নগ্নতা কোন শিল্পই নয় বড় মাপের বাণিজ্য

0

13917_symbolপ্রকৃতির নিয়মে পৃথিবীতে মানুষ নগ্ন হয়েই আসে। মানুষ তার জন্মলগ্নের নগ্নতা এড়াতে পারে না। এটা অনিবার্য। তাই বলে মানুষ ‘জন্ম থেকেই নগ্ন’ এ কথা বলা যায় না। পোশাকের আবরণে ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে ঢাকা পড়ে যায় প্রথম জন্মদিনের শারীরিক নগ্নতা। ছোট্ট শিশু যতই পরিণত হতে থাকে, নগ্নতাও ততটা ঢাকা পড়ে যেতে থাকে। তবে মানবসমাজ পুরোপুরি নগ্নতামুক্ত নয়। পরিণত বয়সের নগ্নতা প্রদর্শন একদিকে যেমন নেতিবাচক ও নিন্দনীয়- অন্যদিকে তেমন আকর্ষণীয় ও ‘লাভজনক’। নগ্নতার প্রতি মানুষের চিরন্তন আগ্রহ ও আকর্ষণের কারণে শোবিজের সঙ্গে এটা যেন ‘বাই ডিফল্ট’ একটা ব্যাপার। এখানে নগ্নতা শুধু ‘শিল্প’ই নয়, খুব বড় মাপের বাণিজ্যও বটে।
পাশের দেশের একসময়ের টিভি অভিনেত্রী পাউলি দাম সিনেমায় এসে শুধু নগ্ন হয়েই তার ‘দাম’ অনেক বাড়িয়ে ফেলেছেন। নগ্ন হওয়ার আগে ভাড়া বাড়িতে থাকলেও এখন তিনি নিজস্ব ফ্ল্যাটে উঠে গেছেন। সম্প্রতি একেবারে পুরোপুরি নগ্ন হয়ে শুটিংয়ের মতো ঘটনাও প্রথমবারের মতো ঘটে গেছে বাংলা ছবিতে। মৈনাক ভৌমিকের নতুন ছবি ‘টেক ওয়ান’-এ স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে শরীরের সামনের অংশ নির্দ্বিধায় উন্মোচন করেছেন ক্যামেরার সামনে। তবে এসবই হয়েছে নাকি শুধু কাহিনীর প্রয়োজনে। ছবিটি তৈরি হয়েছে স্বস্তিকার নগ্ন দৃশ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার কাহিনীকে ঘিরেই।
আরেক খবরে প্রকাশিত হয়েছে, হলিউড অভিনেত্রীদের মধ্যে সফলতা ও জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে থাকা ক্যামেরন ডায়াজ এখন শুটিং করছেন নীল জনসনের পরিচালনার একটি ছবিতে। এখানে তাকে দেখা যাবে একজন শো গার্ল চরিত্রে, যে কিনা মনোরঞ্জন করেন পুরুষদের। এ ছবির একটি দৃশ্যের জন্য সম্প্রতি দুই ঘণ্টাব্যাপী অদ্ভুত এক মহড়া হয়েছে। সেটি হচ্ছে কাপড় খোলার মহড়া। ছবির একটি দৃশ্যে শো গার্লদের পারফরম্যান্স দেখানো হবে। আর তা দেখানোর জন্য ডায়াজসহ ১০০ নৃত্যশিল্পী একসঙ্গে একে একে নিজেদের পরনের কাপড় খোলেন, এমন দৃশ্য চিত্রায়ণ করা হবে। এ দৃশ্যটি ছবিটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই এর মহড়ার আয়োজন করেন পরিচালক। ডায়াজ নিজেও বলেন এটা করা হয়েছে একদমই চরিত্রের প্রয়োজনে, কাহিনীর প্রয়োজনে। অন্যভাবে দেখার উপায় নেই।
আসলে প্রকৃতপক্ষে শোবিজ-এ সৃজনশীলতার ঘাটতি পূরণে কিংবা বিকল্প হিসেবে নগ্নতা দিয়েও এখন একই সঙ্গে প্রডাকশন হাউজের ও দর্শক চাহিদার অনেক কিছু পূরণ করে তোলা হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী এখন নগ্নতা ও নগ্নতা সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের আর্থিক দিকটা অনেক বড়। নগ্নতা বন্ধ হলে কয়েকটি দেশের কিংবা শহরের ট্যুরিজম ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়বে। যে কোন আইনে নগ্নতা ও নগ্নতাকেন্দ্রিক সব কিছু নিষিদ্ধ হলে পৃথিবীতে কত হাজার কোটি ডলারের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে তা বলা কঠিন। তবে এরূপ হলে থাইল্যান্ড, লাটভিয়া ও কোস্টারিকাসহ অনেক দেশের জিডিপি কমে যাবে, অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং কয়েক মিলিয়ন মানুষ পথে বসবে। নগ্নতা এখন মাল্টি-বিলিয়ন ডলার ইনাডাস্টরি।
