বাংলাদেশের এখনকার রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বুঝবার ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলা আলোচনা করা দরকার তা আমরা এখনও ঠিক করে ওঠতে পারিনি। অথবা বলা যায়, যে তরিকায় রাজনীতির আলোচনা উঠলে, নিদেনপক্ষে শিক্ষিত পরিমণ্ডলে রাজনীতির তর্কটা একচক্ষু এলিট মার্কা খুপরির জগৎ থেকে মুখ তুলে বিকশিত হবার সুযোগ পেতো তা আমরা শুরু করতে পারিনি। এর দায় তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের। এর মূলে আছে গণবিরোধী বুদ্ধিজীবীতাকে মূলধারা হিসেবে হাজির করার খামতি। বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে পরাধীন করে রাখার জন্য বুদ্ধিজীবীরাই যথেষ্ট।
আনন্দের কথা হল, সাধারণ জনসমাজে এইসব বিকট বিকট বুদ্ধিজীবীদের দুই পয়সারও দাম নাই। তাদের প্রভাব মিডিয়া পরিমণ্ডল নেতা-নেত্রীর গোপন বৈঠক বা পর্দা বা বেপর্দার টেবিল টকেই সীমাবদ্ধ। যাহোক, আজ আমরা কয়েকটি পয়েন্টে এই মুহূর্তের রাজনৈতিক চরিত্র বুঝবার চেষ্টা করবো। বলাই বহুল্য আমাদের এখানে যে তরিকায় চলমান রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করা হয় তার ধার আমরা ধারি না। দুই দলের শত্রুতাকে আমরা বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সমস্যা মনে করি না। তথাপি এইসব দলদারির রাজনীতি আমরা বিচার করি। করব। কিন্তু তাঁর অভিমুখটা হবে নয়া বাংলাদেশের উদ্বোধনকে তাতিয়ে দেয়া।
আর এটা করতে গেলে ক্ষমতার রাজনীতির গণবিচ্ছিন্ন চরিত্রটা পরিস্কারভাবে বুঝতে হবে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্যটা হবে গণক্ষমতার নতুন সামাজিক-নৈতিক একই সাথে রাজনৈতিক স্বত্তাটা বিকশিত করা। এটাই বাংলাদেশে এখনকার কাজ। আর এটাই তথাকথিতমূল ধারার বুদ্ধিজীঈতা বা সুশীল ধারা বিশ্রিভাবে এড়িয়ে কাগুজে আলাপে পর্দা ফাটিয়ে ফেলে। তারা সুভদ্র আলোচনার শ্রোতে ভয়ের সংস্কৃতিকে সামাজিকীকরণ করে চলেছে নিত্যদিন। সেই দিকে সতর্ক থেকে আজকে আমরা কয়েকটি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করব।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট :
শুরুতেই আনন্দের কথা জানাইতে চাই। শেখ হাসিনা সরকার খানিকটা কৌশলে বাকিটা জবরদস্তি করে ক্ষমতা আকড়ে ধরে থাকাতে বাঙালি জাতীয়বাদি রাজনীতি ঐতিহাসিক সঙ্কটে পড়েছে। একে তো এর আত্মপরিচয়ের ঐতিহাসিক মীমাংসা করা হয়নি। তার উপর ফাঁসির দড়ির ওপর ভর করে সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ কায়েমের কারণে এতো দিন যে সব বুদ্ধিজীবীরা চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে যে কোনো বিরোধীতাকে জামায়াত-বিএনপির ষড়যন্ত্র ঠাওরেছেন তাদের মুখে জুতার কালি পড়েছে। তাদের আর কোনো সামাজিক বৈধতা নাই। গলাবাজির সব রাস্তা হাসিনা বন্ধ করে দিয়েছেন। শাহবাগ কে র্নিলজ্জভাবে মুক্তিযুদ্ধের মিথের ওপর দাঁড়করানোর জন্য যে সব বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী জেহাদে শরিক হয়ে ছিলেন সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের আমল হাজির হওয়ায় তাদের সব রকম নাগরিক ভূমিকার নিকাশ হয়ে গেছে। এই গুণ্ডাবাজির পরিণতিতে আজ বাংলাদেশ নিয়মান্ত্রিক এক স্বৈর-অবস্থায় নিপতিত হয়েছে।
যা হোক বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে যে সব গণবিচ্ছিন্ন চাটুকার তথাকথিত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী নামধারী প্রতিবন্ধীরা গলাবাজি করেছেন তারা এখন চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন। কোনো কথা বলার নৈতিক বৈধতা হারিয়ে তারা এখন নিজেদের আদর্শে কি ত্রুটি আছে তা খুঁজে দেখতে মনযোগী হয়েছেন। এটা কম কৌতুকের জন্ম দেয় না। আমি নজির হিসেবে প্রথম আলোর থিং-ট্যাঙ্ক প্রকাশনা ‘প্রতিচিন্তার’ সর্ব শেষ সংখ্যার (প্রতিচিন্তা, জানুয়ারী-মার্চ ২০১৪ সংখ্যা) প্রথম লেখাটার দিকে পাঠকের নজর ফেরাতে বলব।
‘বাঙালি জাতয়িতাবাদ চার দশক পর’- শিরোনামের এক লেখায় বদরুল আলম খান লিখেছেন,
‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবল স্রোতে ৪২ বছর আগে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্ব সভায় স্থান করে দিয়েছিল। আজ সে দেশ একটি সংঘাতময় দেশ হিসেবে পরিচিত। মধ্যবিত্ত জীবনের সীমানায় যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের জন্য দেশের এই পরিচয় এক অদ্ভুত বিড়ম্বনার জন্ম দিচ্ছে। তারা দেখছে কীভাবে সংঘাতে ঋজুতা রাজনীতিকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। দুই বৃহৎ রাজনৈতিক জোট দেশের বিধাতা হলেও তাদের মধ্যে সহযোগিতা বা সমঝোতা নেই। তারা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নিয়োজিত।’
তিনি এই লেখায় অনেক চমকপ্রদ বিষয়ের অবতারনা করেছেন। যদিও তার চিন্তার এনলাইটমেন্ট সীমাবদ্ধতার কারণে এইটা দিয়ে বেশিদূর আগানো যাবে না। কিন্তু এমন সব বিষয়কে আমলে নিয়েছেন যা সত্যিই অমাদের জন্য সুখবর। তিনি জানাচ্ছেন,
‘বাঙালির প্রধান দুই আত্মপরিচয়, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়কে, মূল প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত করা হয়েছে। ৪২ বছর পার হলেও ওই দুই পরিচয় কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। দুই পরিচয়ের দ্বন্দ্ব সে কারণে এখানে তীব্র ও রক্তাক্ত।’
