প্রকাশক ফয়সল আরেফিন (দীপন) খুনের পর তাঁর বাবা লেখক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক যখন বলেন ‘আমি কোনো বিচার চাই না’, তখন তা এই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবাদ হয়ে ওঠে। বিচার ও বিচারহীনতা নিছক আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়, এটি রাজনীতি দ্বারাই নির্ধারিত। অবিরাম খুনের জনপদে খুনি-সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক মতাদর্শিক ও শারীরিক পৃষ্ঠপোষকতার বিষয় এই রাজনীতির সঙ্গেই জড়িত। তালেবান, আইএস, আনসারুল বা ভাড়াটে সন্ত্রাসী—যে–ই হোক না কেন, বড় শক্তির পৃষ্ঠপোষকতাই যে এগুলোর ক্ষমতার উৎস তার তথ্য-প্রমাণের কোনো অভাব নেই। দীপনের বন্ধু, আরেকজন শিক্ষক অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে অভিজিৎ খুন হয়েছিলেন বইমেলায় পুলিশের সামনে। তাঁর স্ত্রী বন্যা গুরুতর জখম হয়েছিলেন। তিনি অধ্যাপক হকের এই বক্তব্য ধরে তাঁর ফেসবুক পাতায় ‘আমিও বিচার চাই না’ বলে আরও লিখেছেন, ‘এ সরকারের কাছ থেকেও কিছু চাওয়ার নেই আমাদের। একটাই অনুরোধ তাদের কাছে, দয়া করে দিনরাত আর “আমরা সেক্যুলার পার্টি” বলে গলা ফাটিয়ে নিজেদের এনার্জি নষ্ট করবেন না।’ সন্দেহ নেই, ক্ষমতার খেলায় সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা, শৈথিল্য আর তার সঙ্গে সরকারি বিভিন্ন নেতার অসংলগ্ন কথা খুনিদের জন্য সুযোগ আর নিরাপত্তাই কেবল বাড়ায়।
বাংলাদেশ যে দ্রুতগতিতে অনিশ্চিত উল্টোযাত্রা শুরু করেছে, তার পেছনে যেসব উপাদান যুক্ত, তাকে স্থানীয় মৌলবাদ না বৈশ্বিক ফ্যাসিবাদ হিসেবে শনাক্ত করা যায় কি না, তা একটি বড় প্রশ্ন (এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি সর্বজনকথা নভেম্বর সংখ্যায়)। ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু হয় বিশ্বজুড়ে। ‘জঙ্গি’ ‘সন্ত্রাসী’ দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাস দমন’ মডেলে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশও। এই মডেলে প্রবেশের অর্থ যে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীর বর্ধিত পুনরুৎপাদন ও সন্ত্রাসের চিরস্থায়ীকরণ, তা আমরা অভিজ্ঞতা থেকেই দেখছি।
বর্তমানে জঙ্গি, ইসলামি সন্ত্রাসী বলে যে প্রচার ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ মূল ভিত্তি, তাতে বিশ্বজুড়ে তিন ধরনের ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর বা ‘সন্ত্রাসী’র দেখা পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমত, আসলেই কিছু কিছু ইসলামপন্থী গ্রুপ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে, যারা ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। এদের কেউ কেউ সন্ত্রাসী পথই সঠিক মনে করে। পশ্চিমা ব্যবস্থার তারা বিরোধিতা করে; তবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের জৈবিক বিন্যাস, তার মানুষ ও পরিবেশবিধ্বংসী ব্যবস্থা তাদের মনোযোগের বাইরে, ধর্মীয় গোষ্ঠী বিরোধিতাই তাদের মুখ্য। এ কারণে সাম্রাজ্যবাদের মূল শক্তি তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে।
দ্বিতীয়ত, আরেকটি ইসলামপন্থী ধারার নাম আমরা প্রচারণায় পাই, যারা বিভিন্ন দেশে গোয়েন্দা সংস্থার পালিত গোষ্ঠী বলে ধারণা করা যায়। বিভিন্ন সময়ে তাদের ব্যবহার করা হয়। আইএসের উদ্ভব যেমন মার্কিন-সৌদি-ইসরায়েলি কৌশলগত কার্যক্রমের ফসল। দেশে দেশে অনেক সন্ত্রাসী ঘটনায় সরকারের রহস্যজনক ভূমিকা থেকে এই যোগাযোগ পরিষ্কার হয়। এসব সন্ত্রাসী ঘটনার কোনো কূল-কিনারা করা হয় না, কিন্তু সেগুলো দেখিয়েই দেশে দেশে নতুন নতুন নিপীড়ন ও নিয়ন্ত্রণমূলক চুক্তিবিধি নীতি তৈরি হতে থাকে।
