ঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর অব্যাহত ভাঙনের শিকার হয়ে জীবনের ওপারে চলে যাওয়ার বিষয়টি উপকূলবাসীর কাছে নতুন কিছুই নয়। হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপের মানুষগুলো প্রতিবছরের নির্দিষ্ট সময়টিতে যেন তৈরি হয়েই থাকেন মৃত্যুপুরীতে যাওয়ার জন্য। ভৌগোলিক কারণেই প্রকৃতির রামরাজত্ব চলে এখানে। তবে স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্ররোচনায় নিজেরাও আÍহননের পথ বেছে নিচ্ছেন এখানকার বাসিন্দারা। নগদে সামান্য প্রাপ্তির আশায় উপকূল রক্ষার কবচ সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং এসব বনে থাকা হরিণসহ বন্যপ্রাণী সাবার করে ফেলছেন। স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্রতিযোগিতা করে শেষ করে দিচ্ছেন বন। আর নগদ প্রাপ্তিটা বুঝে নিতে এলাকাবাসীও তাদের কাজে সহযোগিতা করছেন প্রতিযোগিতা করে। সম্প্রতি নিঝুম দ্বীপসহ হাতিয়ার বিভিন্ন চরের সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।
নিঝুমদ্বীপ হাতিয়া উপজেলার একটি ইউনিয়ন মাত্র। মূল ভূখণ্ড থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপটিকে রক্ষায় নানা কর্মসূচি রয়েছে সরকারের। এর অন্যতম হলো নতুন জেগে ওঠা চরে বনায়ন এবং সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি। বঙ্গোপসাগর ও দ্বীপটির তিনদিকে বেষ্টিত মেঘনা নদীর অববাহিকা এবং আশপাশের চরগুলোতে মাইলের পর মাইল জুড়ে সৃষ্টি করা হয়েছে বনাঞ্চল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাগরবেষ্টিত এই নিঝুমদ্বীপসহ জাহাজমারা রেঞ্জের ১১টি চরে ৪০ হাজার ৩৯০ একর ভূমিকে ‘নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যান’ বা সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করেন।
বন বিভাগের কাগজপত্রে নিঝুমদ্বীপে কেওড়া, গেওয়া, বাইন, গর্জন, ছন বনসাই, বলই, পুইনাল, করমজা, হেতাল, টাইগার, ফার্ন, বাইন, পশুর, কাকরা, কালিলতা, ঝাউ, কড়ই, মেহগিনি, শিমুল, হাতিয়ান, জাম, তেঁতুল, অর্জুন, মিম, কদম, হিজল, মান্দার, ছন, বট, সোনালু, নারিকেল, তাল, খেজুর, সুপারি, আমলকী, পেয়ারা, উরি আম, আসাম লতা গোলপাতাসহ শতাধিক প্রজাতির গাছ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে কিছু কেওড়াগাছ ছাড়া আর কোনো গাছের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
অপরদিকে বন্যপ্রাণির মধ্যে হরিণ, শিয়াল, শূকর, বন্য কুকুর, বেজি, বাঘডাশ, মেছোবাঘ, বাদুড়, চামচিকা, কাঠবিড়ালি, গুঁইসাপ, অজগর, টুনটুনি, হলদে পাখি, বাবুই, পেঁচা, বউ কথা কও, চিল, শালিক, শ্যামা, টুনটুনি, ঘুঘু, মাছরাঙ্গা, সাদা বক, ডাহুক, দোয়েল, বুলবুলি, বক, গাংচিল, কোয়াজ, কবুতর, সারসসহ অসংখ্য প্রাণী রয়েছে। কিন্তু বন উজাড়ের কারণে এসব প্রাণীর মধ্যে গুটিকয়েক প্রাণীর অস্তিত্ব টিকে রয়েছে এই দ্বীপে।
দ্বীপটির বিট কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাই এলাকার দরিদ্রদের টাকা এবং জমি দেয়ার লোভ দেখিয়ে বন উজাড় করছেন। এখানকার প্রভাবশালী সবার চোখ বনের দিকে। এদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়েছে। তবে পুলিশ এদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন না নেয়ায় বন উজাড় চলছেই।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে কেউ হরিণ শিকার করলে তার মাংসের সঙ্গে পুরস্কার হিসেবে থাকে নগদ দুই হাজার টাকা। যে কারণে অন্য কাজ ফেলে অনেকেই বনে বনে ঘোরেন হরিণ শিকারের জন্য। বন বিভাগ জানিয়েছে, চার বছর আগেই এই নিঝুম দ্বীপে চিত্রল হরিণের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজারের বেশি। এখন এর সংখ্যা নেমে এসেছে এক-চতুর্থাংশে। শুধু নিঝুমদ্বীপে নয় হাতিয়া দ্বীপের অন্য ২০টি চরের মধ্যেও একই অবস্থা। ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের জন্যও এখানে রয়েছে ধামাকা অফার। যেখানে প্রাকৃতিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করতে সরকারিভাবে লাখ লাখ একর সবুজ বেষ্টনী বা বনভূমি সৃষ্টি করা হচ্ছে সেই বনভূমির এক দাগ পরিমাণ জমির গাছ কাটলে সমপরিমাণ জমি ফ্রি পাওয়া যাচ্ছে। প্রকাশ্যেই চলছে এসব। স্থানীয় ভূমি অফিস, জনপ্রতিনিধি, বনদস্যু ও প্রভাবশালীদের হাতেই চলছে এমন কর্মকাণ্ড।
স্থানীয়দের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বনে ঢুকে। বনের ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে, বনের ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতচিহ্ন। দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার গাছের কাটা গুঁড়ি। অকারণেই বিশাল আকারের গাছের অর্ধভাগ কেটে ফেলা হয়েছে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই কাটা হয়েছে এসব গাছ।
এদিকে সামাজিক বনায়নও প্রায় ধ্বংসের পথে। গত এক বছরে জেলার সোনাপুর-সুবর্ণচর-হাতিয়া সড়কের দুই পাশের তিন শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব গাছের মধ্যে রয়েছে মেহগনি, আকাশমনি, ঝাউ, নাটাই ও কড়ই গাছ। সুবিধাভোগী, এলাকাবাসী ও বন বিভাগের অভিযোগ, স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট জোরপূর্বক এ কাজ করছে। এতে পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত নোয়াখালীর সোনাপুর-সুবর্ণচর-হাতিয়া সড়কের দুই পাশে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় কয়েক লাখ বিভিন্ন প্রজাতির বনজ গাছ রোপণ করে বন বিভাগ। এরই মধ্যে কিছু গাছের বয়স ২০ বছরের অধিক হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী তা বিক্রি করা হয়েছে, যার বড় একটি অংশ উপকারভোগীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। আর ওই স্থানে নতুন গাছও রোপণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে যেসব গাছের বয়স ১৫-১৬ বছর, সেগুলো স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় উপকারভোগীরা।
Prev Post
Next Post