জুরিখের মঞ্চে ঢোকার মুখে রেড কার্পেট দিয়ে যাচ্ছিলেন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে। আশপাশে সব তারকা খেলোয়াড়দের নিয়ে সেলফি আর অটোগ্রাফ শিকারিদের কাড়াকাড়ি। কিন্তু তাঁকে আর কে ডাকবে? কেইবা চেনে তাঁকে? হঠাৎ ভিড় থেকে কেউ একজন হাঁক দিয়ে উঠল, ‘লিরা, লিরা, ওয়েন্ডেল…অটোগ্রাফ? অটোগ্রাফ?’ টিভি দর্শক হিসেবে আপনি চমকে উঠতেই পারে, এই লিরা আবার কে? তাঁরও অটোগ্রাফ নিচ্ছে লোকে! সত্যি বলতে কি, অটোগ্রাফের আবদার শুনে সবচেয়ে বেশি চমকে যাওয়া মানুষটা লিরা নিজেই!
ধন্দে পড়ারই কথা লিরার। মাত্র কমাস আগে খোদ ব্রাজিলেও খুব বেশি লোক তাঁকে চিনত না। গোইয়ানিয়ার রাজ্য দল গোইয়ানেসিয়ার মতো সাধারণ, অখ্যাত এক ক্লাবে খেলেন। এক খেলোয়াড়, যাঁকে প্রতি মৌসুম শেষে কোন ক্লাবে খেলবেন এই চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়, তাঁকে খুব বেশি লোক চেনার কথাও নয়। লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, নেইমার—তাঁর কাছেও স্বপ্নের নাম। ড্রয়িং রুমের টিভির পর্দাতেই শুধু যাঁদের দেখা মেলে। এর আগে কখনো ইউরোপেই আসা হয়নি। সেই লিরাই কাল জুরিখে মেসি-রোনালদোর পাশাপাশি! শুধু বসলেন! তীব্র প্রতিযোগিতার পর মেসিকে হারিয়ে দিয়ে বছরের সবচেয়ে সুন্দর গোলটির পুরস্কার জিতে নিলেন, যে পুরস্কার দেওয়া হয় ফেরেঙ্ক পুসকাসের মতো কিংবদন্তির নামে। সেই ফিফা পুসকাস অ্যাওয়ার্ড কাল উঠল অখ্যাত লিরার হাতে। যিনি কিনা খেলেন ব্রাজিলের তৃতীয় বিভাগে ফুটবলে। গোইয়ানিয়া থেকে জুরিখের মঞ্চ—মাত্র ১০ মাসের এই ভ্রমণের মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়েই নিজের নামটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন লিরা। কারণ লিরাকে ভোট দিয়েছে সাধারণ মানুষই।
ভোট চলেছে গতকালও। সেই ভোটাভুটি শেষ হতে সোনালি খাম থেকে বেরিয়ে এল লিরার নাম। লিরা কান্না চেপে রাখতে পারলেন না। কাঁদলেন তাঁর সঙ্গে আসা জীবনসঙ্গী। এর পর মঞ্চে গিয়ে লিরা যা বললেন, তাঁকে কাঁদলেন আরও অনেকেই! গতকাল তারকা ঝলমলে অনুষ্ঠানে সবচেয়ে জোরালো, সবচেয়ে দীর্ঘ হাততালিও কিন্তু লিরাই পেয়েছেন!