এই এতোটুকু বোধ যে সুশীলদের মধ্যে জেগেছে তার জন্য শুকরিয়া আদায় না করে উপায় নাই। আমরা শুরু থেকে শাহবাগ, ফাঁসির রাজনীতি ও কর্পোরেট জাতীয়তাবাদের উপনিবেশী সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়ে আসছি। একই সাথে বলে আসছি বাংলাদেশে ইসলামের একটা পর্যালোচনা লাগবে। নিদেন পক্ষে ইসলাম ও রাজনীতির প্রশ্নে তথাকথিত প্রগতীশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরির্বতন না হলে রক্তপাত এড়ানো যাবে না। আওয়ামী লীগ মানেই গুণ্ডা বা ধর্মদ্রোহী এই মনোভাব সমাজে কেন প্রবলতরো হচ্ছে তাও খতিয়ে দেখতে চেয়েছি। অন্য দিকে বিএনপি কোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা মতাদর্শ না হাজির করেও কি করে ক্ষমতার রাজনীতির প্রধান ফ্যাক্টর হয়ে উঠল তারও হদিস করতে চেয়েছি। পাশাপাশি জামায়াত ও অন্য ইসলামী ধারাগুলোর বিচার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে একটা মতাদর্শিক সংগ্রামকে বেগবান করার কথাও শুরু থেকে বলে আসছি। কিন্তু এর ফল হয়েছে উল্টা। আমাদের রাজাকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী হিসেবে হেয় করা হয়েছে। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়েছে। ফলে এখন কৌতুক অনুভব না করে পারছি না। আওয়ামী লীগ যখন তার উপনিবেশী সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের জোড়ে ক্ষমতায় বসে গেল তখন চেতনার আফিম খোরদের আর আপসোসের সীমা রইল না। এতোদিনে যে জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে সেই হুশ নাই। এখন আল-কায়েদা ও মার্কিন অনন্তযুদ্ধের ছঁকে পরে গেছে বাংলাদেশ। আর তা গৃহযুদ্ধের প্রবল প্রতাপ নাগরিক জীবন কে ভীত করে তুলছে। বিরোধীদল নিধনের ক্রসফায়ার গল্পও চালু হয়েছে। সব মিলিয়ে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবিতা স্বমূলে তার বৈধতা বা পাবলিক লেজিটিমেসি হারিয়েছে। তথাকথিত নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এমন এক সঙ্কটে পড়েছে যে এর রাজনৈতিক সম্ভানা ঐতিহাসিকভাবে বিনাশ হওয়ার দ্বার প্রান্তে চলে গেছে। এখন গণক্ষমতার উত্থানের অপেক্ষা জনমনে ফিরে এসেছে প্রবলভাবে। এইটা একদিক থেকে স্বাস্থ্যকর বলতে হবে। যা হোক আমরা এই লেখায় বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের ধরন ও নয়া স্বৈরতন্ত্রের হালহকিকত নিয়ে আলোচনা করব।
বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ :
ফ্যাসিবাদ নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। দেশে বিদেশে ফ্যাসিবাদ নিয়ে আলোচনার ঐতিহ্যেও ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বাঁক বদল ঘটে গেছে। ফ্যাসিবাদ, বলাই বাহুল্য পশ্চিমা রাজনৈতিক তাত্ত্বিকতার আলোচনায় অতি জোড়ালোভাবে হাজির রয়েছে। আমাদের দেশে এই বিষয় নিয়ে চিন্তাশীল অধ্যায়ন এখনও শৈশব অবস্থা পার করেছে বলা যাবে না। ফ্যাসিবাদ এখানে রেটরিক বা কথার কথা বা গালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর তাত্ত্বিক বা নিদেন পক্ষে একাডেমিক আলোচনার বেহাল দশা লজ্জাজনক।
বাংলাদেশে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনার এক নম্বর সমস্যা হল অতি পণ্ডিতি। আর লোক দেখানো বিদ্যার গড়িমা। ফলে এখানকার লেখক বুদ্ধিজীবীরা অতি মাত্রায় জাজমেন্টাল। কোনো কিছু খতিয়ে দেখার ধৈর্য্য এদের ধাতে নাই। আগেই ভাল মন্দ নির্ধারণ করে দিয়ে নিজে ন্যায়ের পরাকাষ্ঠা সাজার হীন চেষ্টা করে বসেন। আর রাষ্ট্র ও রাজনীতি চিন্তা এখনও বিদ্যাসাগর বা রবী ঠাকুরের আছড় কাটাইয়ে ওঠতে পারে নাই। যা হোক আমরা ফ্যাসিবাদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে পাব না। মানে দার্শনিক দিক থেকে বিষয়টি যতটা অবিনিবেশ দাবি করে তা এখানে করব না। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের ধরণ বুঝবার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক আলোচনার মধ্যেই সীমিত থাকব।
প্রথম কথা হলো ক্লাসিক অর্থে ফ্যাসিবাদ বলে যা বুঝায় বাংলাদেশে তা নাই। সম্ভব না। তাই প্রশ্ন করতে হবে এতো ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিবাদ শুনি কেন? এইখানে ফ্যাসিবাদের ধরণটা হল উপনিবেশী চিন্তা ও রুচি নির্ভরতা। এর রুট বাংলাদেশের মাটিতে না। এটা উনিশ শতকের কলকাতার যে রেনেসা এবং এর ভেতর দিয়ে যে হিন্দু যা মূলত ব্রক্ষ্মণ্যবাদি জাগরণ আকারে হাজির হয়েছে তার বয়ানের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের আত্মপরিচয়ই এখনও পরিস্কার হয়নি ফলে এর দ্বারা ফ্যাসিজম কায়েমের কোন সম্ভাবনা নাই। কিন্তু এর অদ্ভুত রকম শাসনতান্ত্রিক বিকার ঘটেছে। এটা এই রাষ্ট্রের শুরুর আমল থেকেই ঘটেছে। সর্বশেষ তথাকথিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে। এটা কে আমি ফ্যাসিবাদ বলি সাংস্কৃতিক অর্থে। এটার নাম দিয়েছি কালচারাল-ফ্যাসিজম।
মনে রাখতে হবে ফ্যাসিবাদ আলোচানার বিষয়ে পরিণত হয়েছে দুইটা বিশ্ব যুদ্ধের পরে। দুইটা বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্যেই ক্লাসিকাল ফ্যাসিবাদের আলোচনার ভিত্তিভূমি তৈয়ার হয়েছে। যার সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কোনো মিল নাই। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম একটা রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হয়েছে কিন্তু এই যুদ্ধ এক দিকে যেমন মহান মুক্তিযুদ্ধ অন্য দিকে বিপুল সাধারণ মানুষ সময়টাকে চিহ্নত করে গণ্ডগোলের সাল বলে। এই কথাটা বিশেষভাবে বললাম জাতীয় চেতনার কমিউনাল চরিত্রকে সহজে বুঝবার জন্য। অন্যদিকে ক্ল্যাসিকাল ফ্যাসিজমে যেটা খুব জরুরি তা হলো এমন একটা টোটালেটিরিয়ান বা সমগ্রতাবাদি আচরণ যার নিরিখে অন্যকে আলাদা করা, শত্রু জ্ঞান করার তীব্র আচরণ হাজির থাকে। এই অপরকে বিনাশ করার জন্য শুধু সাংগঠনিক শক্তি থাকলেই তাকে ফ্যাসিবাদ মনে করার কোন কারণ নাই। এর মতাদর্শিক জোড়টাই আসল কথা। আমাদের মনে রাখতে হবে। মতাদর্শও অস্ত্র। খুব গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। সেই দিক থেকে বাংলাদেশ তো দূরের কথা বাংলাদেশ যার সাস্কৃতিক উপনিবেশ সেই ভারতেও ফ্যাসিবাদি শক্তি আকারে হাজির হবার কোন শর্ত নাই। ভারতের সমাজে মুসলমানকে বাহিরের শক্তি এবং এনিমি আকারে