলে সে কোথাও হারে না। স্বাভাবিক মানুষদের সঙ্গে খেলতেও আমার কোনো সমস্যা হয় না।’
সুত্রঃ দি ক্রিকেট গার্ডিয়ান