বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা নিজেদের সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তুলতে আসেন। আর এখান থেকেই বিড়ম্বনার শুরু। অভিযোগ রয়েছে— এই প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত মূল্যের বাড়তি অর্থ না দিলে সহজে কোনো কাজ হয় না। আবার বাড়তি অর্থ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার যেন রুটিনে পরিণত হয়েছে। এমন অহরহ অভিযোগ থাকলেও প্রতিষ্ঠানের সেবার মান উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।
এসব বিষয়ে অবগত আছেন খোদ প্রতিষ্ঠানটির রেজিস্ট্রার ডা. মো. জাহিদুল হক বাসুনিয়া। কিন্তু লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলেই ব্যবস্থা সেই চিরাচরিত কথাতেই যেন আটকে আছেন তারা। অথচ পেশাগত জীবনে ঝামেলায় পড়তে চান না চিকিৎসকরা। তাই লিখিত অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকেন তারা। বিষয়টি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে— সবাই জানেন, বোঝেন, দেখেনও। অথচ কোনো ব্যবস্থা নেন না।
সূত্র জানায়, দেশের প্রত্যেক মেডিকেল ও ডেন্টাল শিক্ষার্থী এবং চিকিৎসকদের বিএমডিসিতে রেজিস্ট্রেশন এবং সার্টিফিকেট গ্রহণ বাধ্যতামূলক। সারাদেশে বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশনবিহীন কারো পক্ষে চিকিৎসা পেশায় জড়িত থাকা সম্ভব নয়। এ কারণে প্রায় প্রতিদিনই প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসকদের আনাগোনা লেগেই আছে। আর সেবা নিতে আসা এসব মানুষ ফিরে যান তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে। কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করলেও, লিখিত অভিযোগ দিয়ে নিজের বিপত্তি আর বাড়াতে চান না।
বিএমডিসিতে সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে এসব তথ্যের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে ২ বছর আগে পাস করা এক চিকিৎসক বলেন, ‘আমি সার্টিফিকেট তুলতে গেলে আমার কাছে যখন নির্ধারিত ফি দেয়ার জন্য বলা হয় তখন আমি একটি এক হাজার টাকার নোট দিই। কাউন্টার থেকে আমাকে খুচরা করে দিতে বলা হয়। আমি অপারগতা প্রকাশ করলে আমার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন এবং অনেকক্ষণ ধরে বকাবকি করেন। তখন আমার মনে হয়েছিল আর কোনোদিন এখানে আসব না।’ কিন্তু চিকিৎসকদের এখানে না এসে অন্য কোনো উপায় নেই বলে জানান তিনি।
বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত সদ্য পাস করা এক চিকিৎসক বলেন, ‘এখানে না এলে আপনি বুঝতে পারবেন নাÑ কিভাবে মানুষ দুর্নীতি করে।’ তিনি বলেন, ‘আমার সার্টিফিকেট তোলার জন্য ২ হাজার ৫০০ টাকা লাগার কথা। এই টাকা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে যিনি টাকা নিচ্ছেন তিনি বাড়তি টাকা দাবি করেন। তাকে ১০০ টাকা বেশি দিলেও আরো বেশি দাবি করেন। এরপর তিনি বলেন ১০০ টাকায় এ কাজ হবে না। যদি বেশি টাকা না দেন তাহলে আপনার কাজ পেতে দেরি হবে। এরপর আরো ১০০ টাকা দিলে আমাকে ২ হাজার ৫০০ টাকার রসিদ দেয়া হয়।’ তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘সার্টিফিকেট দিতে এরা যে এত হয়রানি করে তা বলার কথা না। সব কাগজ ঠিকমতো আনলেও অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অজুহাতে বিভিন্ন ত্রুটি খুঁজে বেড়ায়।’
সার্টিফিকেট নিতে আসা অন্য এক চিকিৎসক জানান, তার সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য দুই সপ্তাহ সময় নিয়ে তারিখ দেয়া হয়েছে। পরপর দুটি তারিখ পেছানো হয়েছে। অথচ যারা চাহিদা মতো টাকা দিচ্ছেন তাদের সার্টিফিকেট দ্রুত দেয়া হচ্ছে। তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘এভাবে না ঘুরিয়ে নির্দিষ্ট একটি তারিখ দিলেই আমাদের ভোগান্তি কম হতো।’
আবদুল লতিফ ভূঁইয়া নামে এক সিনিয়র চিকিৎসক বলেন, ‘এ দেশে শুধু বিএমডিসি না কোনো সরকারি অফিসেই টাকা ছাড়া ভালোভাবে কাজ হয় না। দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে গেলাম। এখন আর এসব নিয়ে কিছু বলতে চাই না।’ বিএমডিসি নিয়ে অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ছবি তুলতে হবে তাই ওদের ওখানে গেলাম, আমাকে ছয় মাস পরের তারিখ দিল। অথচ আমি যদি বাড়তি টাকা দিতাম আমার ছবি এক সপ্তাহের মধ্যেই তুলে দিত।’ তিনি বলেন, ‘বিএমডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে দুর্নীতি করে এটা সবাই জানে কিন্তু কেউই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না, নেবেও না।’