দেখা হয়। এর পরেও তার টোটালিটি নিয়ে সে দাঁড়াতে পারে নাই। তাকে বিশ্ব পুঁজির সাথে তালমিলিয়ে চলতে হয়। ফলে ভারতে সমাজের ভেতরে যেটা রয়েগেছে সেটা হলো কমিউনালিটি। এই কমিউনালিটির ভয়াবহতাকেই লোকে বলে সাম্প্রদায়িকতা। আমি বলি এটা পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স। কারণ এই সব কমিউনিটি কখনও মতের ভিন্নতার জন্য রক্তা-রক্তি করেছে এমন নজির নাই। প্রতিটি ভায়োলেন্সের সাথেই ক্ষমতার রাজনীতির সম্পর্ক আছে। এটা বাংলাদেশের দিকে তাকালে আরও ভাল বুঝা যাবে। সমাজের মধ্যে মত-ভিন্নতা আছে কিন্তু এই ভিন্নতার কারণে রক্তরক্তি হয় না। মানে সমাজের মৌল প্রবণতাকেই সাম্প্রদায়িক বলা যাবে না। কেন না নানা কারণে কমিউনিটি টু কমিউনিটি– চিন্তা, আদর্শ বা আচরণের ভিন্নতা হতে পারে। এর আলোকে কোন কমিউনিটি যদি সংগঠিত হয় এবং রাজনীতিতে হাজির হয় তাইলে এটাকে খুব স্বাভাবিকই বলতে হবে। আর এতে এক কমিউনিটি অন্য কমিউনিটিকে শত্রু মনে করে বলপ্রয়োগে নামলে তাকে হোলসেল সাম্প্রদায়িকতা বলা যাবে না। এটা রাজনীতির স্বাপেক্ষে যখন হয় তখন আর এটা সাম্প্রদায়িকতা থাকে না। এটা তখন হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক বলপ্রয়োগ। এক গোষ্ঠী আর এক গোষ্ঠীর ওপর এই বলপ্রয়োগ করে। এটা পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স। যা হোক এটা নিয়ে আরেক লেখায় আলাপ করেছি।
বাংলা ভাষায় ফ্যাসিবাদ নিয়ে আলোচনা অনেক দিনের। এই বিষয়ে প্রথম প্রকাশিত বই হলো, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ফ্যাসিজম’। ১৯৩৪ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের মার্কসবাদি আন্দোলনের পথিকৃতদের একজন। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা দিশারি তুল্য। নাৎসিবাদের ঝোড়ো উত্থানের সময় তিনি ছিলেন জার্মানিতে। তিনি নাৎসি মতাদর্শ ও সাহিত্য ভালভাবে পড়েছেন তা তার লেখায় স্পষ্ট বুঝা যায়। তার বইটি পড়লে অবাকই হতে হয়। তিনি মার্কসবাদি ছিলেন ফলে মার্কসবাদের আলোকে সেই সময়ে তিনি ফ্যাসিবাদকে যে তরিকায় দেখেছেন আজকের এইদেশের মাকর্সবাদিরা এর চেয়ে খুব বেশি আগাইছে এমনটি মনে হয় না। এমন কি আমাদের তুখোর বুদ্ধিজীবীরাও তাকে ছাড়াতে পারেননি। কিন্তু ফ্যাসিবাদের তর্কটা আর সেই জায়গায় থেমে নেই। এর এতো বিস্তৃতি ঘটেছে যে আমদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা সেই তুলনায় খুব পশ্চাৎপদই রয়ে গেছেন। অন্য মার্কসবাদিদের মতো তিনিও মনে করতেন শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবের দ্বারা জাতীয়তাবাদি আন্দোলনের অভিমূখ ঘুরিয়ে দিয়ে ন্যাশনালিজম ভায়া হয়ে যে বিকট ক্ষমতার উত্থান হয় সেই ফ্যাসিজমের থাবাকে ঠেকিয়ে দিতে হবে। এবং বুর্জোয়াদের কে ফ্যাসিজমের জন্য দায়ী মনে করতেন। বুর্জোয়ারা ফ্যাসিজমের পক্ষে থাকে এটা কম বেশি বিভিন্ন সমাজে দেখা গেছে।
কিন্তু খোদ মার্কসবাদে ফ্যাসিজম নিয়ে আলোচনার অন্য খামতি আছে। লেলিন ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ লিখছেন কিন্তু ফ্যাসিজম নিয়ে তিনি কোনো আলাপে গেলেন না। এটা হতে পারে সেই সময়ে এই ইস্যু হাজির করা সম্ভব হয়নি। মার্কসবাদের ঘরে এই বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন কাউটস্কি।যদিও আমরা তাকে হোল সেল এনারকিস্ট বলে তার চিন্তার প্রতি কখনও মনযোগী হয়নি। এটা আমাদের মার্কসবাদিদের দৈন্যতাকে আরও প্রকট করেছে। ফ্যাসিজমের আলোচনায় এদের আর কোনো পটেনশিয়াল ভূমিকা নাই। এরা নিজেরা ভিষণ রবীন্দ্র-প্রবণ হয়ে সরা-সরি ফ্যাসিবাদের খাদেমে পরিণত হয়েছে। যে কারণে সৌমেন্দ্রনাথ থেকে আলোচনা শুরু করেছি তা বলে নিই। সৌমেন্দ্রনাথ যেমন মার্কসবাদের ভেতর থেকে ফ্যাসিজমকে দেখেছেন, বিরোধীতা করেছেন এমন দেখা-দেখি ও বিরোধীতা আজও জারি আছে। অন্য দিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সময় যে ভূমিকা নিয়েছেন তা আজ আরও ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। এরা রবীন্দ্রনাথের ঘারে চড়ে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের সৈনিক হয়েছে বাংলাদেশে। এর অরিজিন খোদ রবীন্দ্রনাথে হাজির আছে।
নাৎসিবাদের পক্ষে সাফাই গাইবার কারণে রবীন্দ্রনাথকে মাকর্সবাদিরা কম হেনস্থা করেননি। এটা আজও জারি আছে। আমি এটা মার্কসবাদিদের মতো করে দেখতে চাই না। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্র চিন্তার সাথে যদি আমরা বুঝা-পড়ার চেষ্টা করি তাইলে দেখব এটা খুব স্বাভাবিক প্রবণতাই। দিপেশ চক্রবর্তী তার ন্যাশন এন্ড ইমাজিনেশন প্রবন্ধে এটা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছেন। তিনি রবীন্দ্র ন্যাশনালিজমের ফিলেনথ্রপিক আদর্শকে ক্রিটিক করে একে প্রবলেমেটিক বলে সাবস্ত করেছেন। কাব্য, চিন্তা, কল্পনা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গের দুর্দান্ত বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্র চিন্তায় রাবীন্দ্রিক দৈন্য দশা উদাম করে দেখিয়েছেন। আমি সে দিকে যাব না। বাংলাদেশের মানুষ চিন্তায় অতি মাত্রায় সাহিত্যগ্রস্ত হওয়ার ফলে এখানে ফ্যাসিজম একটা কালচারাল লড়াইয়ে রুপ নিয়েছে সহজেই। সাংস্কৃতিক প্রশ্নে রক্তা-রক্তির ঘটনা ঘটছে। কোনো নতুন রাজনীতি জন্ম নিচ্ছে না বাট রক্ত ঝরছে নানা ছলে।
সৌমেন্দ্রনাথ ১ নভেস্বর ১৯৩৩ সালে প্যারিস থেকে রবীন্দ্রনাথ কে লিখছেন, ‘তুমি নাৎসিবাদের সমর্থনের দ্বারা ইয়োরোপের ইন্টেলেকচুয়াল কেন্দ্রে তোমার বিরুদ্ধে যে তীব্রতা জাগিয়ে তুলেছ সেই সম্বন্ধে তোমাকে জানিয়ে দেওয়ার জন্যই এই চিঠি লেখা।…..
তোমার বিরুদ্ধে যে-আক্রমণ গজিয়ে ওঠেছে তার প্রধান পয়েন্টগুলি হচ্ছে, তুমি যদি না বদলে থাক, তা হলে তুমি জার্মান ফ্যাসিজম যা আজ নাৎসিবাদের নাম নিয়েছে তার সমর্থন কোন মতেই করতে পার না।…..
