ভবিষ্যতের রাজনীতির ওপর ইউপি নির্বাচনের প্রভাব
রোববার জুন মাসের ১ তারিখ, রাত ১১:২০ মিনিটে উপস্থিত ছিলাম আরটিভির একটি টকশোতে। মোট সাতজন আলোচক; ঘণ্টা দেড়েকের আলোচনা অনুষ্ঠান, মাঝখানে মিনিট দশেকের বিরতি। প্রত্যেক আলোচক প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তিতে চার থেকে পাঁচ মিনিট করে সময় পাওয়ার কথা। সর্বশেষ কিস্তিতে প্রত্যেক আলোচক আধা মিনিট থেকে দেড় মিনিট করে সময় পান। সাতজন আলোচকের মধ্যে তিনজন ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বা রাজনীতিবিদ, একজন ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে বিএনপির রাজনীতিবিদ, একজন ছিলেন বাম সংগঠনের রাজনীতিবিদ, একজন ছিলাম আমি (বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের একটি শরিক দলের প্রধান); এবং সর্বশেষ জন ছিলেন একজন অ-রাজনীতিবিদ তথা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ নামক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। আলোচ্য বিষয় ছিল ‘ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ও ভবিষ্যতের রাজনীতি’। সঞ্চালক জনাব সেলিম বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আলোচনাটিকে একটি দিকে ধাবিত করতে চাচ্ছিলেন। সেই দিকটি হলো, বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতির ওপর এই নির্বাচনের কী প্রভাব পড়তে পারে? তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এই নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করতে হয়। অবশ্যই আমাকে লিখতে হবে যে, ১ জুন আরটিভির পক্ষ থেকে আয়োজিত টকশোটি কোনোমতেই একমাত্র আলোচনা ছিল না বা নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করার একমাত্র সুযোগ ছিল না। কিন্তু যে প্রশ্নটি সঞ্চালক গুরুত্ব দিচ্ছিলেন, সে প্রশ্নটি সব টেলিভিশন চ্যানেলে বা সব পত্রিকার কলামে সমান গুরুত্বের সঙ্গে আসেনি; না আসাটাই স্বাভাবিক। কেন স্বাভাবিক? দুই-তিনটি অনুচ্ছেদ পরেই এই প্রশ্নের আংশিক উত্তর আছে।[ads2]
মিডিয়ার ভূমিকা
চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ষষ্ঠ এবং শেষ ধাপটি সম্পন্ন হলো শনিবার ৪ জুন ২০১৬। প্রত্যেকটি ধাপ চলা অবস্থাতেই, দিনের বেলায়, টেলিভিশনের পর্দায় এবং অনলাইন পত্রিকাগুলোতে কিছু কিছু নির্বাচনী সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর থেকে তথা সন্ধ্যা থেকেই টেলিভিশনে এবং অনলাইন পত্রিকায় পূর্ণাঙ্গ সংবাদ ও ফলাফল আসতে থাকে। রাত একটু গভীর হলেই, বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যে কোনো কোনোটিতে টকশোর অন্যতম আলোচ্য বিষয় হয় ইউপি নির্বাচন। নির্বাচনের দিন ছাড়াও, গত দুই মাসে, অনেক টেলিভিশন চ্যানেলে ইউপি নির্বাচনী সহিংসতা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক দিক নিয়ে বেশ কিছু আলাপ-আলোচনা হয়েছে। পত্রিকাগুলোতে বিভিন্ন আঙ্গিকের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং মূল্যায়নমূলক কলাম প্রকাশিত হয়েছে।
আমি মনে করি, ২০১৬ সালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হলো ইউপি নির্বাচন। মিডিয়ায় যেরকমভাবে পর্যালোচনা বা মূল্যায়ন করা হয়েছে, অথবা আমরা যদি পর্যালোচনা বা মূল্যায়ন করতে যাই, তাহলে এই নির্বাচনে অনেক বিষয় গুরুত্ব পায়।
দলীয় মার্কা ব্যবহার এবং তার প্রভাব
