১৯৮৭ সালে ক্ষতিগ্রস্থ হিসেবে রাজউক থেকে বাড্ডা এলাকায় প্লট পাওয়ার কথা ছিল। তৎকালীন সময়ে সরকার জমি অধিগ্রহণ করে নিয়ে রাউজক থেকে আড়াই কাঠা প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু ২৮ বছর পার হলেও রাজউক প্লট বুঝিয়ে দেয়নি। আমার শ্বশুর ওই প্লটের জন্য রাজউকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে মারা গেছেন। এখন ওয়ারিশরাও কি বঞ্চিত হবেন ? দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ প্রকাশ করে এমন প্রশ্ন করেন গণশুনানিতে অংশ নেওয়া বাড্ডা অঞ্চলের বাসিন্দা মো. শহিদুল্লাহ।
এ সময় রাউজকের পক্ষে উপ-পরিচালক ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, বাড্ডা এলাকায় ঢাকা ডিসি অফিসের সঙ্গে রাজউকের জমি নিয়ে কিছু ঝামেলা থাকার কারণে রাজউক এখনও ওই এলাকার জমি বুঝে পায়নি। অপেক্ষা করুন। শিগগিরই প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
রাজউকের সেবা নিয়ে গণশুনানিতে এসে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সেবাবঞ্চিত সাধারণ জনগণ। বিভিন্ন সমস্য নিয়ে সমস্যা নিয়ে বছরের পর বছর রাজউকে ঘুরেছেন তারা। কর্মকর্তাদের কথা বলতে চাইলেই কেউ কথা বলেননা। তবে চাহিদা অনুযায়ী অর্থ দিলে কর্মকর্তারাও কথা বলেন।
বুধবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে দিনব্যাপী দুদকের গণশুনানি অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। বক্তব্য রাখেন দুদকের চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান, রাজউকের চেয়্যারম্যান জি এম জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া, দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, কমিশনার (অনুসন্ধান) নাসিরউদ্দীন আহমেদ, সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল, মহাপরিচালক জিয়াউদ্দীন আহমেদ, মহাপরিচালক ড. মো. শামসুল আরেফিন, ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক মো. নাসিম আনোয়ার প্রমুখ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, রাজউক কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে প্ল্যান করে। কিন্তু দেখা যায়, প্রতিটি বিল্ডিংয়ে তা ঠিকঠাক প্রয়োগ হচ্ছে না। প্রতিটি বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রেই তো রাজউক ফিতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। এক্ষেত্রে নাগরিকদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর গণশুনানির কার্য্যক্রম শুরু হয়। এতে মূলমঞ্চের বামদিকে বসেন ভুক্তভোগী জনগণ। ডানপাশে ছিলেন রাজউকের কর্মকর্তারা। মাঝে বসে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আখতার হোসেন ভুঁইয়া।
সম্প্রসারিত উত্তরা আবাসিক এলাকায় প্লট বরাদ্দ নিয়ে ভুক্তভোগী সাবেক সরকারি কর্মকর্তা আবদুর রশিদ খান অভিযোগ করে বলেন, উত্তরায় রাজউকের তৃতীয় প্রকল্পে ১৭ এইচ প্লট বরাদ্দ পাই। কিন্তু প্রায় ২০ বছর ঘুরেও প্লট বুঝে পাইনি। সরকার থেকে পেনশনের যে টাকা পেয়েছি তা প্লটের পেছনে শেষ করেছি। রাজউকের প্রতিটি ফ্লোরে ঘুরেও কোনো সমাধান পাইনি। রাজউকের প্রতি টেবিলে টেবিলে টাকা ঢালতে হয়। রাজউকে একটি নথি দেখতে ৬০ হাজার টাকা লাগে।
আবদুর রশিদের এমন বক্তব্যে সঞ্চালক রাজউকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে তার প্লটের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে মাস দু’য়েকের মধ্যে সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়।