তোমার উক্তির তীব্র প্রতিবাদ তো হবেই, শুধু তাই নয় তোমার নামের সঙ্গে এই অপবাদ চিরকালের মতো জড়িয়ে থাকবে….। [ ঠাকুর-ফ্যাসিবাদ, পৃষ্ঠা ৯৫, মনফকিরা প্রকাশনী,কলকাতা]
সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ফলে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এই চিঠির বক্তব্যের সাথে একমত হবেন না। রবীন্দ্রপ্রবণ ভক্তকূলও এর প্রতিবাদ করবেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমি যা বলতে চাইছি তা বাদ-প্রতিবাদের ধার আর ধারবে না। এই রবীন্দ্র চেতনার আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে সম্পর্ক তার সাথে সোনার বাংলার মিথ ও ভাষার আধিপত্যবাদি অনুরাগ আজ সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। এই জাহেলি জুলুম বাজের ‘কাল’কে বৈধতা দেবার জন্য সাংবিধানিক যুক্তিও তৈয়ার করেছে। এই কালচারাল ফ্যাসিবাদ ক্ষমতার স্বাদ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার জন্য যে আমলের সূচনা করেছে এরই নতুন নাম হলো সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ। এর সাথে বিশ্ব পুঁজি, জাতীয় চেতনা, বিজ্ঞাপনী ভোগ সংস্কৃতি, মধ্যবিত্ত চৈতন্যের গণবিচ্ছিন্নতা, ৭১ এর মিথ, পরিকল্পিতভাবে ঘৃণার সংষ্কৃতি তৈরি -এই সবের সম্পর্ক অতি জটিল রুপ নিয়ে জড়িয়ে আছে। এই সবের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কটা এতো জটিল আকারে জাড়িয়ে আছে যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা যে ভালবাসব তার সুযোগ আর পাচ্ছি কই। রবীন্দ্রনাথের নামে আজ রক্ত ঝরে। রবীন্দ্রনাথ কি করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ফ্যাসিবাদি সাংস্কৃতিক শক্তিতে পরিণত হলো তা খতিয়ে দেখা অতি জরুরি কাজ আকারেই হাজির হয়েছে। আমি নিজে রবীন্দ্র ভক্ত মানুষ। কবি হবার কারণে রবীন্দ্রনাথের সাথে এক ধরনের সম্পর্কও ফিল করি। তথাপি রক্তঝরানো রবীন্দ্রনাথকে এখন সাফ-সুতোরো না করলে আর উপায় নাই। যা হোক রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদের সমর্থক ছিলেন এটা প্রমাণ করা আমার প্রকল্প না। আমি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের রুট খুজতেছি। এর অপজিটে অনেকে বলবেন তাইলে তো ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ বলে একটা ব্যাপার আছে। এটা চিনপন্থি মার্কসবাদিদের পপুলার থিসিস। আমি বলব এরা ফ্যাসিজমের তর্ক করার তরিকায়ই জানে না। ধর্মের সাথে ফ্যাসিজমের তর্ক এক করে করা যাবে না। তবে ধর্মের কোনো কোনো ইন্টার পিটেশনকে ফ্যাসিবাদি কাজে ব্যবহার করার নজির বেশ পুরানা। কিন্তু খোদ ধর্ম ফ্যাসিবাদের আছড়ে নাই। কারণ ধর্মের সাথে ডিভাইনিটির যে যোগ তা ফ্যাসিবাদের সাথে যায় না। ফ্যাসিবাদ ইহলৌকিক সঙ্কল্পের মধ্যে জন্ম নেয়। আমরা যদি ফ্যাসিবাদের দার্শনিক ইতিহাস খেয়াল করি তাইলে বিষয়টি পরিস্কার দেখতে পাব। তখন মার্কসবাদিদের খামতিও চোখে পড়বে।
প্রথমে আমার যদি দেখি মার্কসবাদিরা ফ্যাসিজমকে কিভাবে বুঝেছে তাইলে পুরো ব্যাপারটি সহজেই ধরে ফেলতে পারব। স্বীকার করতে হবে ফ্যাসিবাদের তাত্ত্বিক আলোচনায় মার্কসবাদিদের অবদান অসামান্য। কিন্তু কর্পোরেট ক্যাপিটালিজমের মধ্যে এসে তারা দেখলো এতো দিন তারা যা বলে এসেছে তা তো আর কাজ করছে না। তারা যে টোটালিটিরিয়ান এপ্রোচের কথা বলেছে তা তো সাম্রাজ্যবাদ বা পুঁজি নিজ বৈশিষ্ট্যগুণেই ধারণ করে। তাইলে ফ্যাসিজমের তর্কটা যেভাবে তারা জাতীয় আন্দোলনের সাথে শ্রমিক শ্রেণিকে হাজির করার মধ্য দিয় উৎরে যেতে চেয়েছেন তা তো ফেইল করেছে। খোদ রাশিয়াতে শ্রমিক বিপ্লবের পরে উত্থান ঘটেছে ভয়াবহ সমাজতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদের। তখন পোস্টমর্ডান এরেনার অনেক তাত্ত্বিক সাইকোলজির আলোচনা করে মার্কসবাদের মধ্যে ফ্যাসিবাদের আলোচনার পদ্ধতিগত খামতি দূর করার চেষ্টা করেছেন। এতে মেথডলজিক্যাল মাত্রা যোগ হয়েছে সন্দেহ নাই কিন্তু ফ্যাসিজমকে মার্কসবাদ দিয়ে মোকাবেলা করা যাবে এই বিশ্বাস বা নজির কায়েম হয় নাই।
বিশেষ করে বলতে হবে, রাষ্ট্রে এবং জাতীয়তাবাদের ধারণার সাথে ফ্যাসিবাদকে যেভাবে একসাথে আলোচনা করা হয় তা এখন ইরিলিভেন্ট। কারণ রাষ্ট্র এখন আর ষাটদশকের রাষ্ট্র ধারণায় আটকে নাই। টেকনোলজি আর কর্পোরেট গ্লোবাল ওয়াল্ড অর্ডার এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে হিটলার বা মুসুলিনি টাইপের ফ্যাসিজমের দিন শেষ। স্টেট মেশিনারির ভূমিকাটা অতি ফাংশনাল। এর ইডিওলজিক্যাল স্টেন্থ বা বল আর বাস্তব কারণেই এতো জোড়ালো হবে না। সে যতো মহান জাতীয়তাবাদই হোক। কনজিওমার কালচারাল সোসাইটিরর সাথে আধুনিকতার যোগ এর সাথে বিজ্ঞাপনী স্বদেশ প্রেম মিলে বড়জোর একটা সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজম তৈরি হতে পারে। যেটা বাংলাদেশে হয়েছে। কিন্তু এর ভবিষৎ অতি করুণ পরিণতিতেই শেষ হবে। কারণ নতুন রাজনৈতিক চৈতন্য দাঁড়ানোর সাথে সাথে এই সাংস্কৃতিক আধিপত্য ধসে যাবে। সেটা যদি বুর্জোয়াও হয় তাও এই সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজম দাঁড়াতে পারবে না। কোন কারণ নাই। এখন মিডিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তথাকথিত প্রজন্ম দেখে আমরা যদি ভড়কে যাই তাইলে খুব হাস্যকর হবে ব্যাপারটা। শাহবাগ গোটা বাংলাদেশ না।
এই ধরনের ফ্যাসিজম লিবারিলজমকে উৎসাহিত করে। গণতন্ত্রের কথা বলে, উন্নয়নের কথা বলে। এর আসল গোমরটা হলো, “Fascism steals from the proletariat its secret: organisation. … Liberalism is all ideology with no organisation; fascism is all organisation with no ideology.” (Bordiga)
শ্রমিকরা দ্রুতই লিবারাল জাতীয়তাবাদি আদর্শের দিকে ফিরে আসে, তাদের সাংগঠনিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যে অবস্থা গড়ে ওঠে তাকে লিবারাল বলা হলেও, এই লিবারাল শক্তি যখন ক্ষমতার ধারক-বাহক হয়ে ওঠে তখন আর তার কোনো আদর্শ থাকে না। সাংগঠনই তার এক মাত্র ভরসা। সেই দিক থেকে কোনো রজনৈতিক দল যদি মনে করে যে দেশে একমাত্র তারাই থাকবে আর কারো থাকার দরকার নাই তাইলে তাকে ফ্যাসিস্ট বলা হয়। এই প্রবণতায় বাংলাদেশ জন্মের সময়ই আওয়ামী লীগ আক্রান্ত হয়েছিল। পরে এর করুণ অবসান আমরা দেখেছি। এখনকার বাস্তবতায় কোনভাবেই আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নাই। সেই মতাদর্শিক শক্তি যেমন নাই। লোটপাটের রাজনীতির কারণে সাংগঠনিক কাঠামো দিয়েও ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখা যাবে না। ভারসা পুলিশ-র্যা ব-সেনা। যা এখন চলছে। সারাদেশের মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের নেতারা গণ প্রতিরোধের মুখে পড়ছেন। পুলিশের রাইফেলের নলের ওপর ক্ষমতা টিকে আছে। এটা অতি মামুলি সরকারের নমুনা। একটা সাধারণ জনপ্রতিরোধই এটা ধসিয়ে দিতে পারে। ফলে ফ্যাসিজম বলতে যে অতি সংগঠিত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর সার্বিকীকরণ বুঝায় তার কোনো বৈশিষ্ট্যই এখানে হাজির নাই।
