বর্ধিত ভাড়ায় ট্রেনে যাত্রার গতকাল শনিবার ছিল প্রথম দিন। কিন্তু ভাড়া বৃদ্ধির পাশাপাশি সেবার মান না বাড়ায় যাত্রীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ। অথচ যাত্রী সেবার মান বাড়ার কথা বলে এর আগে ২০১২ সালে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল কিলোমিটারে গড়ে ৩৬ পয়সা। আর এবার গড়ে ভাড়া বেড়েছে ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। গন্তব্য অনুযায়ী বর্ধিত ভাড়ার তালিকা আগেই সব স্টেশনে টানিয়ে দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।
গতকাল শনিবার সকালে ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে নেত্রকোনাগামী হাওর এক্সপ্রেসের যাত্রী মাসুদুর রহমান বলেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ হুট করে ভাড়া বৃদ্ধি করল কিন্তু সেবার মান তো একফোঁটা বাড়েনি। সেবার মান বলতে তিনি জানান, ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাবে ভোগান্তি ছাড়াই। ট্রেন স্টেশন ছাড়বে এবং গন্তব্যে পৌঁছাবে ঠিক সময়ে। কোনো টিকিট কালোবাজারে যাবে না। ট্রেনের ভেতরের পরিবেশও যাত্রীদের চলাচলের উপযোগী থাকবে। এর কোনোটিই ‘নিশ্চিত না করে’ রেলের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যৌক্তিক কিনা এ প্রশ্ন রাখেন।
কিশোরগঞ্জগামী ট্রেনের যাত্রী তুহিন মিয়া বলেন, সার্ভিস না বাড়িয়ে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। আমার ট্রেন ১০টায় আসার কথা থাকলেও সময়মতো আসেনি। এভাবে যাত্রীদের জিম্মি করে ভাড়া বাড়ানো অন্যায়। সেবার মান বৃদ্ধি করে ভাড়া বাড়ালে কারো আপত্তি থাকবে না। হাসেম আলী নামের এক যাত্রী জানালেন, একটি আন্তঃনগর ট্রেনের আসনবিহীন টিকিট কেটে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুরে এসেছেন তিনি। বাসে আসতে যানজটে পড়তে হয় বলে এভাবেই তিনি মতিঝিলে এসে অফিস করেন। অন্য সময়ে ৩৫ টাকায় চলে আসি। শনিবার ৪৫ টাকা নিল। কিন্তু সার্ভিস তো আগের মতোই। কেন বাড়তি সুবিধা নিশ্চিত না করে কেবল ভাড়াটাই চাপিয়ে দিল সরকার।
গতকাল থেকে নতুন হারে ট্রেনে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে শোভন শ্রেণীর ভাড়া ২৬৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৮৫ টাকা, শোভন চেয়ার ৩২০ থেকে ৩৪৫, এসি চেয়ার ৬১০ থেকে ৬৫৬, এসি সিট ৭৩১ থেকে ৭৮৮ ও এসি বার্থ ১০৯৩ থেকে ১১৮৯ টাকা। ঢাকা-খুলনা রুটে শোভন শ্রেণীর ভাড়া ৩৯০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪২০ টাকা, শোভন চেয়ার ৪৬৫ থেকে ৫০৫, এসি চেয়ার ৮৯১ থেকে ৯৬১, এসি সিট ১০৭০ থেকে ১১৫৬ ও এসি বার্থ ১৫৯৯ থেকে বেড়ে ১৭৩১ টাকা। ঢাকা-সিলেট রুটে শোভন শ্রেণীর ভাড়া হয়েছে ২৬৫ টাকা, শোভন চেয়ার ৩২০, এসি চেয়ার ৬১০, এসি সিট ৭৩৬ ও এসি বার্থ ১০৯৯ টাকা। ঢাকা-রাজশাহী রুটে এসব শ্রেণীর ভাড়া হবে ৮৫, ৩৪০, ৬৫৬, ৭৮২ ও ১০৬৮ টাকা। অন্যান্য রুটেও প্রায় একই হারে বেড়েছে যাত্রী ভাড়া।
এদিকে এই হারে ভাড়া বৃদ্ধিকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলেছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর অঙ্গীকার করে ২০১২ সালেও ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সেবার মানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির কারণে রেলে লোকসান হয়, আর এখন যাত্রীদের ওপর তার ভার চাপাচ্ছে।
জরিপ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন পুরো ট্রেনের বিভিন্ন কোচে ভাঙা আসন, ছারপোকা ও তেলাপোকার উপদ্রপ দেখা গেছে। পাশাপাশি টিকিটবিহীন যাত্রী ওঠানামাসহ নানা অনিয়ম রয়েছে। এছাড়া যাত্রীসেবার মান, রেল স্টেশনের সার্বিক পরিবেশ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে ‘সন্তুষ্ট নন’ বলে জানিয়েছেন ৭২ শতাংশ উত্তরদাতা। অন্যদিকে ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা রেলের সেবার মান ‘সন্তোষজনক’ বলেছেন। ৭০ শতাংশ উত্তরদাতা নিয়মিত কালোবাজারির কাছ থেকে টিকিট কিনে ভ্রমণ করতে বাধ্য হওয়ার কথা বলেছেন। তিন শতাংশ বলেছেন, তারা ঊর্ধ্বতন রেল কর্মকর্তা-কর্মচারী, রেলপুলিশ, আমলা, এমপি-মন্ত্রীর তদবিরের মাধ্যমে টিকিট সংগ্রহ করেন। বুকিং সহকারী, অনুসন্ধান কর্মকর্তা, স্টেশন মাস্টার, স্টেশন ম্যানেজার, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণে অসন্তুষ্টির কথা বলেছেন জরিপের ৬৫ শতাংশ উত্তরদাতা।
কমলাপুর স্টেশনের ম্যানেজার সিতাংশু চক্রবর্তী বলেন, তাদের আন্তরিকতার কোনো ‘অভাব নেই’। যাত্রীসেবার মান বাড়াতে তারা ‘সব সময়ই সচেষ্ট’। বর্ধিত ভাড়া ও সেবার মান নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, যাত্রীদের মধ্যে তো কোনো অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে না। তারা অসন্তুষ্ট- এমন কোনো অভিযোগও তো পাইনি। ঢাকা থেকে প্রতিদিন ১৩০টি ট্রেন বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করে। এর মধ্যে ‘দুই-একটা ট্রেন’ সময়মতো ছাড়া সম্ভব হয় না। অন্য ট্রেনগুলো তো সময়মতোই ছাড়া হয়, যাকে সিডিউল বিপর্যয় বলা যায় না।
Prev Post