নাম বিচার করলে যুদ্ধটা ছিল ডেভিড আর গোলিয়াথের মতো। শুধু ১১ মার্চ, ২০১৫তে অ্যাটলেটিকো গোইয়ানেন্সের বিপক্ষে বৃষ্টিভেজা পিচে দুর্দান্ত ‘স্পিনিং বাইসাইকেল কিকে’ করা গোলটি ছিল লিরার পুঁজি। সেটি নিয়েই ‘বিশ্বজয়’ করলেন।
বিশ্বজয়ই তো! ব্রাজিলের লিগেও খুব বেশি শিরোপা জেতা হয়নি, ড্রয়িং রুমের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখার মতো ব্যক্তিগত অর্জনের মেডেলও প্রায় নেই বললেই চলে, তাঁর কাছে ফিফা পুসকাস অ্যাওয়ার্ডের মূল্য তো এক পৃথিবীর চেয়েও বেশি। পুরস্কার মঞ্চে কান্নাজড়িত কণ্ঠে লিরা বললেন, ‘সত্যি বলতে এটা স্বপ্নের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এত এত তারকার সঙ্গে দেখা করব, এটাই মাথা থেকে এখনো সরাতে পারছি না। আর মেসির সঙ্গে একই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়া, এরপর আবার ওর গোলকে ভোটে হারিয়ে পুরস্কার জেতা—এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’
গত নভেম্বরে সংক্ষিপ্ত দশ গোলের তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে ১৬ লাখ ভোট পড়েছে। এর মধ্যে ৪৬.৭ শতাংশের ভোটই পেয়েছেন লিরার গোলটি। প্রতিপক্ষ বক্সের বাইরে টানা দু-তিনটি পাসের পর করা ফ্লিকটি পড়েছিল দৌড়ে বক্সে ঢুকে যাওয়া লিরার একটু পেছনে। মুহূর্তের সিদ্ধান্তে বাইসাইকেল কিকে সেটিকে জালে জড়িয়ে দিয়েছিলেন লিরা। মজার ব্যাপার কি জানেন, এই গোলটির সৌভাগ্যবান প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন মাত্র ২৮৭ জন দর্শক। সেদিন যে মাঠে খেলা দেখতে ৩০০ আসনও ভরেনি!
গত মৌসুমে কোপা দেল রের ফাইনালে অ্যাটলেটিকো বিলবাওয়ের পাঁচ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে মেসির গোলটি পেয়েছে ৩৩.৩ শতাংশ। আর বার্সেলোনার বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে রোমার আলেসান্দ্রো ফ্লোরেঞ্জির প্রায় ৬০ গজ দূর থেকে করা গোলটি পেয়েছে ৭.১ শতাংশ ভোট। ‘পরাজিত’ মেসিও মেনে নিয়েছেন লিরার গোলটির শ্রেষ্ঠত্ব, ‘অসাধারণ একটা গোল ছিল, এটা ওর প্রাপ্য। পুরস্কারটা যোগ্য মানুষটিই পেয়েছে।’
আর লিরার চোখে এখনো অবিশ্বাস, ‘গোইয়ার আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে যখন গোলটি করেছিলাম, মাত্র ২৯৭ জন দর্শক ছিল মাঠে। কখনো ভাবিনি এই গোলটি এভাবে আমার জীবন বদলে দেবে!’
আসলেই বদলে দিয়েছে। তাঁকে বিশ্বের কাছে তো চিনিয়েছেই, তার চেয়েও যেটি গুরুত্বপূর্ণ—জীবন-জীবিকারও ব্যবস্থা করে দিয়েছে। গত নভেম্বরে যখন গোলটি সেরা দশের তালিকায় মনোনীত হয়েছিল, তখনো ক্লাবছাড়া ছিলেন লিরা। সাবেক ক্লাব গোইয়ানেন্স তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে। সংবাদমাধ্যমে ব্যাপারটি উঠে আসার কারণেই হোক, বা অন্য কোনো কারণে, মনোনীত হওয়ার পরের দিনই বর্তমান ক্লাব ভিলা নোভার কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলেন লিরা।
লিরার ফুটবল রূপকথার সুন্দর সমাপ্তি হয়েছে কাল জুরিখে এসে। লিরা পরিচিত হলেন ফুটবল বিশ্বের সঙ্গে, ফুটবল বিশ্ব চিনল লিরাকে। অবিশ্বাসের সুরে লিরা যখন বললেন, ‘মনে হচ্ছে যেন সবকিছু আগে থেকেই কেউ একজন লিখে রেখেছিল’, দুনিয়ার তাবৎ স্বপ্নচারী মানুষের কাছে সেটি হয়তো একটা প্রেরণা হয়েই পৌঁছেছে—জীবন এভাবেও বদলায়!