তৃতীয়ত, মিডিয়ার মাধ্যমে নির্মিত। এসব প্রচারণার মাধ্যমে আতঙ্ক তৈরি এবং নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা, সাময়িকীর, নিরাপত্তা বাণিজ্য—সবই বৈধতা পায়। আতঙ্ক এখন সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বরাজনীতি ও লুটেরা দেশীয় রাজনীতির অন্যতম অবলম্বন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সামনে এখন হাজির কমপক্ষে পাঁচ ধরনের বিপদ।
প্রথম বিপদ হলো সাম্রাজ্যবাদ। ৯০-পরবর্তী সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্বের জন্য বড় আশ্রয় বা যুক্তি কিংবা অছিলা হলো ইসলামি জঙ্গি বা সন্ত্রাসী। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পরে তার সামনে দৃশ্যমান এবং উপস্থাপন করার মতো শত্রু নেই, যাকে দেখিয়ে নিজের সব অপকর্ম সে জায়েজ করতে পারে। তাদের যে সামরিক অবকাঠামো ও বিনিয়োগ তার যৌক্তিকতা কী, যদি বড় কোনো শত্রু না থাকে? যুক্তরাষ্ট্রের মানুষকে ক্ষুধার্ত রেখে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত রেখে, বিভিন্ন বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থে, সমরাস্ত্র, যুদ্ধ, আগ্রাসনের পেছনে বিপুল ব্যয় কীভাবে যুক্তিযুক্ত হবে? সুতরাং ‘শত্রু’ বাঁচিয়ে রাখা, কোথাও না থাকলে সেখানে তৈরি করা সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য আবশ্যিক। তার হাত ধরেই তাদের অগ্রযাত্রা। বাংলাদেশ ভারতের মতো দেশগুলোর শাসকশ্রেণির এই মডেলেই অগ্রসর হচ্ছে। সে জন্য সামনে আরও বিপদের আশঙ্কা।
দ্বিতীয় বিপদ হলো, ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষ। বিশ্বজুড়ে বিদ্বেষ ছড়িয়ে বিশ্বের মুসলমান সমাজকে যেভাবে ঘা দেওয়া হচ্ছে, যেভাবে আহত করা হচ্ছে, তার প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে সম্প্রদায়গতভাবেই। এর ফলে ধর্মীয় রাজনীতির ভূমি উর্বর হচ্ছে। খুবই পরিকল্পিত ও একচেটিয়া প্রচারণার কারণে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ভারতসহ মুসলিম সংখ্যালঘু দেশগুলোতে মুসলিম নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। এই প্রবণতা অন্যান্য দেশেও মুসলমান জনগোষ্ঠীকে তার ধর্মীয় পরিচয় গুরুত্ব দেওয়ার দিকে নিয়ে দিচ্ছে। সম্প্রদায়গত জখমের অনুভূতি অনেককে ঠেলে দিচ্ছে উগ্রপন্থার দিকে। ধর্মবিশ্বাসী বা নিয়মিত ধর্ম পালনকারী নন এমন ব্যক্তিরাও হয়ে উঠছেন ধর্মীয় রাজনীতির সমর্থক। সে জন্য আমরা পশ্চিমা দেশগুলোতে, ইংলিশ মিডিয়াম প্রতিষ্ঠান বা সমাজের সচ্ছল অংশগুলোতেও ধর্মপন্থী রাজনীতির প্রভাব বাড়তে দেখছি।
তৃতীয় বিপদ, দেশের মূলধারার রাজনীতি। বাংলাদেশে বৃহৎ রাজনৈতিক দুটি দল এবং তাদের জোট রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা করে ধর্মপন্থী রাজনীতির ওপর ভর করেছে, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী, মাদ্রাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পীরদের ‘রিজার্ভ আর্মি’ হিসেবে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে গিয়ে দুই প্রধান ধারার রাজনীতি এখন এক কদর্য রূপ গ্রহণ করেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে দেশের জনস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন চুক্তি ও তৎপরতা অনেক নিরাপদ হচ্ছে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নামাবলি ব্যবহার করলেও এখন এটা স্পষ্ট যে বর্তমান সরকার বিএনপি-জামায়াতকে মোকাবিলার কৌশল হিসেবে বিভিন্ন ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতা করছে। তার সহযোগী ওলামা লীগ মৌলবাদীদের ভাষাতেই বক্তব্য দিচ্ছে। শাসকশ্রেণির এই দুই অংশের প্রতিযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা, তাদের আসা-যাওয়ার দুষ্টচক্র, অন্য বিকল্পের অভাবে, ধর্মপন্থী উগ্র অসহিষ্ণু রাজনীতি ও তাদের এজেন্ডাকেই শক্তিশালী করছে। মুক্তচিন্তা, মত প্রকাশের অধিকার এখন আইন ও আতঙ্ক দ্বারা সংকুচিত।
