হোসনি দালানের চারদিকেই ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বেষ্টনী। র্যাব, পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও ছিলেন সতর্ক। এরই মাঝে দুর্বৃত্তরা ইমামবাড়ার ভেতরে শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছে। নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের কাছে আগেই এ হামলার তথ্য ছিল এবং এর ছক করা হয়েছে বগুড়ায়।
ঘটনাস্থল সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, হাজার হাজার মানুষের মিছিলে জনে জনে তল্লাশি করা সম্ভব ছিল না। দুর্বৃত্তরা হযরত হাসান-হোসেনের ভক্ত ও সমর্থকদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সুযোগমতো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত এবং স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির চক্রের কাজ।
বোমায় আহত ও প্রত্যক্ষদর্শী মনির হোসেন বলেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাজিয়া মিছিলে অংশ নিতে তিনি সপরিবারে হোসনি দালানে যান। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী সুমি, মেয়ে স্নেহা, ছেলে শিহাব ও শাশুড়ি আয়েশা। সবাই মিছিলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হোসনি দালানে তখন তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি চলছিল।
রাত আনুমানিক পৌনে ২টার দিকে হঠাৎ হোসনি দালানের ভেতরে কবরের দিক থেকে পরপর কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। শুরু হয় মানুষের ছুটোছুটি ও হুড়োহুড়ি। এ সময় সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। তারা সবাই বোমার স্প্লিন্টারে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যান। সেখান থেকে পরে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন স্থানীয়রা।
মনির বলেন, হোসনি দালানের চারপাশে ও গেইটে পুলিশ ও র্যাবের প্রচুর সদস্য নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু কাউকে তল্লাশি করতে দেখেননি। তাদেরও কেউ তল্লাশি করেননি।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী আতিকুল ইসলাম ইমন। তিনি আহত হননি। তবে ঘটনার এ দৃশ্যকে তিনি তুলনা করেন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে। তিনি বলেন, বিকট শব্দে বোমার বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে, আর সাধারণ মানুষগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়তে থাকেন। তার মতে, চার থেকে ছয়টি বোমার বিস্ফোরণ হয়েছে ঘটনাস্থলে।
বোমায় আহত ও প্রত্যক্ষদর্শী রিনা আক্তার বলেন, যখন ইমামবাড়ার ভেতরে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি চলছিল, তখন হঠাৎ পরপর তিনটি বোমার বিস্ফোরণের শব্দ পান তিনি। বোমা হামলায় তিনিও শিশুসন্তান হাসানসহ গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তিনি মনে করেন, যেখানে নারী-শিশু ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আসেন, সেখানে যারা হামলা চালিয়েছে তারা ইয়াজিদের উত্তরসূরি।
র্যাব-১০ এর অধিনায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর জানান, শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিল শুরুর পূর্ব মুহূর্তে রাত ১টা ৪৫ মিনিট থেকে ২টার মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তরা ওই মিছিলের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল নিয়ে দলে দলে হোসনি দালানে উপস্থিত হতে থাকে মানুষ। এ অবস্থায় জনে জনে তল্লাশি করাও সম্ভব ছিল না।
তিনি আরও জানান, ঘটনার পরপর রাতেই সন্দেহভাজন তিনজনকে আটক করে র্যাব ও পুলিশ। তাদের গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, তাজিয়া মিছিল কিংবা হোসনি দালান এলাকায় হামলার তথ্য ছিল তাদের কাছে। কিন্তু হোসনি দালানের ভেতরেই দুর্বৃত্তরা ঘটনা ঘটাবে সেটা তারা বুঝে ওঠতে পারেননি।
যেসব বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে সেগুলো অনেকটা গ্রেনেড সদৃশ। কিন্তু সেগুলো গ্রেনেড ছিল না। হাতে বানানো বিশেষ ধরনের শক্তিশালী বোমা ছিল। তাছাড়া কামরাঙ্গীরচর থেকে উদ্ধার হওয়া বোমাগুলোর সঙ্গে হোসনি দালান এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া অবিস্ফোরিত বোমার ধরন একই। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে যাদের গ্রেফতার করা হয় তাদের সবাই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এতেই বুঝা যায়, এগুলো তাদের কাজ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, বিশেষ ধরনের এই বোমাগুলো উপর থেকে মারা হয়নি। এগুলো দুর্বৃত্তরা কৌশলে ভিড়ের মধ্যে পেছন থেকে কৌশলে নিচের দিকে ছেড়ে দিয়েছিল। ফলে আহত ও নিহতদের সবার পায়ের দিকে বেশি স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। দু-একজন ছাড়া কেউ মাথায় আঘাত তেমন পাননি।
ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, অপরাধীরা ভেতরেই মিছিলকারীদের সঙ্গে মিশে ছিল। বাইরে থেকে এসব বোমা মারা হয়নি। হতাহতদের আলামত দেখেই এটি বুঝা যায়। এছাড়া তিনি আর কোনও বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গ সূত্র জানায়, বোমার একটি স্প্লিন্টার নিহত সাজ্জাদ হোসেন সাঞ্জুর বাম পাশ দিয়ে ঢুকে ফুসফুস ফুটো করে দিয়েছিল। যে কারণে তার মৃত্যু হয়। এছাড়া তার শরীর থেকে বোমার আরও দুটি স্প্লিন্টার বের করেন তারা। পিঠে ও পায়ে স্পিন্টার বিদ্ধ হলেও মাথায় কোনও আঘাত ছিল না।
আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী চক্র পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় না, দেশের স্থিতিশীলতা চায় না, তারাই এ কাজ করেছে। তিনি বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে জেএমবি কিংবা কোনও জঙ্গির সংশ্লিষ্টতা তারা এখনও পাননি। ঘটনার পরপরই সারাদেশের পুলিশ ও র্যাবকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আইজিপি বলেন, এ হামলার ছক আঁকা হয়েছিল বগুড়ায়। এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া শিবিরনেতা মাসুদ রানার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বগুড়া ও কামরাঙ্গীরচর থেকে আরও কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।
স্থানীয়রা জানান, বোমা হামলায় কমপক্ষে দেড়শ’ লোক আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৭৫ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বর্তমানে ১১ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। জামাল উদ্দিন (৫০) নামের একজনকে গুরুতর অবস্থায় আইসিইউতে রাখা হয়েছে। এছাড়া আরও প্রায় অর্ধশত লোককে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। নিহত সাজ্জাদ হোসেন সাঞ্জুর (১৭) লাশ ময়নাতদন্ত শেষে সকাল ৯টার দিকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন