এসএসসির ফরম পূরণে শত কোটি টাকার বাণিজ্য

0

SSCনতুন শ্রেণীতে ভর্তিতে নামে-বেনামে বিভিন্ন খাতে লাগামহীন ফি ও অস্বাভাবিক বেতন আদায় করেছে স্কুলগুলো। এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। অতিরিক্ত ভর্তি ফি আদায় করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাত দিনের মধ্যে বাড়তি টাকা ফেরত দিতে সময় বেঁধে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই নির্দেশনা না মানলে স্কুলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু বেঁধে দেয়া সময় শেষ হলেও রাজধানীসহ সারাদেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আদায়কৃত অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেয়নি।
অন্যদিকে চলমান এসএসসির ফরম পূরণে দেশের আড়াই হাজারেরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত শত কোটি টাকা আদায় করেছে। এরমধ্যে ঢাকা বোর্ডে ৮৮৭টি, যশোর বোর্ডে ১৫১টি, বরিশাল বোর্ডে ৯৩টি, দিনাজপুর বোর্ডে ১৯৪টি, চট্টগ্রাম বোর্ডে ১৯টি, কুমিল্লা বোর্ডে ১৭৫টি, সিলেট বোর্ডে ৬০টি এবং মাদরাসা বোর্ডের অধীনে ৩৮২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায় করেছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড জানিয়েছে, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের বেতন, কোচিং ফি, স্কুলের উন্নয়ন ফি ইত্যাদির কথা বলে অতিরিক্ত টাকা আদায় করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এছাড়া অকৃতকার্য ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেয়া হয়েছে।
এ বছর এসএসসিতে ফরম পূরণের জন্য বিজ্ঞান শাখায় ১ হাজার ৪৫৫ টাকা, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার ১ হাজার ৩৫৫ টাকা ধার্য করা হয়। তবে বেশিরভাগ স্কুল ৮-১০ হাজার টাকা করে আদায় করে। আর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১ হাজার ৫শ’ টাকা থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে। এই হিসাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শত কোটি টাকার ওপরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত আদায় করেছে। বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ৭ হাজার ১শ’ টাকা; সবুজ বিদ্যাপীঠ আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় ৭ হাজার ৬শ’ টাকা, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ সাড়ে ৮ হাজার টাকা, একরামুন্নেসা উচ্চ বিদ্যালয় সাড়ে ৭ হাজার টাকা অতিরিক্ত আদায় করেছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ জানান, নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত অর্থ আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়েছে। সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দিতে বলা হয়েছে।
ভর্তিতে অতিরিক্ত ফি ফেরত দেয়নি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান: চলতি বছর নতুন শ্রেণীতে শিক্ষার্থী ভর্তিতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেন্ট জোশেফ স্কুল, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মিরপুর পুলিশ স্মৃতি স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ রাজধানীর অনেক নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৪০ শতাংশ থেকে ১০০ ভাগ বেতন বৃদ্ধির প্রমাণ পেয়েছে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে শ্রেণীভেদে কমপক্ষে ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা বেতন বৃদ্ধি করে। ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বেতন ছিল ৮শ’ টাকা তা বাড়িয়ে এই বছর ১ হাজার ৫শ’ টাকা করা হয়। অষ্টম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ছিল ৯শ’ টাকা; এ বছর তা বেড়ে ১ হাজার ৭শ’ টাকা হয়। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ অতিরিক্ত মাসিক ফি নির্ধারণ করলেও অভিভাবকদের আন্দোলনের কারণে তারা অতিরিক্ত মাসিক বেতন আদায় স্থগিত করেছে। শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশের পর প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ আগের বছর নির্ধারিত মাসিক বেতন আদায় করছে। এছাড়া উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বেতন ৫০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল ভর্তি ফি দ্বিগুণ করে।
রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক সোহেল আহমেদ বলেন, অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলেও আমরা টাকা ফেরত পাইনি। অতিরিক্ত মাসিক বেতনের সমন্বয় করলেও অতিরিক্ত সেশন ফির টাকা ফেরত দেয়নি। জানা গেছে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জুনিয়র ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, দনিয়া একে হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজসহ দেশের অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আদায় করা অতিরিক্ত অর্থ ফেরত দেয়নি।
অতিরিক্ত ভর্তি ফি আদায় করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাত দিনের মধ্যে বাড়তি টাকা ফেরত দিতে সময় বেঁধে দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টিউশন ফি, সেশন ফি ও এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় অতিরিক্ত টাকা নিয়েছে, তাদের তা সাত দিনের মধ্যে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ফেরত দিতে হবে। এসব তথ্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডকে জানাতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ বলেন, বোর্ডগুলো এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেবে। যেসব প্রতিষ্ঠান এটি করবে না ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ও কমিটি বাতিলসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সম্প্রতি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত ভর্তি ফি আদায়ের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিশিষ্টজনরা বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, সম্প্রতি অনেক বেসরকারি স্কুলে শিক্ষা বছরের শুরুতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বেতন, ভর্তি ফি ইত্যাদি আদায় করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি স্কুলে এক লাফে ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ ফি বাড়ানোর ফলে অভিভাবকদের ওপর বাড়তি বোঝা ও অনভিপ্রেত চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি নীতিমালার বাইরে বেতন ও ভর্তি ফি বৃদ্ধির এই ঘটনা ক্রমাগত অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। একদিকে অভিভাবকরা রাস্তায় নামছেন, অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষের অনমনীয় মনোভাবের কারণে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে, যা মোটেই কাম্য নয়।
বিবৃতিদানকারী বিশিষ্টজনদের মধ্যে অন্যতমরা হচ্ছেন- অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, সেলিনা হোসেন, অধ্যাপক মাহফুজা খানম, এম হাফিজউদ্দিন খান, এ্যারোমা দত্ত, হোসেন জিল্লুর রহমান, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক শফি আহমেদ, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, সৈয়দ আবুল মকসুদ, ড. মনজুর আহমেদ প্রমুখ।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More