উচ্ছেদের পরপরই ফের দখল

0

rail wayরেলওয়েতে উচ্ছেদ অভিযান কোনো নতুন খবর নয়। প্রায় প্রতি মাসেই রেলওয়ের জমিতে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পরিচালনা করা হয় ব্যাপক অভিযান। ব্যয় করা হয় মোটা অংকের অর্থ। গত সাত বছরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নামে সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ফের বেদখল হয়ে যায় উচ্ছেদ হওয়া জমি। এ যেন রেলওয়ের কর্তৃপক্ষের এক ধরনের ‘স্থায়ী সংস্কৃতি’।
খোদ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, উচ্ছেদ হওয়া জমি ফের দখল হচ্ছে। এখনও রেলওয়ের প্রায় সোয়া ৫ হাজার একর জমি বেদখলে রয়েছে। গত ৭ বছরে মাত্র ১৫ থেকে ১৬ একর জমি উদ্ধার হলেও তা ধরে রাখতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, উচ্ছেদের পর রেলওয়ের কতিপয় কর্মকর্তা ও দখল রোধকারী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সহযোগিতায় অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে আবার বেদখল হচ্ছে উচ্ছেদ হওয়া জমি।
রেলওয়ে ভূ-সম্পদ বিভাগ, পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তকর্তাদের মতে, গত ৭ বছরে ছোট-বড় প্রায় ৪২০টি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়েছে। অর্থাৎ সারা দেশে মাসে কমপক্ষে ৫টি উচ্ছেদ অভিযান হয়। এর মধ্যে টঙ্গী-নারায়ণগঞ্জ রুটে সবচেয়ে বেশি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা হয়। এ রুটে প্রতি মাসে ছোট-বড় প্রায় ৮/১০ দফা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে হয়। কারণ, এই রুটে অভিযান শেষ হওয়ার পরপরই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অবৈধ দখলদাররা ফের উচ্ছেদকৃত জায়গায় স্থাপনা গড়ে তোলে।
ভূ-সম্পদ ও প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পুরো রেলওয়েতে ৩১ হাজার ৮৬০ একর সম্পত্তি রয়েছে। যার মধ্যে অবৈধ দখলদারদের কাছে রয়েছে প্রায় সোয়া ৫ হাজার একর। দখলে থাকা জমি উদ্ধারে বারবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। উচ্ছেদের পরপরই দখলমুক্ত করা জমি রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ায় আবার দখলদারদের কবলে চলে যায়। উচ্ছেদ কাজে ব্যবহৃত কোনো সরঞ্জাম কিংবা লোকবল রেলওয়েতে নেই স্বীকার করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, উচ্ছেদ কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম তথা লোকবল সবই ভাড়া করে আনতে হয়। অপরদিকে ভাড়া করা সরঞ্জামে কাজ করতে গিয়ে ত্রুটি হলে মোটা অংকের জরিমানাও পরিশোধ করতে হচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষকে। একেকটি অভিযান পরিচালনা করতে কমপক্ষে দেড় লাখ থেকে পৌনে দুই লাখ টাকা খরচ হয় বলে জানান ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা। সেই হিসেবে গত ৭ বছরে প্রায় ৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে উচ্ছেদ অভিযানে।
জানতে চাইলে, ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. আরিফুজ্জামান আরিফ যুগান্তরকে জানান, রেলওয়ের সম্পত্তি দখলদারদের থেকে উদ্ধার করতে ঢাকা বিভাগসহ বাকি ৩টি রেলওয়ে বিভাগও প্রতিনিয়ত এক ধরনের যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকা বিভাগের ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-সিলেট, সিলেট-আখাউড়া পর্যন্ত রেলওয়ের যেসব সম্পত্তি দখলদারদের কবলে রয়েছে তা উদ্ধারে প্রতি মাসেই কোথাও না কোথাও একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। উচ্ছেদের পর সেসব জায়গা রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। আবার পদক্ষেপ হিসেবে উদ্ধারকৃত জায়গায় বেড়া বা প্রাচীর দেয়া হলেও তা লোপাট হচ্ছে। সার্বক্ষণিক দেখভালের জন্য নির্দিষ্ট লোক না থাকায় দখলদাররা সুযোগটি ব্যবহার করছে বলেও তিনি জানান।
ঢাকা বিভাগীয় ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা মো. নূরুন্নবী কবির ভূঁইয়া যুগান্তরকে জানান, উচ্ছেদ অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ভাড়া আনতে হয়। কাজ করতে গিয়ে ভাড়ায় আনা সরঞ্জাম নষ্ট কিংবা ভেঙে গেলে জরিমানাও পরিশোধ করতে হয়। কোনো কোনো অভিযানে প্রতিদিন কমপক্ষে দেড় লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও দখলে রাখা যায় না রেলওয়ের সম্পদ। দখলদাররা আদালতে বহু মামলা করে রেখেছে। এসব মামলা পরিচালনা করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
অভিযোগ রয়েছে, উচ্ছেদ অভিযানে বুলডোজার, শ্রমিক ইত্যাদির খরচ নিয়েও চলছে ভয়াবহ দুর্নীতি। কর্মকর্তারা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনায় ব্যয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন। কোনো অভিযানে ২০ জন শ্রমিক নেয়া হলে, দেখানো হচ্ছে ৪০-৫০ জন। একটি বুলডোজার নেয়া হলেও দেখানো হচ্ছে ২টি। লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযানে লাখ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে জানিয়ে রেলওয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, রেলের সোয়া ৫ হাজার একর জমি অবৈধ দখলে রয়েছে, তা কত বছরে দখলমুক্ত করা হবে তার কোনো পরিকল্পনাই নেই রেলওয়ে মন্ত্রণালয় কিংবা রেলওয়ে বিভাগের কাছে। মন্ত্রী আসে মন্ত্রী যায়, কিন্তু বেদখলে থাকা রেলওয়ের জায়গা উদ্ধারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, উচ্ছেদ অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে যদি দখলমুক্ত হওয়া জায়গায় প্রাচীর কিংবা বেড়া দেয়া যেত তাহলে ওইসব জায়গা আবার বেদখল হওয়ার আশংকা থাকত না। তবে ঢাকা-টঙ্গী রুটে ৩য় ও ৪র্থ লেনের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। ওই সময় বেদখলে থাকা সম্পত্তি কঠোর হস্তে উদ্ধার করা হবে। তিনি বলেন, রেললাইনের দু’পাশে ১০ ফুট করে মোট ২০ ফুট জায়গায় রেলওয়ের স্থাপনা ছাড়া অন্য কোনো স্থাপনা বৈধ নয়। বেদখলে থাকা জায়গা উদ্ধারে নিয়মিত উচ্ছেদ কার্যক্রম করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, উচ্ছেদ কার্যক্রমের সঙ্গে কেউ যদি অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন বলেও তিনি জানান।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More