মাধুরী দীক্ষিত এর ৪৯ বছরের সংগ্রামী জীবন

0

madhuriআশি-নব্বই এমনকি গত দশকের প্রথমদিকে ভারতীয় সিনেমায় অভিনেত্রী মানেই একবাক্যে উচ্চারিত হত তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী মাধুরী দীক্ষিতের নাম। অথচ টানা দুই দশক বলিউডকে মাতিয়ে রাখা মাধুরীর অভিনয়ের প্রথম জীবন মোটেও মসৃণ ছিল না। প্রথমদিকে প্রায় টানা পাঁচ বছর কোনো সিনেমায় তার বাণিজ্য সফলতো হয়ইনি, বরং দুর্দান্তভাবে ফ্লপ করেছিল। উঠতি নায়িকা হিসেবে যা তাকে ভুগিয়েছে মারাত্মক। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। আত্মবিশ্বাস আর অভিনয় দক্ষতার জোরে বারবার সিনেমা ফ্লপ করার পরেও ঠিকই শীর্ষস্থানে নিয়ে গেছেন নিজেকে। ১৫মে ৪৯ বছরে পা রাখা উপমহাদেশের তুমুল জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর জন্মদিনে শুভেচ্ছা…    

ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি ছিল তার প্রচন্ড ঝোঁক। কথক মুদ্রার নাচে সেই তিন বছর থেকেই তালিম নিয়েও আসছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই এক সময় নাচ থেকে অভিনয়ের প্রতি প্রচন্ড ঝোঁক তৈরি হয় মাধুরী দীক্ষিতের। ফলত ১৯৮৪ সালে প্রথমবার আসে সেই আরাধ্য সুযোগ। রাজশ্রী প্রোডাকশন হাউজের ছবি ‘অবোধ’-এ প্রথমবার অভিনয়ে নাম লেখার তিনি। ছবিতে তার জীবনে পর্দায় প্রথম নায়ক হিসেবে দেখা যায় বাঙালি অভিনেতা তাপস পালকে! ছবিটি মুক্তির পর বক্স অফিসে খুব একটা ভালো করেনি ছবিটি। ‘অবোধ’ মুখ থুবরে পরলেও মাধুরী দীক্ষিত প্রথমবার ছবিতে অভিনয় করেই বলিউডের সেসময়কার নির্মাতা প্রযোজকদের চোখ ধাঁধিয়ে দেন। সিনেআলোচকরাও ‘অবোধ’ ছবিতে তার অভিনয়ের প্রশংসা করেন। ফলত রীতিমত তার পিছু নেয় প্রযোজকরা। পরের বছরেই মাধুরীর আরেক ছবি ‘আওয়ারা বাপ’ মুক্তি পায়। যথারীতি আগের ছবির মতোই বক্স অফিসে ফ্লপ করে ছবিটি। মুষড়ে পড়েন তিনি। কিন্তু আশা ছাড়েন না। পরপর নতুন একজন নায়িকার দুটো ছবিই ফ্লপ করা সহজ কিছু ছিল না তখন! কিন্তু তারপরেও মাধুরী তার অভিনয় দিয়ে ফ্লপের ক্ষত মুছে দেন।

পরপর দুটো ছবি ফ্লপ হওয়ার পরের বছরে মাধুরীর আরো দুটি ছবি ‘সতী’ এবং ‘মানব হত্যা’ মুক্তি পায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই দুটো ছবিও বক্স অফিসে মুখ থুবরে পড়ে। এরপরের বছর মাধুরী অভিনীত আরো তিনটি ছবি মহরি, হিফাজত, এবং উত্তর দক্ষিণ দুর্দান্তভাবে ফ্লপ করে। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত  মাধুরী অভিনীত কোনো ছবিই ব্ক্স অফিসে হিট করেনি। এটা একজন নায়িকার ক্যারিয়ারের জন্য ছিল রীতিমত অগ্নিপরীক্ষার চেয়ে ভয়ঙ্কর। কিন্তু অনুপ্রেরণার কথা হল, মাধুরী মোটেও তার সিনেমার আর্থিক লাভ লোকসানের দিকে না তাকিয়ে নিজের অভিনয় দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ছুটে চলেন সামনের দিকে। তাইতো একের পর এক ছবি ফ্লপ করেও কখনো প্রযোজক সংকটে ভুগেননি তিনি। কারণ মাধুরী জানতেন, ব্যর্থ হতে হতে একদিন না একদিন সফলতা আসবেই!

