‘মা, মাগো আমি তোমার সায়েদ।’ এই দুটো শব্দ বলেই থেমে গেল। এরপর কিছু সময়ের নীরবতা। মুখের কথা ক্ষণিকের জন্য বন্ধ হলেও দুই জনের চোখে জলের ফোঁটা এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ হয়নি। মা ও মাটির কাছে ২৫ বছর পর ফিরে এসেছে সাদেক মোহাম্মদ। মুখে তার খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি, মাথায় সাদা চুলের সংখ্যাই বেশি। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে কেমন জানি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে। কারো সঙ্গে তেমন কোনো কথা না বললেও মাকে জড়িয়ে ধরে ২৫ বছর না দেখার দুঃখ ভুলতে চাচ্ছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব সায়েদ।
জীবিকার তাগিদে মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন ২৫ বছর বয়সেই। কিছুদিন কাজ করার পরেই হারিয়ে ফেলেন পাসপোর্ট। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বাইরে কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়। ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। শুরু হয় সাদেক মোহাম্মদের বন্দি জীবন।
সায়েদ ২৫ বছর আগে না বলেই কিভাবে যে মালয়েশিয়া চলে আসেন এখনো সঠিকভাবে কেউ জানতে পারেনি। মালয়েশিয়া আসার ১ বছর পর সায়েদ একদিন তার মায়ের কাছে ফোন দিয়েছিলেন। এরপর আর কোনো খবর তার পরিবার জানতে পারেনি। ছবির কাহিনীর মতো ২৪টি বছর কেটে গেল। পরিবারও মনে করেছিল সায়েদ হয়তো মারা গেছে। তার পরিবার মনে করত সায়েদ যদি বেঁচে থাকত তাহলে অন্তত তার মায়ের খোঁজ নিত। ২৪ বছর সায়েদকে ভুলে গেল তার পরিবার। কিন্তু মায়ের মন থেকে সায়েদের নামটি মুছে যায়নি। সারাক্ষণ সায়েদের কথা মনে করতেন। মায়ের অত্যন্ত আদরের ধন ছিল সায়েদ। মায়েরও আত্মবিশ্বাস ছিল বাবা আমার ফিরে আসবে। ২৪ বছর সায়েদ মালয়েশিয়া কি করল, স্মৃতিশক্তি কীভাবে হারাল এই তথ্য কেউ দিতে পারেনি। তবে কয়েক বাংলাদেশি কয়েদির কাছ থেকে জানা যায়, সারাক্ষণ মা-মা বলে চিত্কার করতেন। বয়স হওয়াতে মালয়েশিয়া পুলিশও তার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করত। তবে মালয়েশিয়ায় বন্দি জেলখানার মধ্যে তিনি ছিলেন সবার প্রিয়। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন সবার দিকে। মাঝে মাঝে চোখ দিয়ে পানি পড়ত। আধাপাগল হওয়াতে হয়তো জেলের যন্ত্রণা বুঝতে পারেননি। তাকে যে জেল থেকে কেউ নিয়ে যাবে সেটাও তিনি হয়তো ভাবেননি।
বৈধ কাগজপত্র না থাকার কারণে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে জেল থেকে এনে মালয়েশিয়ার মালাকা আম্ব ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক রাখে গত এক বছর। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি (শ্রম) মুশাররাত জেবিন মালাকা আম্ব ডিটেনশন ক্যাম্প পরিদর্শন করতে গেলে সেখানে আটক অনেক বাংলাদেশির মধ্যে সায়েদ মোহাম্মদের সন্ধান পান। এ ক্যাম্পে আটক ১০০ বাংলাদেশির সাক্ষাত্কার নেন তিনি। তবে সায়েদ কোনো কথা বলেননি। পরে তাকে কাগজে লিখতে বললে তিনি নিজের নাম আর বাড়ির ঠিকানা লেখেন। তাতে দেখা যায়, তার বাড়ি বাংলাদেশের জামালপুর জেলার বাগেরহাটায়। সেই সঙ্গে তার বাবার নাম মোজাম্মেল, মা-রাজিয়া খাতুন বলেও ওই কাগজে লেখেন তিনি।