ইউপি নির্বাচনের চেয়ারম্যান পদে দলীয় মার্কার ব্যবহার এবার ছিল প্রথম। অতীতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীরা সমর্থিত হতেন। দলীয় মার্কা ব্যবহারের কারণে রাজনীতির মাঠে এবং সমাজে বহু প্রকারের ও বহু আঙ্গিকের প্রভাব পড়েছে। সেগুলো ইতোমধ্যেই আলোচিত হয়েছে, আলোচিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও আলোচিত হবে। বাংলাদেশের সমাজ বা জনগণ বিভিন্ন পরিচয়ে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে গভীরভাবে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে হালকাভাবে হলেও, বিভাজিত। রাজনৈতিক এবং কিছুটা সাংস্কৃতিক প্রধান বিভাজনটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলো বর্তমান শাসক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী ঘরানার চিন্তাবিদ। সেই প্রধান বিভাজনটি হলো এরূপ : মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি। এই সূচকে বা শিরোনামের বিভাজনটি এবার বিস্তৃত হয়েছে। এবারের ইউপি নির্বাচনে সমগ্র দেশবাসীকে নিশ্চিতভাবে তিনটি ভাগে পরিচিত করা হয়েছে। প্রথম ভাগ হলো আওয়ামী সমর্থক তথা নৌকার সমর্থক; দ্বিতীয় ভাগ হলো জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চাকারী শক্তি তথা ধানের শীষের নেতৃত্বে আওয়ামী-বিরোধীগণ। ৃতীতয় ভাগ হলো যারা এই ভাগাভাগিতে নিজেদের চিহ্নিত করতে চান না তথা প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ গোষ্ঠী, মনের ভেতরে দুর্বলতা যেই রাজনৈতিক দলের প্রতিই থাকুক না কেন। এবারের ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে, দেশের তৃণমূলে গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে সর্বত্রই আওয়ামী সমর্থকেরা নিজেদের প্রবল উপস্থিতি প্রকাশ এবং প্রচার করেছেন। আপাত দৃষ্টিতে নৌকা রাজনৈতিক জোয়ারের পানিতে স্রোতের অনুকূলে ভাসছেন; পালে অনুকূলীয় রাজনৈতিক হাওয়া। পাঠক, অনুগ্রহপূর্বক খেয়াল করবেন যে, আমি মনে করি, এই দৃশ্যটা আপাত দৃষ্টিতে দর্শনীয়।[ads2]
মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে সার্বিক মন্তব্য
আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে, নিজের মনের ভেতর মত গঠনের সময়, একাধিক উপাত্তের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য। একটি উপাত্ত হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমমনা রাজনৈতিক কর্মীদের অভিজ্ঞতা ও মতামত। আরেকটি উপাত্ত হচ্ছে মুদ্রণ-মিডিয়ায় প্রকাশিত ও প্রচারিত সংবাদ ও মূল্যায়নমূলক রচনা। তৃতীয় উপাত্ত হচ্ছে টিভিতে প্রকাশিত ও প্রচারিত সংবাদ এবং মূল্যায়নমূলক বক্তব্যগুলো। এই তিনটি উপাত্তের মধ্যে শেষের দু’টি তুলনামূলকভাবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিছু দিন ধরে লক্ষ করছি, টেলিভিশনগুলোর কর্তৃপক্ষ আলোচনার জন্য ব্যক্তিদের ডাকতে গিয়ে, রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছেন না। এটা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ইচ্ছাতেও হতে পারে অথবা নিজেদের ইচ্ছার বাইরে উচ্চতর রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের ইঙ্গিতেও হতে পারে। এই ভারসাম্যহীনতা যে কারণেই হোক না কেন, বাস্তবতা হলো, আলোচকদের বক্তব্য শুনতে গিয়ে আমরা সবসময় সরকারপক্ষীয় বক্তব্যের প্রাধান্য পাই। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মালিকের রাজনৈতিক দুর্বলতা বাংলাদেশের কোন্ রাজনৈতিক দলের প্রতি ছিল বা আছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান রাজনৈতিক সরকার সাড়ে সাত বছর আগে ক্ষমতায় আসা মাত্রই যে কয়েকটি দূরদর্শিতামূলক কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ। পাঠক যেন আমাকে ভুল না বোঝেন সেজন্য পরিষ্কার করে দিচ্ছি, দূরদর্শিতা বলতে এবং কৌশলগত বলতে, আওয়ামী লীগের স্বার্থের অনুকূলে বা আওয়ামী লীগের স্বার্থকে রক্ষা করে এমন দূরদর্শিতা ও কৌশলগত। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ অন্তত চার নিয়মে করা যায়। একটি নিয়ম হলো গোপনে গোপনে, গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট আমলাতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষ থেকে, মিডিয়ার প্রতি সতর্ক বার্তা বা নির্দেশনামূলক বার্তা জারি করা; যেমন বলা যে, এটা ছাপিও না, এটা প্রকাশ করো না, ওই নিউজটা বেশি দেখাও, ওই লোককে আলোচনায় ডাকিও না, ওই লোককে ডাকো, ওই নিউজটা দু’দিন পরে ছাপাও ইত্যাদি ইত্যাদি। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের অন্য একটি পন্থা হলো, আইন করা। আইনের মধ্যে বর্ণিত থাকে, কী লেখলে বা প্রচার করলে মিডিয়ার বিপদ; অতএব মিডিয়া নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে বা নিজেদের নিরাপদ রেখে আচরণ করে। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের তৃতীয় পন্থা হলো, আইনের কঠোর প্রয়োগ অর্থাৎ আইনের সু-ব্যবহার অথবা আইনের অপব্যবহার করে মিডিয়ার জীবন ও মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করা, যেমন কিনা গত সাড়ে সাত বছরে তিনটি টেলিভিশন চ্যানেলের উপরে প্রয়োগ হয়েছে ও একটি দৈনিক পত্রিকার উপরে প্রয়োগ হয়েছে। চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি এবং ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়ায়, একুশে টিভি নামক বিখ্যাত টিভি চ্যানেলের মালিকানা হস্তান্তর করা হয়েছে। আমার দেশ নামক জনপ্রিয় পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্য চতুর্থ পন্থা হচ্ছে মিডিয়ার মালিকানা নির্দিষ্ট করা। বর্তমান সরকার দেখে শুনে, সুনিশ্চিত আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তিগণকে বারো-তেরোটি টিভি চ্যানেলের মালিকানা দিয়েছে গত পাঁচ-সাত বছরে। পৃথিবী প্রকাশ্য সাক্ষী নয়, কিন্তু পরিস্থিতি সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এই চ্যানেলগুলোর মালিকানা ও চ্যানেলগুলোর অব্যাহত জীবন নির্ভর করে আওয়ামী লীগের চিন্তাচেতনাকে প্রসার করার ওপর। আমি এই দীর্ঘ অনুচ্ছেদটিতে মিডিয়া নিয়ে আলোচনা করলাম এ জন্য যে, এতকিছুর পরও, বাংলাদেশের মুদ্রণ বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচন নিয়ে যেভাবে খবর প্রচার করেছে, তার জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু যারা পত্রিকায় কলাম লিখেছেন বা টেলিভিশন টকশোতে বক্তব্য দিয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারেননি।
এই নির্বাচন আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতির অংশ
আমরা এই কলামে ইউপি নির্বাচনের মূল্যায়ন করছিলাম। শুরুতেই দলীয় মার্কায় নির্বাচন করার দু-একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে আলাপ করেছি। এখন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার কথা বলব। যেহেতু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, যেহেতু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি ভারতীয় রাজনৈতিক ও সরকারি প্রভাবের গন্ধযুক্ত নির্বাচন, যেহেতু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের নৈতিক শক্তিকে দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে, যেহেতু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটির কারণে বর্তমান রাজনৈতিক সরকার পৃথিবীর বহু দেশের কাছে অপ্রিয়ভাবে উপস্থাপিত, সেহেতু বর্তমান রাজনৈতিক সরকার এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে বিভিন্ন প্রকারের উদ্যোগ নিচ্ছে। কিছু উদ্যোগ প্রকাশ্য এবং প্রচলিত ধারার, অপরপক্ষে কিছু উদ্যোগ অপ্রকাশ্য এবং অপ্রচলিত