বর্তমান ক্ষমতাসীনদের কোনো গণভিত্তি নেই মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছেন, জনগণের মধ্যে তাদের কোনো সমর্থন নেই। তাই তারা অন্যের শক্তির উপর ভর করে দেশের মানুষকে পদানত করে রাখতে চায়। এভাবে বেশিদিন চলা যায় না। তিনি বলেন, আমি মনে করি-বর্তমান শাসকেরাও এইভাবে বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। তাই তাদেরকে বলবো, দেশের মানুষের উপর নির্ভর করুন। দেশের অভ্যন্তরে যে সংকট সৃষ্টি করেছেন তা দেশের ভেতরেই আলাপ-আলোচনার পথে নিরসন করুন। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। আর সময় ক্ষেপনের চেষ্টা করবেন না।
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার বিকেলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে
আয়োজিত জাতীয় কনভেনশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
খালেদা জিয়া বলেন, দেশজাতির এক গভীর সংকটকাল চলছে। দেশে গণতন্ত্র নেই। জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার নেই। বৈধ সংসদ নেই। তথাকথিত সংসদে কোনো কার্যকর বিরোধী দল নেই। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। আজ বাংলাদেশে সুশাসন নেই। সুবিচার নেই। রাষ্ট্রীয় প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আইনের শাসন নেই। নেই কোনো মানুষের নিরাপত্তা। সরকার কাউকে কোথাও কোনো নিরাপত্তা দিতে পারছে না। তবুও দাবি করছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক। যা কিছু ঘটছে তা সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো স্বাভাবিকভাবে আইন অনুযায়ী তাদের কর্তব্য পালন করতে পারছে না। তাদেরকে রাখা হয়েছে শুধু গণবিচ্ছিন্ন ও অবৈধ সরকারকে জনগণের ক্ষোভ থেকে রক্ষা করার জন্য। তারা সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। বিচার বহির্ভূতভাবে যাকে খুশি তাকে হত্যা করছে। জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে গুম ও খুন করে ফেলছে। যেখানে সেখানে খুনের শিকারদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকের লাশের সন্ধানও মিলছে না। জুলুম, নির্যাতন, গ্রেফতার, হামলা, মামলা চলছে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের উপর। অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে বাড়ি ছাড়া। গ্রেফতার ও নির্যাতনের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে সম্মানিত নাগরিকদেরকেও নির্যাতন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থা নেই। প্রতিদিন গড়ে ১৪ জন মানুষ খুন হচ্ছে। নারী ও শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। গত তিন মাসে পত্রিকার হিসাবে দেড় হাজার লোক খুন হয়ে গেছে। দুর্নীতি ও লুটপাট করে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। শেয়ার বাজার থেকে লক্ষ কোটি টাকা লুটে নেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরকে নিঃস্ব করে ফেলা হয়েছে। ব্যাংকগুলো থেকে লুটপাট হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভের আটশো কোটি টাকা ডিজিটাল কারচুপির মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে। দফায় দফায় অবিশ্বাস্য রকমের ব্যয় বাড়িয়ে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো থেকে কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠন করা হচ্ছে।
এসময়ে খালেদা জিয়া আরো অভিযোগ করে বলেন, আজ যে সীমাহীন নির্যাতন ও লুটপাট চলছে বাংলাদেশের মানুষ এর আগে তা কখনো দেখেনি। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি মামলার রায় নিয়ে এখন আমাদের দেশে ব্যাপক আলোচনা চলছে। কি সে মামলা? এফবিআইয়ের একজন এজেন্টকে ঘুষ দিয়ে এক প্রবাসী বাংলাদেশী তরুণ বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের ব্যাপারে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলো। সেই মামলার নথিতেই আছে প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের একটি একাউন্টেই আড়াই হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ তিনশো মিলিয়ন ডলার জমা আছে।
এসময়ে খালেদা জিয়া প্রশ্ন রেখে বলেন, এই টাকা কোথা থেকে গেছে? এই টাকার উৎস কী? এভাবে তাদের আরো কতো টাকা আছে, বাংলাদেশের মানুষ তা জানতে চায়? বাংলাদেশের মানুষ মনে করে এই টাকা বাংলাদেশের জনগণের টাকা। এভাবে দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত বিপুল টাকা বিদেশে পাচার করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। এ টাকা ফিরিয়ে আনা দরকার। কিন্তু এ টাকার ব্যাপারে সরকার নীরব।
তারা এই টাকার কথা ধামাচাপা দিতে প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করেছে। কারারুদ্ধ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকেও এই মামলায় জড়িয়ে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে, তারা না-কি প্রধানমন্ত্রীর পুত্রকে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের রায়েই এধরণের অভিযোগকে নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এভাবে মিথ্যা প্রচারণা, অত্যাচার, নানা ইস্যু সৃষ্টি করে তারা তাদের অপরাধগুলো ঢেকে রাখতে চায়। জনগণের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরিয়ে দিতে চায়।
তিনি বলেন, এভাবে দেশ চলতে পারে না। দেশে গণতন্ত্র আনতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুবিচার ফিরিয়ে আনতে হবে। জুলুম-নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। শান্তি ও নাগরিকদের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে হবে। সেজন্য যে সেখানে আছেন সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করতে হবে।
তিনি বলেন, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই স্বাধীনতাকে সব মানুষের জীবনে অর্থবহ করে তুলতে হবে। আমরা একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রতিবেশীসহ সকল দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও মৈত্রীর সম্পর্ক চাই। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব দেশের সঙ্গে সকল সমস্যা নিরসনের নীতিতে আমরা বিশ্বাসী। তবে একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে আমরা সবকিছুই করবো সমমর্যাদার ভিত্তিতে। আমরা কারো কাছে মাথা নত করবো না।
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধানের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন দলটির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার লুৎফর রহমান। বক্তব্য রাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ড. সুকোমল বড়ুয়া।
বিএনপি নেতাদের মধ্যে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন, খায়রুল কবির খোকন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাংগঠনিক সম্পাদব বিলকিস জাহান শিরিনি, শ্যামা ওবায়েদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
২০ দলীয় জোটের শরিক নেতাদের মধ্যে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, জাতীয় পার্টি (জাফর) মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দার, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপির সভাপতি খণ্দকার গোলাম মোর্ত্তজা, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির সৈয়ধ মুজিবুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
Prev Post