মুশাররাত জেবিন জানান, বাংলাদেশে দূতাবাস থেকে আমাকে ওই ক্যাম্পে পাঠানো হয়। যাতে আটক বাংলাদেশিদের খবর নিয়ে তাদের দেশে পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায়। সে সময় ১০০ বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয়, তাদের সাক্ষাত্কার নেয়া হয়। কিন্তু ওই ব্যক্তির (সায়েদ মোহাম্মদ) সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কোনো কথা বলেননি তিনি। কাগজে অগোছালোভাবে নিজের নাম-পরিচয়টুকু কোনো রকমে লিখতে পারেন।
জেবিন বলেন, সায়েদের হাতের বাংলা লেখা দেখে বুঝতে পেরেছি তিনি বাংলাদেশি। লিখতে পারলেও বাংলায় কোনো কথা বলেননি তিনি।
বৈধ কাগজপত্র না থাকার কারণে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন পুলিশ সায়েদ মোহাম্মদকে আটক করে। কয়েক মাস জেল খাটার পরও পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো তাকে কেউ নিতে আসেনি। এদিকে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাকে জেল থেকে বের হতে দিচ্ছে না। মুশাররাত জেবিন বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিলেন। তাকে দেখে তার খুব মায়া হলো। অনেকক্ষণ ধরে তার খোঁজখবর নেয়া হলো। মালয়েশিয়া তার কোনো নিকট আত্মীয় নেই। মুশাররাত জেবিন ঠিক করলেন যেকোনোভাবে তার স্বজনের কাছে তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। অনেক খোঁজখবর নিয়ে তার কোনো সন্ধান মিলল না। হঠাত্ তার মনে পড়ল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করলে তার হয়তো সন্ধান মিলবে।
তিনি সাংবাদিক কায়সার হামিদ হান্নানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বললেন। কায়সার হামিদ হান্নানও আশ্বাস দিলেন পত্রিকায় নিউজ করলে হয়তো তার স্বজনেরা তাকে খুঁজে পাবে। প্রবাসী সংবাদিক বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বাংলাদেশের এনটিভির অনলাইন সংস্করণে গত বছরের ২ ডিসেম্বর ‘মালয়েশিয়ায় আটক সায়েদের স্বজনদের খোঁজ চায় বাংলাদেশ দূতাবাস’ এই শিরোনামে একটি নিউজ করেন। নিউজটি যখন অনলাইনে প্রকাশ করা হয় মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। নিউজ পড়ে পাঠকের খুব মায়া হলো। সবাই তার স্বজনের সন্ধানে নামল। জামালপুর এনটিভি প্রতিনিধিও স্বজনের সন্ধানে যোগ দিলেন। ১ মাসের মধ্যেও তার সন্ধান মিলল না।
হঠাত্ একদিন সায়েদের এক আত্মীয় মুশাররাত জেবিনকে ফোন দিয়ে তার আত্মীয় পরিচয় দিলেন। মুশাররাত জেবিন তার ফোন পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন। শুরু হলো স্বজনদের আনন্দের বন্যা। সায়েদ বুড়ো হয়ে যাওয়াতে তাকেও কেউ চিনতে পারেনি। মুশাররাত জেবিন স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার দেশে যাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করলেন। স্বজনদের পাশাপাশি মুশাররাত জেবিনের মুখেও কিছুটা সুখের হাসি দেখা দিল।
সায়েদের মার মনে হলো পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী একজন মা তিনি। ২৫ বছর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সন্তানকে ফিরে পাবেন। টিকিট কাটা হলো ১৮ ডিসেম্বর। ১৮ দিন মায়ের কাছে ১৮ বছর মনে হলো। সত্যিই কি তার সোনার টুকরো সন্তান ফিরে আসবে। ‘মা’ বলে ডাক দেবে।
অবশেষে মায়ের ভালোবাসায় সিক্ত সায়েদ। দেশে গিয়ে কাউকে না চিনলেও গর্ভধারিণী মাকে চিনতে ভুল করেননি। হাউমাউ করে কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে গেল। এ যেন এক আনন্দের কান্না। মাকে জড়িয়ে ধরে সায়েদের কান্না আর কান্না। পাশাপাশি তার বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। মুশাররাত জেবিনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় তার পরিবার।
Prev Post
Next Post