সবচেয়ে বড় কথা হলো ফ্যাসিজমের জন্য ‘অপর’ বা মোরল এনিমি লাগে। এটা বাংলাদেশে সম্ভব না। অন্তত আওয়ামী লীগ কোনো মোরাল এজেন্সি আকারে হাজির হতে পারবে না। এই ক্ষেত্রে তার একমাত্র ভরসা ৭১ এর চেতনার সাথে ডিজিটালইজড কালচারের উল্লম্ফনকে উন্নয়ন বলে চালু করা। এটা করাও হয়েছে। কিন্তু এই ধারাটা সাবস্ত্য হয়েছে নাস্তিক্যবাদি ধারা বলে। ব্লগ বা কম্পিউটার টেকনোলজির ধারক-বাহকরা যে চৈতন্য নিয়েই হাজির হোক না কেন জনসমাজে এরা ধর্মদ্রোহীর সিল খেয়ে গেছে। শাহবাগ এই অবস্থার তৈয়ার করেছে। ফলে বিজ্ঞাপনী স্বদেশ প্রেম ও চেতনার ঢোল দিয়ে ক্ষমতার বৈধতা পাওয়া যাবে না। জনসম্মতি এই চেতনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নতুন শক্তির অপেক্ষায় আছে। আবুল মনসুর আহমদ অনেক আগে যেটা বলেছেন তা খুব খাঁটি কথা। তিনি আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘বাংলাদেশ পরিচালনার ভার এমন সব অতি-প্রগতিবাদি লোকের হাতে পড়িতেছে যারা ইসলামী রাষ্ট্র আর মুসলিম রাষ্ট্রের পার্থক্য বুঝেন না বা বুঝিতে চাহেন না।’
এই সমাজের বহুত্ববাদি ধারা এতো পাশাপাশি থাকে যে এই সমাজে কমিউনাল আচরণই রুটেট হয় নাই। যে কারণে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ এখানে সুবিধা করতে পারেনি। ফলে ঐতিহাসিক বাংলাদেশের দিক তাকালে আমরা দেখব এখানে ক্লাসিক অর্থে ফ্যাসিবাদ সম্ভব না। হতে পারে না।কতিপয় ফেটিশ মিডেলক্লাস ভোগবাদি আধুনিক চেতনার সাথে কর্পোরেট জাতীয়তাবাদির চেতনার আলোকে যে সাংস্কৃতিক বিভাজন তৈরি করেছে তাকে অকাট্য সত্য আকারে ধরে নেবার কোনো মানে হয় না।
মার্কসবাদিরাও যে এই সাংস্কৃতিক বিভাজন এর রাজনীতি বুঝেন না এমন নয়। তারা বার বারই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা বলে আসছেন। কথা হলো আধুনিকতার কোনো পর্যালোচনা না করে কি করে আপনি মার্কসবাদ দিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লব করবেন? মার্কসের অরিয়েন্টাল প্রবলেম তো আর অজানা নয়। ধর্ম ও রাষ্ট্র প্রশ্নে মার্কসের চিন্তার খামতিগুলো তো আপনাকে আগায় নিতে পারবে না। এই দিকগুলা নিয়া এখনও যথেষ্ট আলাপ হচ্ছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ কথাটা অনেক বেশি মিসইউজ করা হয়। খুব বেশি রেটিরিক্যাল ব্যবহার হয়েছে কথাটার।
‘ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ’ বইতে ফরহাদ মজহার যে আলোচনা করেছেন আর ১৯৩৪ সালে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে আলোচনা করেছেন তার তরিকা বা পদ্ধতি প্রায় একই। আমরা এই দুই আলোচনার গুরুত্ব স্বীকার করে বিষয়টিকে আর বিষদভাবে বুঝার চেষ্টা করছি।
ফরহাদ মজহার বলছেন, ফ্যাসিবাদ শ্রমিক শ্রেণির গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে। তিনি মনে করেন ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদি ব্যবস্থার অর্থনৈতিক সঙ্কটও বটে। ফ্যাসিবাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদি উগ্রতা অনিবার্য বলে তিনি মনে করেন। তিনি মার্কসিস্ট জায়গা থেকে বেশ জোরালো আলোচনা করে ডিজিটাল ফ্যাসিবাদের আছড় ব্যাখ্যা করেছেন। এই ব্যাখার সাথে অনেকে দ্বিমত করতে পারেন। আমি এই ব্যাখ্যার রেটরিক্যাল পয়েন্টের সাথে একমত আছি। কিন্তু এসেনশিয়াল আর্গুমেন্টে আমি অন্য জায়গা থেকে তর্ক তুলব।
রাষ্ট্র,গণতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদের সম্পর্ক নিয়া পুরোনো ধাচের আলোচনায় আর কোনো ফায়দা হবে বলে মনে হয় না। গণতন্ত্রের শাসনতান্ত্রিক ফাঁকি এখন সুবিদিত। কেউ আর গণতন্ত্রকে আদর্শ ধরে রাষ্ট্রের আলোচনা করেন না। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৪ সালেই বলেছেন, ‘ফ্যাসিস্টদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা করায়ত্তকরণকে বিপ্লব বলে অভিহিত করলে থিওরেটিক্যাল নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেওয়া ছাড়া কিছুই হবে না। শ্রমিক-বিপ্লবকে বিধ্বস্ত করে বুর্জোয়াদের ক্ষমতা বজায় রাখাই ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এবং আজও আছে।’ [ঠাকুর, ফ্যাসিজম পৃষ্ঠা ২০]
ফলে মার্কসবাদের রাষ্ট্র সম্পর্কে যেমন অমীংসা রয়ে গেছে তেমনি ফ্যাসিজমকে দেখবার ধরনেও গলদ রয়েগেছে। তারা মনে করেন জাতীয়তাবাদি আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির গণতান্ত্রিক ক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিজম ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু এই অবস্থার স্বপক্ষে এখন আর কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বিখ্যাত চিন্তক, দার্শনিক আলী শরিয়তী বিষয়টি বেশ ভাল ভাবেই ধরতে পেরেছেন। শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বকে তিনি ফ্যাসিজমের সাথে মিলিয়ে পাঠ করেন। তিনি মনে করেন,‘মার্কসবাদ ও ফ্যাসিবাদ উভয়ে শ্রমিকশ্রেণের দিকে না ঝুকে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অন্বেষণ করেছে। তাই মধ্যবিত্ত বুর্জোয়ারাই এটির অনুগামী হয়েছে ব্যাপকহারে।’
[ ম্যান মার্কসিজম এন্ড ইসরাম-আলী শরিয়তী]
এখন লেলিন বলছেন শ্রমিক শ্রেণি বাইডেফিনেশন পেটি-বুর্জোয়া। তাইলে এরে দিয়া ফ্যাসিবাদ ঠেকানো তো দূরের কথা উল্টাটাই হয়। এরা জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে যে তাড়না থেকে ঝাপিয়ে পড়েন, পরে তার বাসনাই তাকে ফ্যাসিবাদে শরিক করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরর্বতী সময়ে রক্ষী বাহিনী সাংবিধানীক জুলুমবাজি শুরু করলে নগদ সুবিধার লোভে অনেক মানুষ এতে শরিক হয়েছিল।
আমারা দেখলাম মার্কসবাদ এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারেনি। আমাদের এখানেও ফ্যাসিবাদ প্রশ্নে আলোচনা খুব বেশি আর আগায়নি। এখানকার অবস্থা আরও ভয়াবহ। মুজিবের হাতে মাওবাদিদের নিধন শুরু হয়েছিল এটা বিএনপিও কনটিনিও করেছে, ক্রসফায়ার করে কমিউনিস্ট খতম করেছে। আর অন্য বামগুলা কম বেশি সরকারি বামে পরিণত হয়েছে। যারা বাইরে আছে তারা মুখে বলে দুনিয়ার মজদুর কিন্তু চর্চা করে এলিট সংস্কৃতি। তাদের সাহিত্য থেকে শুরু করে জীবন যাপনে গণবিচ্ছিন্নতার খুপড়ি কালের অভিশাপের মতো আঁটা। জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম তা গণতন্ত্রের নামে বা সমাজতন্ত্রের নামে যে ভাবেই চালু হোক না কেন তার ফ্যাসিবাদি একটা রোল কয়েক দিনের মধ্যেই চাড়া দিয়ে ওঠে। এটা পৃথিবীর নানা দেশের ইতিহাসের দিকে বা শাসনতান্ত্রিক খামতির দিকে তাকালে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারব। এর সাথে সাম্রাজ্যবাদ, গণতন্ত্র, ওয়ার অন টেরর ও কর্পোরেট জাতীয়তাবাদের মিশেলের কারণে ফ্যাসিবাদের তর্কটা ক্লাসিকাল বা কেসেলে ধারার মধ্যে রেখে দিলে এখন আর কিছুই বোঝা যাবে না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাসনা ও সিভিল সমাজের বিকৃত খায়েসের কারণে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদই সাংস্কৃতিক মূলধারা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। মিডিয়া ও সংস্কৃতি নিয়ে আগের আলোচনা যারা খেয়াল করেছেন তারা বিষয়টি এতো দিনে পরিস্কারভাবে ধরে ফেলেছেন বলেই তা আর লিখছি না। এবার আমরা সংক্ষেপে ফ্যাসিবাদের গোড়ার আলোচনার দিকে ফিরব।
ফ্যাসিবাদের আলোচনা কতগুলো ফ্যাশন্যাবল স্টুপিডিটির জন্ম দিয়েছে। এই স্টুপিডিটির আবার দুইটা দিক আছে। এক. তাত্বিক উৎস নিয়া বিভ্রান্তি(মনে করা হয় মহান জার্মান দার্শনিক ফ্রেডারিক নিৎসে এইটার জনক) দুই. ঐতিহাসিক বিকাশধারা হিসেবে এবং আদর্শগত দিক থেকেও ইতালি এবং জার্মানিকে সব সবময় নজির আকারে পাঠ করা হয়।
ফ্যাসিবাদের আসল আদল খুঁজতে হবে মানুষের আচরণগত ও নিজের সম্পর্কে নিজের ধারণার মধ্যে। বা আমরা অন্যের সাথে কি ভাবে সম্পর্ক করি তার ধারণা ও ধরণের মধ্যেই ফ্যাসিবাদের হদিস করতে হবে। পরে এর সাথে নানা কিছুর যোগ আমরা খতিয়ে দেখতে পারব। সেটা প্রাসঙ্গিকও বটে।
পশ্চিমে রেনেসা বিপ্লবের কালে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের পরম বিকাশের কালে ফ্যাসিবাদের সম্ভাবনা প্রথম যার হাতে বুনিয়াদি ভিত্তি লাভ করে তার নাম, ডেভিড হিউম। তার ১৭৩৯ সালে প্রকাশিত ‘মানবের প্রকৃতি’ বইটির উপ শিরোনাম ছিল নৈতিক বিষয়ে যুক্তির পরীক্ষামূলক পদ্ধতির সূচনার চেষ্টা। হিউম কে মনে করা হয় বুদ্ধিবাদি চিন্তক। কিন্তু তার বুদ্ধিবাদ এরিস্টটলীয় নয়। তিনি বেকন পন্থি। তিনি বিজ্ঞানকে ধর্মতত্ত্বের মতো ভ্রমাত্মক মনে করতেন। দেকার্ত যে যুক্তির জগৎ হাজির করেছেন তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দর্শনের নতুন দরজা খুলে দেন হিউম। তিনি যুক্তির জগৎকে হোলসেল মেনে নেননি। তিনি মনে করেন, আমাদের কর্মের নিয়ামক যুক্তি নয় আবেগ এবং আবেগের অনুবর্তী হওয়াই যুক্তির একমাত্র কাজ। তার বইয়ের শুরুতেই তিনি আবেগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি ‘প্যাশন’ শব্দটিও ব্যবহার করেছেন। তিনি আবেগ অর্থেই এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। হিউম রাষ্ট্র ধারণার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে প্রায় সুপার পাওয়ার টাইপের কোনো শক্তি এবং সব রকম কর্তৃত্ব কায়েমের হাতিয়ার মনে করতেন। সেই দিক থেকে তার চিন্তার মধ্যে ফ্যাসিবাদের উপাদান খুঁজে পেয়েছেন পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাসবিদরা। কিন্তু তার চিন্তার গুরুত্ব এতই যে কান্ট বলেছেন, হিউম তাকে র্নিবিচারবাদি তন্দ্রা থেকে জাগিয়ে দিয়েছেন।
হিউমের মধ্যে যে উম্মদগ্রস্ততা ছিল তা পরবর্তী সময়ে ফিরে এসেছে। হিউমের দর্শনের সরাসরি প্রতিক্রিয়া হিসেবে হাজির হন কান্ট। তিনি বিশুদ্ধ যুক্তি খোঁজ করলেন। কান্টের অনুসারী বিখ্যাত ফিশতে দর্শন থেকে রাজনীতিতে এসে শুরু করলেন ‘জাতীয় সমাজতন্ত্র’। এই বাদ-বিবাদের মূলে যে জিনিসটি নিয়ে এতো জল ঘোলা হলো তার নাম হলো যুক্তি। যুক্তি দিয়ে পরম সত্যে পৌঁছানোর দার্শনিক এক দুর্দান্ত লড়াই চলেছে পুরো সময়টা জুড়ে। পশ্চিমা দার্শনিকরা মনে করেন এই বাদ-বিবাদে যুক্তি যতই পিছে হটেছে ততই ফ্যাসিবাদের সম্ভাবনা বেড়েছে দার্শনিক ভাবে। এই দার্শনিক তর্কের মধ্যে যুক্তি বিরোধী শিবির যখন মুক্তি নয় ক্ষমতার প্রশ্নে নিজেদের চিন্তার অভিমুখকে তাতিয়ে তুলল তখনই ফ্যাসিবাদের বিকাশ সম্ভব হয়ে উঠল। এমনটাই মনে করেন পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাসবিদরা। আধিপত্য করার বাসনা থেকে জড়িত হয়ে পড়েন রাজনীতির সঙ্গে। এই তালিকাতে আছেন, ফিশতে, কার্লাইল, মাৎসিনি, নিৎসে। এদের মধ্যে নিৎসে হলেন সবচেয়ে শক্তিশালী দার্শনিক। তার মতে মানবতা হলো একটি পরীক্ষামূলক বস্তু। তার প্রস্তাব হলো, পর্যাপ্ত মহৎ শক্তি অর্জন করা। ঢালাওভাবে যে ভাবে নিৎসে কে ফ্যাসিবাদের জনক মনে করা হয় তা ঠিক না। তিনি দার্শনিক হিসেবে অতিগুরুত্বপূর্ণ জেনিওলজি ধারণার পয়দা করেছেন। ইতিহাস ও ভবিষৎ কে নির্মাণের পদ্ধতিগত চিন্তার জন্য তিনি আজও যথেষ্ট গুরুত্ব দাবি করেন। অনেকে মনে করেন তিনি যেহেতু ইচ্ছা, অনুভূতি এবং সুখের চেয়ে ক্ষমতার আলোচনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন তাই তিনি ফ্যাসিবাদের প্রস্তাব করেছেন। এতো সরল হিসাবে দেখলে আমারা কিছুই ধরতে পারব না। আমি সাধারণ একটা লাইনআপ দেখালাম। এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার দরকার আছে।
৯০ এর দশকের পরে ফ্যাসিবাদের আলোচনায় ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গিগত পরির্বতন এসেছে। এখন ফ্যাসিবাদ কে শুধুমাত্র আর ইডিওলজির মামলা আকারে দেখা হয় না। এখন বরং মাস-মুভমেন্ট ও এর সাথে আদর্শের সম্পর্কের মধ্যে ফ্যাসিজমের আলোচনা করা হয়। এই বিষয়ে গুরুত্বপুর্ণ আলোচনা শুরু করেছেন ডেভি রেনটন। আদর্শ এবং মাসমুভমেন্ট কি ভাবে ফাংশন করে সেই দিক থেকে ফ্যাসিজমকে বুঝার প্রস্তাব করেছেন রেনটন। তিনি মনে করেন, Fascism should not be understood primarily as an ideology, but as a specific form of reactionary mass movement.
সব মুভমেন্টকে বিচার না করেও আপাদত খালি শাহবাগকে বিচার করলেই এখনকার ফ্যাসিবাদের চরিত্র উদাম হবে। ছোট্টো একটা উদাহরণ দেই, রবীন্দ্রনাথের ন্যাশন কি ভাবে পরে মাতৃতান্ত্রিক ফ্যাসিজমের হাতিয়ার হলো তা দেখতে পারা ইন্টারেস্টিং কাজ হতে পারে।
দিপেশ চক্রবর্তী যেমন বলেন, The prosaic and the poetic thus came to share a division of labor in Tagore’s writing…
The golden bangla of nationalist sentiments. [ Nation and Imagination]
পরে আমরা দেখলাম বিভিন্ন আন্দোলনে এই সোনার বাংলা মিথ হাজির হলো। দেশকে মা, পবিত্র ভূমি, স্বর্গ হিসেবে উপস্থাপনার যে রেওয়াজ জারি ছিল তার হাত ধরে আমরা শাহবাগে দেখলাম মাতৃতান্ত্রিক ফ্যাসিজমের দূর্বল মহড়া। জাহানারা ইমাম কে দেখলাম জাতির মা হতে। তরুণরা সব রুমি হতে গড়ে তুলল ‘রুমি স্কয়ার্ড’-এই সব ঘটনা আমরা সেকেলে ফ্যাসিবাদের ধারণা দিয়ে ব্যাখা করতে পারব না। এর জন্য বিজ্ঞাপনী স্বদেশ প্রেমের সাথে উপনিবেশী ভোগবাদি সংস্কৃতির যে হেজিমনি বা আধিপত্য গড়ে ওঠেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে কেন্দ্র করে তার হদিস করতে হবে। এই রুমিরা ভিষণ রকম রবীন্দ্রপ্রবণ। তাদের অস্তিত্বের মর্মমূলে রবীন্দ্র চেতনা সব সময় জেগেই থাকে। এরা ঘুমায় না! রবীন্দ্র নেশন তো পরাজিত হয়েছে দিল্লির কাছে। বেঁচে আছে এর কালচারাল আক্রোস। যা বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক উপনিবেশ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। এর সাথে কর্পোরেট দেশ প্রেম, মূলধারা, মিডিয়া, ৭১ ও ভাষা মিলে এটা এখন কালচারাল ফ্যাসিবাদের রুপ নিয়েছে বাংলাদেশে। যেহেতু রাষ্ট্র গঠনের বুনিয়াদি কাজ এই বাঙালি চেতনা করতে পারেনি ফলে এর সম্ভাবনাও দিন দিন দূর্বল হচ্ছে। মিডিয়া ও সিলি-সিভিল সমাজের ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠী এর প্রাণভোমরা হয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীর চেতনার বিপরীতে ক্ষমতার রাজনীতিতে মেতে আছে। ফলে এটার সব রকম ফ্যাসিবাদি ন্যাশন থাকা সত্ত্বেও এটা কালচারাল ফ্যাসিবাদের বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারছে না।
বিশেষ করে মনে রাখতে হবে ষাটের দশকের পরে পশ্চিমে ফ্যাসিবাদের আলোচনটা একটা পরিণত রুপ নিয়েছে। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় মার্কিন আধিপত্য ও ইরোপের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদের সম্ভাবনাকে নষ্ট করেছে। অন্য দিকে দুইটা বিশ্বযুদ্ধের নগদ অভিজ্ঞতা থেকে পশ্চিম আর কোনো শিক্ষা না নিলেও পশ্চিমা সমাজে ফ্যাসিবাদ নিয়ে আর কোনো মোহ ধরে রাখা যায়নি। ফ্যাসিবাদ যখন বলে মহত্বের আর কোনো বৈশিষ্ট্য নাই, যুদ্ধে সফল হওয়া ছাড়া। এই যুদ্ধে সাম্যবাদি শক্তি ফ্যাসিবাদকে রুখতে পারেনি। মার্কসবাদিরা ভুলে যান যে যুদ্ধের নিজস্ব মনস্তত্ব আছে। ফলে গণতন্ত্রকে আকড়ে ধরে পশ্চিমা সমাজ নতুন বিশ্বব্যাবস্থার প্রজেক্টে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দোসর হয়ে হাজির হলো। কারণ ফ্যাসিবাদের পক্ষে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব না। যাই হোক খুব সংক্ষেপে আমরা ফ্যাসিবাদের একটা পরিচিতিমূলক আলাপ সারলাম। এর আলোকে বাংলাদেশের এখনকার সমস্যাকে মোকাবেলা করার শিক্ষাই হবে কাজের কাজ।
স্বৈরতন্ত্রের কবলে বাংলাদেশ :
ফ্যাসিবাদের বয়ানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র একাকার হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র ও জনগোষ্ঠীর ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য ছাড়া ফ্যাসিবাদ সম্ভব না। বাংলাদেশে যার কোনো ছিটেফোঁটাও নাই। তাই আমাদের অবস্থাকে ফ্যাসিবাদ না বলে শাসতান্ত্রিক বিকার বলাই ভাল। এই বিকার নানা বয়ানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ তৈরির চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু এই চেষ্টার সফল ব্যবহার সম্ভাবনা জিরোপারসেন্ট। কারণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভাষা, চেতনা ও আদর্শ বলে যা চিনে, বুঝে তা ১৯ শতকের উপনিবেশি কলকাতার বাবু সংস্কৃতিজাত। এর সাথে বাংলাদেশের কোন যোগ নাই। ফলে এই মধ্যবিত্তপনা দিয়া ফ্যাসিবাদ হবে না। এর দৌড় কালচারাল এলিটিজম পর্যন্তই। ফাঁকে পুলিশ ও ভারতের এবং মার্কিন রাজনীতির ছকে থেকে ক্ষমতার লিজিংটা ধরে রাখা। এটা সামন্য গণউত্থানেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
এখন মনে হচ্ছে, জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম নিয়ে মিথিক্যাল গৌরব গাঁথা এই ফ্যাসিবাদকে নিয়মতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা জারি রাখতে সাহয্য করে। আজকে জনগণের ইচ্ছার তোয়াক্কা না করে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় টিকে আছে তখন আর ব্যাখ্যা করার দরকার হয় না শাহবাগ কি দরকারী ভূমিকা পালন করেছে। সমাজের মৌলিক দুইটা চেতনার মধ্যে বিভাজন তৈরির করতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ফাঁসির দড়ি আকারে হাজির করেছে তথাকথিত প্রজন্মের কাছে। এদের কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গঠন, প্রশাসন, আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার ভয়াবহ গাফিলতি কোনো ইস্যু হয় নাই। এই যে বিভাজনের রাজনীতি এর আবার স্পষ্ট শ্রেণি ও ধর্মীয় চরিত্র আছে। এর সাথে যোগ আছে মার্কিন ও ভারতের নিজ নিজ স্বর্থবাদি রাজনীতি। ফলে এখন বাংলাদেশের সঙ্কট আর ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। এই দিক থেকে দেখলে আমরা অধিকার হরণের রাজনীতির তাৎপর্য মূল শাসসহ ধরতে পারব। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর আফগানিস্তান নিয়ে যে ভূমিকা বাংলাদেশ নিয়ে এই ভূমিকায় হাজির হতে চায় ভারত। এই রাজনীতি ক্রমশ পরিস্কার হয়ে ওঠছে। জামায়াতকে দিয়ে ইসলামোফোবিক প্রপাগান্ডা তৈরি করে এটা কে জঙ্গি আকারে দাঁড় করিয়ে ধর্মযুদ্ধের নকশার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশকে। এই লেখা যখন লিখছি তখন দুইটা ঘটনা আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। এক. জেএমবির সদস্যদের ফিল্মি কায়দায় দাঁড় করে পুলিশের ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। দুই. সশস্ত্র গোষ্ঠীর তালিকায় তালেবানের পরে শিবির । প্রথম আলো খবর করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংগঠন আইএইচএসের টেররিজম এন্ড ইনসারজেন্সি এটাক ইনডেক্স এই জরিপ করেছে। এর পরেও রাজনীতি বুঝতে কারো বাকি থাকার কথা না। কি ভাবে গণহত্যা হয়ে দেশ ধর্মযুদ্ধের আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্র হয়ে উঠছে তা দিন দিন পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদের অনিবার্য যুদ্ধটা ধর্মযুদ্ধ আকারে হাজির হচ্ছে বাংলাদেশে। যে কোনো লেবেলের ফ্যাসিবাদ যুদ্ধ ছাড়া টিকতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা যে যুদ্ধের আউট লাইন দেখছি তা তো আর ইনটারনাল যুদ্ধ থাকছে না। তালেবান-আলকায়দা-জামায়াত-হেফাজত কে একাকার করে ট্রিট করার যে রাজনীতি তা আমাদের কে ফ্যাসিবাদের নিপুণ প্রহারায় ধর্মযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