চতুর্থ বিপদ, ভারতে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী রাজনীতির শক্তি বৃদ্ধি। ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতার প্রসার বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতাকে উসকানি দিচ্ছে, সহায়তা করছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবাষ্প তৈরি হয়েছিল, তার রেশ তো আছেই, তার সঙ্গে ভারতের আগ্রাসী রাজনীতি ও অর্থনীতিও এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ গবেষক রোমিলা থাপার ১ নভেম্বর ভারতের প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশে সঠিকভাবেই বলেছেন, ‘উগ্র ইসলামপন্থী আইএস এবং উগ্র হিন্দুপন্থী আরএসএসের মধ্যে কোনো তফাত নেই।’
পঞ্চম বিপদ, দেশে বিপ্লবী, বামপন্থী বা জনপন্থী রাজনীতির দৈন্যদশা; আর তার সঙ্গে বিদ্বৎসমাজের বৃহৎ অংশের ক্ষমতা ও অর্থের কাছে আত্মসমর্পণ। সমাজ অর্থনীতির গতি ও বৈপরীত্য অর্থাৎ প্রাচুর্য ও দারিদ্র্য, সমৃদ্ধি ও বঞ্চনা, সম্ভাবনা ও হতাশা, নিপীড়ন ও নিরাপত্তাহীনতা, চিকিৎসাবাণিজ্য ও চিকিৎসাহীনতা ইত্যাদির গোলকধাঁধার শিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এর থেকে মুক্তির পথ খোঁজা মানুষের তাই অবিরাম তাগিদ। দেশে লুটেরা ও চোরাই কোটিপতিদের রাজনৈতিক আধিপত্যকে মোকাবিলা ও পরাজিত করার মতো রাজনৈতিক শক্তিই মানুষের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু তার অনুপস্থিতি সমাজে ভয়ংকর দিশাহীনতা, হতাশা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। পাঁচ নম্বরে উল্লেখ করলেও এটাই আসলে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। কেননা, এই বিপদ দূর হলে আগের চারটি বিপদ মোকাবিলা করা বাংলাদেশের জনগণের জন্য খুবই সম্ভব। শ্রমিক, নারী, শিক্ষার্থী, জাতীয় সম্পদ নিয়ে বিভিন্ন ছোট-বড় জনপ্রতিরোধে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
দেশে-বিদেশে এখন আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা সব ধরনের সক্রিয়তার পথ আগলে আছে। জনগণের মুক্তির লড়াই ছিন্ন ও বিচ্ছিন্ন। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বর্তমান গতি ও জাল, তার অন্তর্গত সংকটের কারণেই, কার্যত এক বৈশ্বিক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে গেছে বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষকে। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার ফ্যাসিবাদী আবহাওয়ার মধ্যে, কোথাও তার সহযোগী হিসেবে, কোথাও তার বিরোধিতা করতে গিয়ে বিভিন্ন চরিত্রের ধর্মপন্থী রাজনীতির বিস্তার ঘটছে। কিন্তু ধর্মপন্থী রাজনীতি, তার কাঠামোগত ও পরিচয়গত সীমাবদ্ধতার কারণেই বর্তমান দানবীয় বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে সব মানুষের একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই এগিয়ে নিতে কোনোভাবেই সক্ষম নয়, বরং বর্তমান ধরনে এই রাজনীতির বিস্তার দেশে দেশে মানুষের মুক্তির লড়াইকে বাধাগ্রস্ত করে বিশ্বের শোষক–নিপীড়ক যুদ্ধবাজ জালেমদের শক্তিকেই স্থায়িত্ব দিচ্ছে।
এই শৃঙ্খল থেকে দুনিয়া ও মানুষের মুক্তির জন্য দরকার ধর্ম-বর্ণ-জাতিগত গণ্ডি অতিক্রম করে মানবিক নতুন পরিচয়ে নিজেদের সংহতি দাঁড় করানো, দরকার শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়নবিরোধী ঐক্যবদ্ধ চিন্তা ও লড়াইয়ের জমিন তৈরি। তা গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া এখনো নানা বাধার মুখে, তবে নতুনভাবে নির্মিত হওয়ার লক্ষণও বিশ্বজুড়ে মাঝেমধ্যে দেখা দিচ্ছে। প্রতিকূলতা ও সংকটেই নতুন সৃষ্টির সময় আসে। আরও বেশি বেশি চিন্তা ও সক্রিয়তাই আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় একমাত্র পথ। বিদ্বৎসমাজের দায়িত্বই এখানে সবচেয়ে বেশি।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anujuniv@gmail.com
সূত্রঃ প্রথম আলো