নগ্নতার জয়জয়কার এ সময়ে এর ব্যাপ্তি এখন এতটাই বেড়ে গেছে, এটা বন্ধ হলে উচ্চশিক্ষাও প্রভাবিত বা বাধাগ্রস্ত হবে। সম্প্রতি খবরে প্রকাশিত হয়েছে, বৃটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রী শিক্ষা খরচ মেটানোর জন্য ‘নীল পথ’ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তারা অনেকেই নীল ছবিতে অংশ নিয়ে শিক্ষাব্যয় মেটানোর চেষ্টা করছে। সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বৃটেনের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, নগ্ন নৃত্য ক্লাবের এক-তৃতীয়াংশের বেশি সদস্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই উচ্চশিক্ষার খরচ মেটানোর জন্য অনেকে নগ্ন নৃত্যের চর্চা করা শুরু করে যাতে প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করা সহজ হয়।
তবে এসব শারীরিক নগ্নতা ছাড়াও আমাদের সমাজে ও রাজনীতিতেও বিভিন্নমুখী নগ্নতা রয়েছে। নগ্ন হামলা, নগ্ন হস্তক্ষেপ, নগ্ন আচরণ এসবই শরীরের বাইরের নগ্নতা বা নির্লজ্জতার পরিভাষা। প্রকৃতপক্ষে সব ধরনের নগ্নতার সঙ্গে মিশে থাকে নির্লজ্জতা। মেঘের সঙ্গে বৃষ্টির মতোই। তবে মজার ব্যাপার, যে উলঙ্গ হয় তার এ বোধ থাকে না। কারণ উলঙ্গতা ও নির্লজ্জতা সব সময় সহাবস্থান করে। একই সঙ্গে একই মানুষ প্রকাশ্যে উলঙ্গ ও লজ্জাবোধসম্পন্ন হতে পারে না। তবে নগ্নতার প্রধান উপাদান নির্লজ্জতা নয়, প্রাপ্তি বা লোভই মূল বিষয়। রাজনীতিতে যত ধরনের নগ্নতা সব কিছুর পেছনেই রয়েছে ক্ষমতা ও অর্থ। প্রেসিডেন্ট বুশ পরমাণু রসদ থাকার অভিযোগে ও পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার অজুহাতে ইরাকে যে নগ্ন হামলা করেছিলেন বিবেকবান বিশ্ববাসীর কাছে তা অভিহিত হয়েছিল ‘ওয়ার ফর অয়েল’ হিসেবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন এরূপ নগ্ন আচরণের সুবর্ণ সময়। শেয়ারবাজারে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী প্রতারিত হয়ে পথে বসলেন। অথচ সেই কেলেঙ্কারির হোতাদের বিচার না করে উল্টো বিনিয়োগকারীদের ফটকাবাজ বলে আখ্যায়িত করা হলো। অন্যদিকে হলমার্কের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিকে বলা হলো ‘কিছুই না’। পদ্মা সেতুকে যিনি পদ্মাতেই ডুবিয়ে দিলেন তিনি হয়ে গেলেন দেশপ্রেমিক। অনেক মন্ত্রী-এমপির সম্পদ পাঁচ বছরে কয়েক হাজার গুণ বেড়ে যাওয়ার খবরে সারা দেশে হইচই পড়ে গেল। তবে এবারও ‘খোলামেলা’ভাবে তত্ত্ব হাজির হয়ে গেল যে ক্ষমতায় থাকলে সম্পদ বাড়ে। এভাবে সম্পদ বাড়ে বলেই মুদি দোকানের কর্মচারী কিংবা হলের টোকাইও ক্ষমতার স্পর্শে একসময় হয়ে যায় শতকোটি টাকার মালিক।