ঢাকা: অতিসম্প্রতি- চলতি বছরের ৮ মার্চ- মালয়েশিয়া থেকে চীনে যাওয়ার পথে এমএইচ৩৭০-এর বিমানটি স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল! আর এ ঘটনাটিই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে আচমকা আকাশ থেকে হারিয়ে যাওয়া বেশ কিছু বিমানের কথা। বিমানের ব্যবহার ব্যাপকতা পেতে শুরু করার পর- আলোড়ন সৃষ্টিকারী রহস্যময় কিছু অন্তর্ধানের কথা অনেকেই জানেন না। সেসব নিয়েই কিছু রহস্যকথা:
পৃথিবী প্রদক্ষিণকারিনী মেয়েটি যখন অদৃশ্য হলো
১৯৩৭ সালের ২ জুলাই-এর ঘটনা। পৃথিবী প্রদক্ষিণ করবে বলে বেরুলেন দুঃসাহসী এক নারী- নাম অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্ট। সঙ্গী হলেন ফ্রেড নুনান; দুজনেই মার্কিন নাগরিক। অ্যামিলিয়া কিন্তু একাকী আটলান্টিক পাড়ি দেয়া প্রথম নারী অভিযাত্রী। যাহোক, যথাসময়ে দুজনের ছোট বিমানটি উড়লো আকাশে। এবং প্রশান্ত মহাসাগরের হাওল্যান্ড দ্বীপের কাছে এসে স্রেফ হাওয়া গেল- ভোজবাজি যেভাবে আলোর ভেলকি দেখিয়ে হাওয়া হয়ে যায়।
অনেকে অনেক ব্যাখ্যা বের করলেন। কেউ বললেন- ফুয়েল ফুরিয়ে সাগরে নিপতিত হয়েছে তার বিমান। কেউ বললেন- তিনি রুজভেল্টের গোপন চর ছিলেন- জাপানিরা তাকে ধরে মেরে ফেলেছে। আরেক সূত্র বলে- তিনি নিউ জার্সিতে ফিরে আসেন অভিযান অসম্পূর্ণ রেখেই অতঃপর নাম পাল্টে ফেলেন, যে কারণে কেউ তার কথা জানতে পারে না। কিছু মানুষ বলেন- তারা জাপানি এক দ্বীপে বালুর কাঁকড়াদের একটি লাশকে বহন করে নিয়ে যেতে দেখেছে, যেটি অ্যামেলিয়ার লাশ না হয়ে যায়ই না।
একটি মত আছে সবার চেয়ে ভিন্ন তা হলো- অ্যামেলিয়ার কোনো খোঁজই যখন মিলছে না ফালতু কিছু কানকথা ছাড়া, সুতরাং- হতে পারে- তাকে অ্যালিয়েনরা নিয়ে গেছে!
অ্যামেলিয়ার এ ঘটনাটি ’৯৫ সালে বিখ্যাত স্টার ট্রেক ছায়াছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে।
ইংলিশ চ্যানেলের নায়ক কোথায় গেলো
১৯৪৪ সালের ১৫ ডিসেম্বরের কথা। মার্কিন বিমানবাহিনীর অত্যন্ত প্রতিভাবান বৈমানিক গ্লেন মিলার ফ্রান্স যাওয়ার পথে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করার সময় সবরকম যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
তার অন্তর্ধান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকে বলেন, তিনি আসলে বন্ধুভাবাপন্ন অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। কথাটা অদ্ভুত। ব্যাপারটা এমন- জার্মানির সেইগেনে বোমা ফেলার পরিকল্পনা ত্যাগ করে ব্রিটেনের ল্যানচেস্টার বোম্বাররা ইংলিশ চ্যানেলেই তাদের আগুনে বোমাগুলো (সংখ্যায় প্রায় ১ লাখ) ফেলে দিয়ে দেশে ফিরে যান- আর তখনই এর নীরব শিকারে পরিণত হন বন্ধুরাষ্ট্রের বৈমানিক গ্লেন। দুটো ঘটনার সময়কাল মিলে যায় বিধায় এমন হওয়ার সম্ভাবনা কেউ উড়িয়ে দেয়নি।
তবে আরেকটি- একেবারেই বিশ্বাস করতে পারেন না গ্লেনের বন্ধুরা এমন একটি খবর প্রকাশ করেন জার্মান সাংবাদিক উদো উলফোকত্তে। তার ভাষ্য হচ্ছে- গ্লেন ঠিকই ফ্রান্সে পৌঁছেছিলেন- তারপর লাফাঙ্গাপনা করতে গিয়ে প্যারিসের এক পতিতালয়ে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। কিন্তু যেহেতু তার বিমানের সন্ধান মেলেনি- এ কথা ধোপে টেকে না।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল আতঙ্কের সেই থেকে শুরু