হ্যাঁ। মাধুরীর ভাবনায় ঠিক হয়েছিল। ততদিনে ফ্লপের রানী হিসেবে বলিউডে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন মাধুরী। কিন্তু নিজের ইচ্ছে শক্তির দাপটে তার ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসে যায়। আর সেই সময়টা ১৯৮৮ সাল! এন. চন্দ্রের পরিচালনায় অনিল কাপুরের বিপরীতে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে ‘তেজাব’ নামের ছবিতে অভিনয় করেন মাধুরী। আর এই ছবি দিয়েই নিজের নামের সঙ্গে লেপ্টে থাকা ‘ফ্লপের রানী’ তকমাটা ঘুচে যায়। মানে বক্স অফিসে প্রথমবার তুমুল হিট করে মাধুরী দীক্ষিতের ছবিটি। দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষার পর যখন সত্যিই বলিউড মাৎ করে দেন মাধুরী, তখন তার পিছনে লাইন ধরে বলিউডের কাড়কাড়ি টাকাওয়ালা সিনেমা প্রযোজক আর নির্মাতারা।

আর এই ‘তেজাব’ সিনেমা দিয়েই বলিউডে অন্য উচ্চতায় আসন গড়েন মাধুরী। সিনেআলোচকদের তুমুল প্রশংসা ছাড়াও এই ছবির মধ্য দিয়েই প্রথমবার তিনি সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ‘ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড’-এ মনোনয়ন পান। এরপরের বছর বিখ্যাত নির্মাতা সুভাষ ঘাইয়ের সিনেমায় ডাক পান মাধুরী। আগের ছবির ব্যবসায়িক সফলতা বিষয়টি মাথায় রেখে সুভাষ ঘাইয়ের ছবিতেও মাধুরীর সঙ্গে অভিনয় করেন অনিল কাপুর। ‘রাম লক্ষণ’ নামের ওই ছবিটিও ভারতজুড়ে ব্যাপক বাণিজ্য করতে সমর্থ হয়।

আর নব্বইয়ের দশকে মাধুরীর আস্ফালনতো প্রায় সবারই জানা। বাণিজ্য সফল ছবি মানেই মাধুরী দীক্ষিত। নাচে গানে আর অভিনয়ে তার সময়ের সবার থেকে এগিয়ে থাকা অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে অভিনয় করেন দিল, সাজান, বেটা, খলনায়ক, হাম আপকে হ্যায় কউন, রাজা, দিলতো পাগল হ্যায়, আনজাম, মৃত্যদণ্ড-এর মত ব্যবসাসফল আর তুমুল জনপ্রিয় সিনেমায়। এসময় তার সিনেমা এতোটায় মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা তৈরি করেছিল যে শুধু ভারত নয়, ভারতের গন্ডি পেরিয়ে মাধুরীর সিনেমাগুলো উপমহাদেশের মানুষের মধ্যেও প্রবল আকর্ষণ তৈরি করে। টিভি ভিসিআরে হরদম চলতো মাধুরী অভিনীত কোনো সিনেমা বা তার গানগুলো!

বলিউডের সিনেমায় আশি ও নব্বইয়ের দশক মাতানো অভিনেত্রী শুন্য দশকে এসে পরিবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেন। যদিও তার আগে লজ্জা, হাম তুমহারে হ্যায় সনম এবং তুমুল জনপ্রিয় নির্মাতা সঞ্জয় লীলা বানসালির বিখ্যাত নির্মাণ ‘দেবদাস’-এ অভিনয় করেন। দেবদাস সিনেমায় অভিনয় করার পর হঠাৎ করেই হারিয়ে যান মাধুরী দীক্ষিত। ছেলে মেয়ের দায়িত্ব পালন করতেই মূলত অভিনয় ছাড়েন তিনি।  কিন্তু যার রক্তে অভিনয় আর নাচের মুদ্রা খেলা করে তাকে কি পারিবারিক বন্ধন কোথাও আবদ্ধ করে রাখতে পারে? মোটেও না, ফলতমাধুরীকেও দীর্ঘদিন পর তার দর্শকেরা বড় পর্দায় দেখতে পান। সেই পুরনো ভঙ্গিমায় ২০০২ সালের পর একেবারে ২০১৩ সালে! যদিও মাঝখানে ২০০৭ সালে ‘আজা নাচলে’ সিনেমায় হঠাৎ করেই দেখা যায় তাকে। কিন্তু তারপরে আবার উধাও! ফিরলেন ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’ সিনেমা দিয়ে। তাও নাচনেওয়ালি হিসেবে।  অভিনয়ে তাকে দেখা গেল ২০১৪ সালে ডেড ইশকিয়া সিনেমায়। কিন্তু মাধুরীর দীক্ষিত বলতে যে প্রভাব যে দাপুটে অভিনয়ের কথা তার ভক্ত অনুরাগীরা খুঁজে পান তার দেখা মিলে ‘গুলাবো গ্যাং’ সিনেমার মাধ্যমে।  সৌমিক সেনের এই সিনেমার মাধ্যমে আশি, নব্বই দশকের সেই মাধুরীকেই মানুষ দেখতে পায়।

বাণিজ্য আর প্রশংসা কুড়ানো ছাড়াও হাতেনাতে স্বীকৃতিও কম মেলেনি মাধুরীর। সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ‘ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড’-এ সর্বোচ্চ চৌদ্দবার মনোনয়ন পেয়েছেন মাধুরী, এরমধ্যে  চারবার পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন ফিল্মফেস্টিভালে অসংখ্যবার সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার ভাগিয়ে নেয়া ছাড়াও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘পদ্মশ্রী’ও পেয়েছেন মাধুরী।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More