ধারার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে, কূটনৈতিক সৌজন্যের সীমাবদ্ধতার ভেতরে থেকেই বর্তমান সরকারের প্রতি আহ্বান আছে, নতুন করে একটি পার্লামেন্ট নির্বাচন দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অঙ্গনে, বর্তমান সরকারের প্রতি অব্যাহত আহ্বান আছে, নিরপেক্ষ নির্মোহ পরিস্থিতি ও পরিবেশে, নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রণে বা নিরপেক্ষ পরিচালনায়, সর্বাধিক সংখ্যক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে, আরেকটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান যেন করা হয়। বর্তমান রাজনৈতিক সরকার দেশের এবং বিদেশের এরূপ আহ্বানগুলোকে মোকাবেলা করেই তাদের অস্তিত্বরক্ষামূলক কার্যক্রম বজায় রেখেছেন। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক সরকার, নিজেদের প্রস্তুতি গ্রহণ করেই যাচ্ছে। প্রশ্ন হতে পারে কীসের প্রস্তুতি? উত্তর হলো, আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে যেন যুগপৎ তিনটি উদ্দেশ্য সফল হয়। প্রথম উদ্দেশ্য হলো, সর্বাধিক সংখ্যক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশীদার করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, দেশ-বিদেশের পর্যবেক্ষকদের থেকে এই সার্টিফিকেট আদায় করা যে, পার্লামেন্ট নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে। তৃতীয় উদ্দেশ্য হলো, ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী জোট যেন শুধু জয়লাভ করে না বরং কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি পায়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই তিনটি উদ্দেশ্য সফল করার লক্ষ্যে, সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচন একটি প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ ছিল।[ads1]
চেয়ারম্যানেরা তৃণমূলকে নিয়ন্ত্রণ করবেন
সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ শতকরা প্রায় নব্বই শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদে নিজেদের প্রার্থীকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই নব্বই শতাংশের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদেরও শামিল করছি। কারণ বিদ্রোহী প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের নীতি বা আওয়ামী লীগের লক্ষ্য বা আওয়ামী লীগের কর্মপদ্ধতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি; তারা বিদ্রোহ করেছিলেন প্রার্থী মনোনয়নে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। সদ্য সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বর্তমান রাজনৈতিক সরকার পৃথিবীর নিকট উপস্থাপন করছে, নীরবে বা সাইলেন্টলি একটি বক্তব্য। বক্তব্যটি হলো অনেকটা এরকম : ‘বিশ্ববাসী দেখো, সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের দলের সমর্থন কত গভীর এবং বিস্তৃত।’ বাস্তবতা হলো, যে নিয়মেই হোক না কেন, আসলেই পদ্ধতিগতভাবে বা আনুষ্ঠানিকভাবে বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করল। একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মানে একটি ইউনিয়নের নেতা। ইউনিয়নের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের হোতা ও পরিচালক। অতএব এই তথাকথিত গভীর ও বিস্তৃত সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে, বর্তমান রাজনৈতিক সরকার, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। আগামী নির্বাচনে যেন ভোটারেরা আওয়ামী লীগের অনুকূলে ভোট দেয় তার জন্য তৃণমূল পর্যায়ে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ও সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা ভবিষ্যতে অনেক সহজ হয়ে গেল।