প্রশান্ত মহাসাগরের অজানা স্থানে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কথা গণমাধ্যমের কল্যাণে প্রায় সবাই জানেন- যে রহস্যময় স্থানে একটি ত্রিভূজের বলয়ের ভেতরে ঘটতে থাকে রহস্যময় সব ঘটনা। এ ব্যাপারে অনেক বিস্তারিত আলোচনা অন্তর্জালে খুঁজলেই পাওয়া যাবে।
সেবার নিখোঁজ হলো দুই দফায়- প্রথমে ১৪ জন পরে ১৩। ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর। মার্কিন অঙ্গরাজ্য ফ্লোরিডা থেকে ৫টি যুদ্ধবিমান তরুণ প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে উড়ে গেল। প্রথম দেড় ঘণ্টা যোগাযোগ রাখতে পেরেছিল কেন্দ্রের সঙ্গে। তাদের শেষ রিপোর্ট ছিল- নিচের ভূ-ভাগ পুরোপুরি অপরিচিত ঠেকছে তাদের কাছে। এমন কেউ কখনও দেখেনি। কেমন- সে ব্যাপারে কিছু বলার আগেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হ্যাঁ- তারা আরও জানাতে পেরেছিল যে- তাদের কম্পাসগুলোর একটিও কাজ করছে না। সে দফায় নিখোঁজ হন ১৪ জন।
তাদের শেষ অবস্থানকে সূত্র ধরে খোঁজে বেরিয়ে পড়ে আরও একটি সমুদ্রবিমান। সেখানে অনুসন্ধানী ক্রু ছিলেন ১৩ জন। পূর্বসুরীদের যাত্রাপথ অনুসারে এগিয়ে তারাও নিখোঁজ হন। আর কোনদিন খোঁজ মেলেনি তাদের।
STENDEC- এর মানে কী- কেউ বের করতে পারেনি
১৯৪৭ সালের ২ আগাস্ট ব্রিটিশ-সাউথ আমেরিকা এয়ারওয়েজের এক হতভাগ্য বিমানচালক রেজিনাল্ড কুকের কথা। ৫০ বছর পর দুজন আর্জেন্টাইন পর্বতারোহী কুকের জামার কিছু অংশ আর তার বিমানের ইঞ্জিনের ভাঙা টুকরো আবিষ্কার করেন বলে দাবি করেন। তবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
যাহোক। কুক তার বিমান নিয়ে আর্জেন্টিনার বুয়েন্স এইরেস থেকে চিলির সান্তিয়াগোর দিকে যাত্রা করেন এক ঝকঝকে সকালে। ধারণা করা হয় তার বিমানটি তখন আন্দিজ পর্বতমালা পেরিয়ে যাচ্ছিল। কেন্দ্রে একটি দুর্বোধ্য বেতার সংকেত আসে কুকের কাছ থেকে- তারপর সব শেষ। সংকেতটি ছিল- STENDEC।
এর অর্থ কী হতে পারে সে ব্যাপারে চলেছে বিস্তর গবেষণা। কিন্তু পৃথিবীর বিমান চালনার নথিপত্রে যে সংকেত নেই আদৌ- তার অর্থ কী করা যেতে পারে?
আবার বারমুডার সেই কুখ্যাত ত্রিভূজ
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের দ্বিতীয় শিকার এবার পূর্ববর্ণিত ব্রিটিশ-সাউথ আমেরিকা এয়ারওয়েজের বিমান- ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারির ঘটনা। বিমানের নাম স্টার টাইগার। বিমানের যাত্রীসংখ্যা ছিল ২৫ এবং তাদের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিখ্যাত এক যোদ্ধা- অনেকেই নাম জানেন তার- স্যার আর্থার কনিংহাম।
স্টার টাইগার সামনে ল্যানচেস্টারের এক বিমানকে রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল পর্তুগালের স্বায়ত্তশাসিত আজোরস থেকে বারমুডার দিকে। ল্যানচেস্টার বিমানটির উদ্দেশ্য ছিল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করতে করতে এগিয়ে যাওয়া যাতে কানিংহামদের বিমানটি নিরাপদে পৌঁছুতে পারে। প্রশান্ত মহাসাগরের সেই অনির্ণেয় পরাবাস্তব অঞ্চল বারমুডার কুখ্যাত সেই ত্রিভূজের কোনো কোণ ঘেঁষেই হয়তো গিয়ে থাকবে স্টার টাইগার বিমানটি- কে জানে। ল্যানচেস্টারের বিমানটি ঠিক ঠিক পৌঁছুলো বারমুডায়- কিন্তু স্টার টাইগার আর কোনদিন পৌঁছুল না।
এগুলো ছাড়াও রয়েছে আরও বেশ কিছু ঘটনা- যেগুলোর কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি অনুসন্ধানী মানুষ। হতে পারে- এমন অনেক ঘটনাই আরও অপেক্ষায় আছে। কিন্তু আমরা চাই- এভাবে ব্যাখ্যাতীত আর কোনো প্রাণ না হারিয়ে যাক।