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ আসনের জনগণ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলেন না এবং বাকি আসনগুলোতে কিভাবে ভোট হয়েছে তার সবই ধরা পড়েছে মিডিয়ায়। এরূপ ভোটের পর শপথ নিয়ে সরকার খুব তৃপ্তিসহকারে দেশবাসীকে গর্বের সঙ্গে জানালেন ‘এবারই প্রথম একটি নির্বাচিত সরকার আর একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলো।’ এখন প্রতিনিয়ত আমরা মিডিয়াতে দেখছি সরকারের উচ্চমহল থেকে বারবার বলা হচ্ছে, এ সরকার পাঁচ বছরের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। কাপড়হীন শরীরকে যদি আমরা উলঙ্গ বলি তাহলে ভোটহীন ‘নির্বাচিত’কে আমরা কি বলবো? ভোট ছাড়া জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়া যায় কিভাবে? আসলে এসবই হচ্ছে ক্ষমতার প্রয়োজনে। যেমন সিনেমাতে ‘সব কিছ’ু হয় শুধু কাহিনীর প্রয়োজনে !
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন বর্জন করলেন। নির্বাচন কমিশনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের চিঠি দিলেন। কাউকে লাঙ্গল প্রতীক না দেয়ার জন্যও বললেন। তারপর তিনি আচমকা অসুস্থ হওয়ায় র‌্যাব তাকে সিএমএইচএ ভর্তি করে দিল। হাসপাতালের রোগী গলফ খেলা শুরু করলেন। বলা হলো এটা চিকিৎসার অংশ। নির্বাচন হয়ে গেল। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পরও তিনিসহ কয়েকজন এমপি হয়ে গেলেন। তার দল জাতীয় পার্টি সংসদে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার গৌরব অর্জন করলো। এরশাদপতœী রওশন এখন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। তবে এ বিরোধী দলের কয়েকজন এমপি আবার সরকারেরও মন্ত্রী। সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং জাতীয় পার্টি মিলে দেশবাসীর জন্য এই যে রাজনীতিকেন্দ্রিক বিশেষ ‘শো’-এর আয়োজন করলেন তা নিশ্চয় ‘অন্যান্য’ শো-এর চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয়।
ভোটকন্যার দেশে নগ্ন হামলা ও নগ্ন হস্তক্ষেপের এক তাণ্ডব হয়ে গেল গত ২৭শে ফেব্র“য়ারির উপজেলা নির্বাচনে। ‘উৎসব, তবে কেন্দ্র দখলের’ এমন শিরোনাম হলো পত্রিকায়। কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই এবং জাল ভোটের মহোৎসব হয়েছে অনেক উপজেলায়। পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে ভোটার ২২৩৪, কিন্তু কাস্ট হয়েছে ২৪০০। শতকরা হারে তা ১০৭.৪৩। নির্বাচনে নগ্ন হামলা ও নগ্ন হস্তক্ষেপের এ এক ‘সাইড ইফেক্ট’ মাত্র। প্রকৃত ইফেক্টে এভাবে কেন্দ্র দখল করে যারা চেয়ারম্যান হয়েছেন তারা আর কয়েক দিন পরই উপজেলা চেয়ারম্যানদের জন্য বরাদ্দকৃত পাজেরো জিপে উঠে যাবেন। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো আছেই। আসলে কোন নগ্নতাই প্রাপ্তিহীন নয়। তা সে ভাড়া বাড়ি থেকে নিজস্ব ফ্ল্যাট হোক কিংবা মোটরসাইকেল থেকে পাজেরো জিপ হোক। তবে যে ‘ন্যাংটা’ হয় সে জানে না তার কি নেই। শুধু পুরনো গল্পের সেই ছোট্ট বাচ্চার মতো সবাই দেখতে পায় নগ্ন হওয়ার পরিণতিতে রাজার কি নেই এবং কি আছে কিংবা কি গেল।

লেখকঃ সাম্য শরিফ

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More