২০০০ সালে রাজউকের উত্তরা প্রকল্পের ৪১ নম্বর প্লট পান প্রবাসী ডা. রেজাউল আহসান। জমির খাজনা ও দখল থাকা সত্বেও তিনি দেশে এসে দেখেন, তার প্লটে ৪৩ নম্বর প্লটের মালিক ছয়তলা ভবন করে ফেলেছেন। রাজউকের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা পাইনি।
এ বিষয়ে উপস্থিত ওই এলাকার দায়িত্বে থাকা রাজউকের উপ-পরিচালক বাবুল মিয়া উত্তরে বলেন, আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। ওই এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণের সময় বেশি জমি নেওয়ায় সকলের প্লট সরে যায়। ফলে একটি প্লট নষ্ট হয়ে গেছে। সেজন্যই এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া ওই প্লটের ওপর ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। তাই এখন তাকে অন্য জায়াগায় প্লট দেওয়া ছাড়া উপায় নাই। রাজউক আগামী ছয়মাসের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান দেবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
নিজের জমিতে প্ল্যান পাস করে অন্য একজন ভবন নির্মাণ করে দখল করেছেন এমন অভিযোগ তুলেছেন মিরপুর এলাকার বাসিন্দা গাজী আবু তাহের। তিনি বলেন, আমি অনেক বছর ধরে বিদেশে আছি। দুই এক বছর পর পর দেশে আসি। মিরপুরে আমাদের নিজের জমিতে টিনের ঘর তুলে ভাড়া দেই। ২০১২ সালে দেশে এসে দেখি, আমার জমিতে ওই এলাকার প্রভাবশালী বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার খোরশেদ আলমসহ বেশ কয়েকজনে মিলে ছয়তলা ভবন নির্মাণ করে ফেলেছেন। রাজউক কিভাবে নকশা অনুমোদন দিল? এ কোন দেশে বাস করছি?
রাজউকের অথোরাইজড অফিসার আশরাফুল ইসলাম ওই অভিযোগের উত্তরে বলেন, বিষয়টি রাজউককে অবহিত করার পর আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। সমস্যা সমাধানে ধৈর্য ধরতে হবে।
এ সময় ভুক্তভোগী আবু তাহের বলেন, দেখা করতে গেলে ফাইল ছুড়ে ফেলা হয়। এখন সবার সামনে বলছেন, সমাধান করবেন।
উত্তরা থেকে আসা হুমায়ুন কবির বললেন, শুধু আশ্বাস দিলে হবে না। দুদককে গণশুনানির পর ফলোআপ রাখতে হবে। তা না হলে এগুলো কেবল সমাধানের আশ্বাসে থাকবে, বাস্তবায়ন হবে না।
গণশুনানিতে রাজউক অফিসে প্লটের অর্থ জমা দেওয়া সত্ত্বেও প্লটের দখল পেতে হয়রানি, ভূমির ছাড়পত্র বা নকশা অনুমোদনে হয়রানির শিকার হওয়া, ক্রয়সূত্রে বা উত্তরাধিকার সূত্রে মালিকানা হস্তান্তর বা নামজারির ক্ষেত্রে হয়রানিসহ বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরেন ভুক্তভোগীরা। রাজউকের পক্ষ থেকেও অনেককে তাদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়।
দুদক ও রাজউকে কিছু কুলাঙ্গার রয়েছে : ‘দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) কিছু কিছু কুলাঙ্গার আছে’ বলে মন্তব্য করেছেন দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল। রাজউক-এর কর্মকাণ্ড নিয়ে গণশুনানির প্রথম পর্বে কমিশন সচিব এ মন্তব্য করেন। ওই সব কুলাঙ্গারের কারণে নাগরিক সেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এদিকে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিম বিলুপ্ত করা হয়েছে’ বলে জানান দুদক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চুপ্পু বলেন, সাধারণ মানুষের ধারণা রয়েছে যে, রাজউক-এর সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির স্বীকার হতে হয়। এর অনেকটাই সত্যি। রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি দূর করতে প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে কমিশন। কিন্তু দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি দূর করার পরিবর্তে টিমগুলোই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। তাই আমরা টিমগুলো বিলুপ্ত করে গণশুনানির উদ্যোগ নিয়েছি।