এ ব্যাপারে বিএমডিসির রেজিস্ট্রার ডা. মো. জাহিদুল হক বাসুনিয়া বলেন, ‘আমরা এই বিষয়গুলো জানি, কিন্তু কেউ এসে লিখিত অভিযোগ করে না। যার কারণে অ্যাকশন নেয়া সম্ভব হয় না। কারো কাজে বাড়তি টাকা চাইলে তিনি যদি আমার কাছে এসে অভিযোগ করেন, তাহলে অভিযুক্তদের ধরা সহজ হয়। লিখিত অভিযোগ দিলে সেটা মিটিংয়ে উত্থাপন করা যায়। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। কিন্তু সবাই মুখে বললেও কেউই কোনো অভিযোগ করেন না। যার কারণে এরা এই অপকর্মগুলো করেই যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘কেউ আপনার কাছে বাড়তি টাকা চাইছে, সেটা না দিয়ে তার কলারটা ধরে আমার কাছে নিয়ে আসেন। আপনি নিজেই দুটি চড়-থাপ্পড় দেন। দেখেন এরপর কী অ্যাকশন হয়। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ না করলে তো এরা এভাবেই চালিয়ে যাবে।’
সাধারণত সরকারি অফিসের আর্থিক ফি থাকলে সেটা পে-অর্ডারের মাধ্যমে নেয়া হয়, এখানে কেন ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা নেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুই বছর আগে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এতে দেখা যায় অফিসের পিয়নরা নিচতলায় গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছেন। (মূল অফিস দোতলায়) তারা আগেই পে-অর্ডার করে এনে রেখেছেন। আর সেটা আরো বেশি দামে বিক্রি করছেন। এই অবস্থা দেখে এটা বাদ দেয়া হয়েছে। আর ঢাকার বাইরে থেকে চিকিৎসকরা এলে তারা সহজেই কাজ করে দিনে দিনেই আবার ফিরে যেতে চান। এতে করে তাদের সময়ও বাঁচে— কাজটাও তাড়াতাড়ি হয়। আর এটারই সুযোগ কাজে লাগায় এখানকার অসাধু ব্যক্তিরা।’
বিএমডিসি সূত্র জানায়, এখানে এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সের সাময়িক নিবন্ধনের জন্য ধার্য ফি ৩০০ টাকা, পূর্ণ নিবন্ধনের জন্য এমবিবিএস ও বিডিএস ১ হাজার ৫০০ টাকা, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ৭৫০ টাকা, সুপ্রতিষ্ঠা সার্টিফিকেটের ফি ৩ হাজার টাকা, ডুপ্লিকেট সার্টিফিকেট ১ হাজার ২৫০ টাকা, অতিরিক্ত চিকিৎসা/দন্ত চিকিৎসা যোগ্যতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশি নাগরিক ১ হাজার টাকা ও বিদেশি নাগরিক ২ হাজার ৫০০ টাকা, নিবন্ধিত চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, চিকিৎসা সহকারী, অনুমোদিত দন্ত চিকিৎসকের নাম রেজিস্ট্রারে পুনর্ভুক্তি ১ হাজার টাকা, টেকনোলজি ট্রান্সফারের উদ্দেশ্যে নয় এমন ক্ষেত্রে বিদেশি চিকিৎসক/দন্ত চিকিৎসকের সাময়িক নিবন্ধন (প্রতি ছয় মাস অন্তর বা অংশের জন্য ২ হাজার ৫০০ টাকা), রেজিস্ট্রেশন নবায়ন প্রতি পাঁচ বছরের জন্য এমবিবিএস/বিডিএস ১ হাজার টাকা, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ৫০০ টাকা ও অনুমোদিত দন্ত চিকিৎসক ২০০ টাকা, সাময়িক নিবন্ধন সার্টিফিকেট হারানোর জন্য জরিমানা ৩০০ টাকা, বিলম্ব ফি (ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার তিন মাস পর থেকে প্রতি বছর বা অংশের জন্য এমবিবিএস/বিডিএস ১ হাজার টাকা, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ৩০০ টাকা, নবায়ন বিলম্ব ফি এক বছর বা অংশের জন্য এমবিবিএস/বিডিএস ৫০০ টাকা, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ২০০ টাকা, শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন স্নাতক ২০০ টাকা, স্নাতকোত্তর ৩০০ টাকা। জরুরি ফি ৩০০ টাকা, বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ডিগ্রির জন্য প্রসেসিং ফি বেসিক মেডিকেল/ডেন্টাল কোয়ালিফিকেশন ৮ হাজার টাকা, এডিশনাল মেডিকেল/ডেন্টাল কোয়ালিফিকেশন ১৫ হাজার টাকা, পিএইচডি ৩০ হাজার টাকা, রি-ইন্টারভিউ ১০ হাজার টাকা, নাম সংশোধন ৩০০ টাকা, ফটো পরিবর্তন ২০০ টাকা, সত্যায়ন প্রতি কপি ১৫০ টাকা, নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা সনদ ১ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে যার কাছ থেকে যা পাওয়া যায়, তাই আদায় করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
Next Post