বাংলাদেশে নারীদের গৃহস্থালির কাজের অর্থমূল্য হিসাব করা হয় না। এটা করা গেলে অর্থনীতিতে নারীর অবদান আড়ালে থেকে যেত না। উপরন্তু, জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) অনেক বেশি হতো। দেশের এক গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশেও একই অবস্থা বলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক গবেষণায় বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। কৃষি, শিল্প, উদ্যোক্তা, অফিস-আদালতসহ সব কর্মক্ষেত্রেই নারীরা কাজ করছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১০ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে এক কোটি ৬২ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে রয়েছেন। ২০০৬ সালে এই সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৩ লাখ। এর মানে, ওই চার বছরে প্রায় ৪৯ লাখ নারী শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছেন। সপ্তাহে যাঁরা এক ঘণ্টা কাজ করেন, তাঁদের নিয়ে এই হিসাব করা হয়েছে।
২০১২ সালে প্রকাশিত এই জরিপ অনুযায়ী, গৃহস্থালির কাজ করে কোনো মজুরি পান না ৯১ লাখ নারী। তাঁদের মধ্যে কেউ আছেন পরিবারের সদস্য, আবার কেউ গৃহকর্মী। আবার মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রেও নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। পুরুষের চেয়ে নারীদের কম মজুরি দেওয়া হয়।
শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আট লাখ ৪৯ হাজার নারী দিনমজুর রয়েছেন। তাঁরা পুরুষের সমান কাজ করেও মজুরি কম পান। পুরুষ দিনমজুরেরা পান গড়ে ১৮৪ টাকা, নারীরা পান ১৭০ টাকা। তবে শহরে নারী-পুরুষের মজুরির বৈষম্য কিছুটা কম। এখানে নারী-পুরুষেরা গড়ে প্রায় সমান মজুরি পান। শহরের পুরুষ দিনমজুরেরা পান ২০০ টাকা, নারীরা পান ১৯৮ টাকা। শহরে মূলত নির্মাণশ্রমিকই বেশি।
এদিকে ‘বাংলাদেশের নারীর অনুদ্ঘাটিত অবদান অনুসন্ধান: প্রতিবন্ধকতা, সম্পৃক্ততা ও সম্ভাব্যতা’ নামের গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নারীরা দৈনিক গড়ে ১৬ ঘণ্টা গৃহস্থালির কাজ করেন, যার জন্য কোনো মজুরি তাঁরা পান না। তাঁরা সব মিলিয়ে প্রতিবছর ৭৭ কোটি ১৬ ঘণ্টা কাজ করেন। এতে এ কাজের মোট অর্থমূল্য হয় ছয় হাজার ৯৮১ কোটি থেকে নয় হাজার ১০৩ কোটি ডলার। এই অর্থ যদি বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যুক্ত করা হতো, তাহলে এর আকার দ্বিগুণেরও বেশি হতো।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণাপ্রধান ফাহমিদা খাতুন এ গবেষণা করেছেন। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একজন পুরুষ যে কাজ করেন, তার ৯৮ শতাংশই জিডিপিতে যুক্ত করা হচ্ছে। আর একজন নারীর মাত্র ৪৭ শতাংশ কাজের স্বীকৃতি জিডিপিতে মিলছে। এই গবেষণার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরির কাজ এখনো চলছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে নারীর বাসাবাড়িতে রান্নাবান্না, সন্তান লালন-পালনসহ গৃহস্থালির কাজকর্মের স্বীকৃতি জিডিপিতে নেই। এই শ্রমের আর্থিক মূল্যমানও নির্ধারণ করা হয় না।
এমন প্রতিকূলতার মধ্যেও সুখবর হলো, পুরুষদের মধ্যে যেখানে বেকারত্বের হার বাড়ছে, সেখানে নারীদের বেকারত্বের হার কমেছে। ২০০৬ সালে যেখানে নারী বেকারের হার ছিল ৭ শতাংশ, ২০১০ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে। আর পুরুষের ক্ষেত্রে দশমিক ৭০ শতাংশ বেড়ে ৪ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে।
আবার যুবশক্তিতে তরুণীদের অংশগ্রহণও বেড়েছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ৪৬ লাখ তরুণী শ্রমবাজারে ছিলেন। আর ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ লাখে। আলোচ্য সময়ে তরুণীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের হার প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে তরুণ-তরুণী মিলিয়ে মোট যুবশক্তিতে রয়েছেন দুই কোটি নয় লাখ। সাধারণত ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরাই তরুণ প্রজন্ম।
সময় ব্যবহারের দিক থেকেও পুরুষদের চেয়ে নারীরা এগিয়ে রয়েছেন। বিবিএসের সময় ব্যবহার জরিপে দেখা গেছে, কর্মজীবী একজন পুরুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থের বিনিময়ে ছয় ঘণ্টা ৫৪ মিনিট কাজ করেন। আর নারীরা পাঁচ ঘণ্টা ১২ মিনিট কাজ করেন। তবে কর্মজীবী নারীরা বাসায় এসে পুরুষের চেয়ে তিন গুণ বেশি সময় কাজ করেন, যার শ্রমমূল্য নির্ধারণ করা হয় না। এ ক্ষেত্রে পুরুষ এক ঘণ্টা ২৪ মিনিট আর নারীরা তিন ঘণ্টা ৩৬ মিনিট ব্যয় করেন।
সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ যথেষ্ট বেড়েছে। ২০০৬ সালে হিসাব করা শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ২৯ শতাংশ, ২০১০ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। তবু নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি স্বীকৃত হচ্ছে না। তাঁদের বড় অংশই কাজ করেন পারিবারিক মণ্ডলে, মজুরি পান না।
রুশিদান ইসলাম মনে করেন, পুরুষদের অধিকারেই থাকে সব বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ। পুরুষের অধিকারে থাকে জমি। ঋণও পান পুরুষেরাই।
তবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, নারীর অবদান গণনায় এল কি না, সেটা বড় কথা নয়। নারীর অবদানের ফলেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন এসেছে। তাঁর মতে, শ্রমবাজারে প্রবেশ করে নারীরা অর্থনীতিতে তাঁদের প্রথম ধাপ অর্জন করেছেন।
বৈশ্বিক চিত্র: আইএমএফ গত সেপ্টেম্বরে ‘নারী, কর্ম ও অর্থনীতি’ শীর্ষক যে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, শ্রমবাজারে নারীরা পূর্ণ কর্মদক্ষতা দেখাতে পারলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাতে করে বিশ্ব জিডিপি ২৭ শতাংশ বাড়ত। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৫ শতাংশ, জাপানে ৯ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১২ শতাংশ ও মিসরে ৩৪ শতাংশ জিডিপির আকার বাড়ত।
আইএমএফ বলছে, সারা বিশ্বে ৮৬ কোটির বেশি নারী রয়েছেন, যাঁরা পুরো কর্মদক্ষতা দেখাতে পারছেন না। আশঙ্কার বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ কমছে। ২০০৫ সালে শ্রমবাজারের ৩৮ শতাংশই ছিলেন নারী। আর ২০১০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩২ শতাংশে। আর পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এই হার সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৬৩ শতাংশ নারী রয়েছেন, যা ওই সব দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের, বিশেষ করে শ্রমবাজারের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
Next Post