এবারের নির্বাচন : টাকার খেলা
তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনী খরচ এবার ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। মনোনয়ন পাওয়ার জন্য, আগ্রহীরা টাকা খরচ করেছেন এরূপ অভিযোগ বিস্তর। মনোনয়ন পাওয়ার পর নির্বাচনে জেতার জন্য প্রার্থীরা টাকা খরচ করেছেন জোয়ারের পানির মতো। কানে আসছে অনেক কথা যে, অমুক চেয়ারম্যান প্রার্থী এক কোটি টাকা ব্যয় করেছেন, অমুক চেয়ারম্যান প্রার্থী দেড় কোটি ব্যয় করেছেন, অমুক চেয়ারম্যান প্রার্থী অর্ধকোটি ব্যয় করেছেন, অমুক চেয়ারম্যান প্রার্থী নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার অজুহাতে এত লক্ষ টাকা পেয়েছেন ইত্যাদি। এটা একটা টাকার খেলা ছিল এবং টাকা কাদের কাছে ছিল? ইংরেজি পরিভাষায় : এসেনশিয়ালি, উইথ দি আওয়ামী লীগারস। বাংলায়, আওয়ামী লীগারদের কাছেই টাকা আছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ছোট, মধ্যম ও বড় সর্বপ্রকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যবসা আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তিরাই পেয়েছেন। অতএব যে টাকা কামাই করা হয়েছে, এবার তা ব্যয় হয়েছে। টাকার এরূপ ব্যবহার ও অপব্যবহারের প্রভাব সমাজের ওপর দারুণ নেতিবাচক হতে বাধ্য। টাকা খরচ করলে সবকিছু করা যায়, সবকিছু পাওয়া যায়, সবকিছু চাপা দেয়া যায়, সবকিছু ম্যানেজ করা যায়, সবকিছু কেনা যায়- এই ধারণা সমাজে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইউপি নির্বাচনে যত খরচ হলো তার থেকে বহুগুণ বেশি খরচ জনগণ কল্পনা করবে, উপজেলা নির্বাচনের সময় বা সংসদ নির্বাচনের সময়।[ads1]
হতাহতের খবর এবং মিডিয়া-মূল্যায়ন
ইউপি নির্বাচনের কারণে জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়েছে। শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। কয়েক হাজার আহত হয়েছেন। গত চার বছর ধরে চলমান যে প্রক্রিয়া (অর্থাৎ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া); সেই প্রক্রিয়া আরো জোরদার হলো এবং আরো বেগবান হলো। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে, মোটামুটি একটা ধারণা এরকম। আমি কোনো পত্রিকার নাম উল্লেখ করছি না; ছয়টি ধাপে মিলে প্রাণহানির সংখ্যা ১২০ এর অধিক; ১২১ অথবা ১৩০ অথবা ১৩২ এরূপ একটি সংখ্যা। আহত, হাজারের অধিক। ৫ জুনের কয়েকটি প্রধান পত্রিকার শিরোনাম উল্লেখ করছি। (প্রথম আলো) প্রথম পৃষ্ঠার বড় শিরোনাম ছিল, ‘শেষ হলো প্রাণঘাতী নির্বাচন’। (নয়া দিগন্ত) ‘প্রাণঘাতী ইউপি নির্বাচন শেষ’। (মানবজমিন) ‘শেষ হলো রক্তঝরা নির্বাচন’। শিরোনাম থেকেই বোঝা যায়, প্রধান পত্রিকাগুলো ইউপি নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে কী নিয়মে মূল্যায়ন করেছে। টেলিভিশন টকশোতে যতই জোর গলায় সরকারের প্রশংসা করা হোক না কেন, পত্রিকার এরূপ শিরোনামগুলো অনাগত ভবিষ্যতের জন্য তথা এখনো লেখা হয়নি এমন ইতিহাসের জন্য খুব শক্তিশালী উপাত্ত হয়ে থাকল। পত্রিকাগুলোর মতে, ছয় ধাপের নির্বাচনে, অন্ততপক্ষে অর্ধেক সংখ্যক সংঘর্ষ হয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে। বাকি সংঘর্ষ হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে। প্রচুরসংখ্যক ঘরবাড়ি জ্বালানো-পোড়ানো হয়েছে। নির্বাচন প্রসঙ্গে ৫ জুন ২০১৬ আরো কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম উল্লেখ না করলেই নয়। (প্রথম আলো) ‘মাঠে ককটেল কেন্দ্রের ভেতরে লাশ’, (বাংলাদেশ প্রতিদিন) ‘শেষ ধাপেও সংঘাত সহিংসতা’, (যুগান্তর) ‘অনিয়মে চ্যাম্পিয়ন ইসি’, ‘সরেজমিন মুরাদনগর : ব্যালট কেড়ে নিয়ে সিল মারাই ছিল তাদের কাজ’, নারায়ণগঞ্জের বন্দর : ‘জাল ভোটে বাধা দেওয়ায় এজেন্ট বিতাড়িত’, ‘সরেজমিন চট্টগ্রামের ৫ উপজেলা : আজকাল ভোট এমনই, ভোটার লাগে না!’ (দৈনিক ইনকিলাব) ‘এটা কি নির্বাচন? এরশাদের প্রশ্ন’, (নয়া দিগন্ত) ‘আনোয়ারায় পুলিশের সামনে আওয়ামী লীগ কর্মীদের কেন্দ্র দখল, গুলিবিদ্ধ ১২’, (মানবজমিন) ‘এমন নির্বাচন যাতে আর না আসে’, ‘নরসিংদীতে বিএনপি প্রার্থীকে পেটালেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী’, ‘ব্যালট বক্স দে, নইলে গুলি করবÑ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া’, ‘ছোঁ মেরে কেড়ে নেয়া হলো ব্যালট পেপার’।এই ছয়টি ধাপের নির্বাচন নিয়ে প্রথিতযশা পত্রিকাগুলো বহু বাস্তবসম্মত সংবাদ করেছে। কিন্তু এ সব সংবাদ নির্বাচন কমিশনের উপলব্ধি ও মতামত পাল্টাতে পারেনি। ৪ জুন অনুষ্ঠিত শেষ ধাপের নির্বাচনের পর, প্রধান নির্বাচন কমিশনার যা বলেছেন, সেটা বিভিন্ন পত্রিকায় এসেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য উদ্ধৃত করে নয়া দিগন্ত শিরোনাম করেছেÑ ‘এইবার সবচেয়ে ভালো ভোট হয়েছে’। একই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য উদ্ধৃত করে যুগান্তর শিরোনাম করেছে, ‘ইউপি নির্বাচন সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ হয়েছে : সিইসি’। অপরপক্ষে যুগান্তর তাদের নিজেদের মূল্যায়নে প্রথম পৃষ্ঠায় যে শিরোনাম করেছে সেটি ছিল এরকমÑ ‘অনিয়মে চ্যাম্পিয়ন ইসি।’ এতগুলো নেতিবাচক খবরের মধ্যে দু-একটি ইতিবাচক খবরও আছে। যেমন- বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে অনিয়মের জন্য বা সংঘর্ষের জন্য ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে; বিজিবি টহল দল অনেক কেন্দ্রকে দখলের হাত থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু এ ধরনের ইতিবাচক সংবাদগুলো সংখ্যা এত কম যে, আমরা সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে, নিজেদের মনের ভেতরে কোনোরূপ ইতিবাচক সার্বিক মতামত গঠন করতে পারছি না। কারণ ইতিবাচক ঘটনাগুলোর সংখ্যা নেতিবাচকের তুলনায় খুবই কম এবং অনুল্লেখযোগ্য।
শেষ কথা
তিন মাসের অধিককাল ধরে যে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, তার প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও সমাজে দীর্ঘমেয়াদি এবং অবিশ্বাস্যভাবে নেতিবাচক। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া ভেঙে পড়েছে। সরকার কর্তৃক বা নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বা উভয়ের যোগসাজশে এই ভেঙে ফেলার কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। সহিংসতাকে একটি স্বাভাবিক কাজ হিসেবে স্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নামক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির অদক্ষতা এবং অন-আন্তরিকতা জনসমক্ষে উদ্ভাসিত হয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের আগামী দিনের ইচ্ছা প্রসঙ্গে, আগামী দিনের কর্মপদ্ধতি প্রসঙ্গে ধারণা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অতএব বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের, রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলোকে মোকাবেলা করতে হলে বা নিউট্রালাইজ করতে হলে, কী করণীয়, সেটা বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি যদি সাধু হই, তিনি যদি সাধু হন, আপনি যদি সাধু হন, তাহলে সাবধান। বাংলায় বলে, ‘সাধু সাবধান’। [ads2]
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com