এই ছক বুঝে জামায়াত এখনও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের লাইনে আছে। সরাসরি প্রতিরোধ যুদ্ধে নামেনি। যদিও দেশে একপ্রকার গৃহযুদ্ধের অবস্থা বিরাজ করছে। পরিক্ষামূলক ভাবে কিছু জামায়াত-শিবির এর লোকজনকে ক্রসফায়ারে দেয়া হয়েছে। যেহেতু সমাজ সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ ও ৭১ এর মিথে বিভক্ত ফলে এই ক্রসফায়ার নিয়া মানবাধিকারের জায়গা থেকেও কোন আপত্তি উঠেনি। ফলে, এই গৃহযুদ্ধে ইসলামকে এনিমি বানানোর ফলে এটা দ্রুতই ধর্মযুদ্ধের রুপ নিবে এতে কোন সন্দেহ নাই। এর সাথে আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাব মিল রেখে পাঠ করলে এই দিকটি বুঝতে পারা খুব কঠিন কিছু না।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদি রুপান্তর শুরু হয়েছে জন্মের সময় থেকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবেই উপনিবেশি উত্তরাধিকার ধরে রেখেছে। এখন আমাদের সংবিধানের ব্রিটিশি কাঠামো অটুট আছে। দলীয় চাকরবাকর মিলে একটা সংবিধান লিখে তা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিলো স্বাধীনতার পরে। যার কলিজার মধ্যে ব্রিটিশ ও পাকিস্তনী শাসন কাঠামোর মূল শাস রয়েছে। পরে এই সাংবিধানিক উপনিবেশিকতা জন্ম দিয়েছে স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্র। দেশে এখন কায়েম হয়েছে সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ। এই সংবিধান এখন হয়ে ওঠেছে জবরদস্তিমূলক শাসনের কাগুজে ছল।
সংবিধান নিয়ে ৭২ সালেই আপত্তি জানিয়েছেন মওলানা ভাসানী। আবুল মনসুর আহমেদ সংবিধান প্রশয়ণের প্রতিভা দেখে বিস্মিত হয়ে ছিলেন। তিনি ইত্তেফাকে বড় প্রবন্ধ লিখে হুঁশিয়ার করেছিলেন। তিনি লিখেন, রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের মতাদর্শকে জনগণের মত ও ইচ্ছা বলিয়া চালাইয়াছেন বহুবার বহু দেশে। সব সময়ই যে তা খারাপ হইছে তাও নয়। আবার সব সময়ে তা ভালও হয় নাই। পাকিস্তানের সংবিধানের বেলায় ‘ইসলাম’ ও বাংলাদেশের সংবিধানের বেলায় ‘সমাজতন্ত্র’ জাতীয়তা ও ধর্ম-নিরপেক্ষতাও তেমনি অনাবশ্যক ভাবে উল্লেখিত হইয়া আমাদের অনিষ্ট করিয়াছে। আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বহু জটিলতার সৃষ্টি করিয়াছে। [ সংবিধানের বিধানিক ত্রুটি,‘ আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ পৃষ্ঠা ৪৭৯]
ভাষানীর পত্রিকা ‘হক কথা’ এই সাংবিধানিক বিকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে লড়াই চালিয়েছে। এবং অবাক করা ব্যাপার হলো বাংলাদেশে প্রত্যেক সরকারই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার মধ্যেই স্বৈরতন্ত্র কায়েম করার সুযোগ নিয়েছে। সংবিধানকে নিজের ইচ্ছা মতো ব্যবহার করেই স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা হয়। এখন সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের কবলে নতুন যে স্বৈরতন্ত্র দেখছি তার হিসেবে যেহেতু আন্তর্জাতিক স্বার্থ সরা-সরি জড়িত ফলে এর হিসাবটাও আর আগের মতো হবে না। এটা ইসলামকে এনিমি করার মধ্য দিয়ে ধর্মযুদ্ধের মার্কিন ছঁকে খেলছে। এর পরিণতি যে ভয়াবহ হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্বৈরতন্ত্র তো সাংবিধানিকভাবে সবসময়ই ছিল। লিবারাল বুদ্ধিজীবীরা সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়া অনেক দিন থেকে কথা বলে আসছেন। তাদের সাবধান বাণী ব্যার্থ করে দিয়ে এই সরকারের আমলে এসে স্বৈরতন্ত্রের উল্লম্ফণ ঘটেছে বলা যায়। বিরোধীতার কোনো কিছুই সরকারের আর ধাতে সইছে না। সংবিধানকে এমন এক ত্যানায় পরিণত করেছে এটা দিয়া আর ময়লা-অবর্জনাও পরিস্কার করার জো নাই। রাজনীতিতে বিরোধীতার শর্ত হাজির থাকবেই। এটা জানা কথা। কিন্তু হাসিনা সরকার কোনো বিরোধীতাই মেনে নিবেন না। তার শাসন কাল কে তিনি কাগুজে সংবিধান দিয়ে ইচ্ছামত বাড়িয়ে নিবেন। বিরুদ্ধ মত কে গুলি করে দমন করবেন! কোনো প্রতিবন্ধকতাই তিনি আমলে নিবেন না হিসাবই আর তিনি ধর্তব্য মনে করছেন না। এই অবস্থাকে বাংলায় বলে, ‘ধরা কে শরা জ্ঞান করা’।
আর এই কাজে তিনি যা করছেন ইংরেজিতে তাকে বলে, ‘পলিটিক্যাল ইউজ অব দা পাস্ট’। ৭১ এর মতো একটা ইভেন্টকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছেন। ফলে স্বাধীনতার ঐতিহাসিকতা এখন কৌতুকে পরিণত হয়েছে।
এই অবস্থায় কোনো নাগরিকেরই অধিকার রক্ষা হতে পারে না। তা হচ্ছেও না। চেতনার নামে মধ্যবিত্ত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসই উস্কে দিয়েছেন। চেতনার রাজনীতির উল্টা পিঠে আবির্ভাব ঘটেছে হেফাজতে ইসলামের। সেই সব ঘটনা কমবেশি সবারই জানা। কিন্তু সরকার হেফাজতকে দমনের যে নজীরবিহীন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী লাইন নিয়েছে তা খোদ লীগের নেতাদেরই বিপদে ফেলে দিয়েছে। এমপিরা নিজ এলাকায় নিগৃহীত হচ্ছেন। ভোটের হিসেবে নেমে এসেছে কালবৈশাখী।
দুর্বল হোক সবল হোক যে কোনো ফ্যাসিবাদের জন্য যুদ্ধ হলো অনিবার্য। যুদ্ধ ছাড়া ফ্যাসিবাদ টিকতে পারে না। ফলে দেশে তো চোরা গৃহযুদ্ধ চলছে এক প্রকারে। এর সাথে দিন দিন যে ভাবে জামায়াতকে ও হেফাজতের মতো নাগরিক আন্দোলনকে একাকার করে শত্রুর কাতারে ঠেলে দেয়া হয়েছে তার পরিণতিতে ধর্মযুদ্ধের মেঘ পাকিয়ে উঠছে। এর সাথে মার্কিন ইন্টারভেনশন ও ভারতের স্বার্থও এসে জুটেছে একতালে। এই অবস্থায় নিদেন পক্ষে দেশে ভয়ের সংস্কৃতি চালু না করলে ফ্যাসিবাদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখা মুশকিল। লেডি হিটলার তাই সঠিক সময়ে সঠিক কাজটিই করেছেন বলতে হবে। আর ঠিক এই ফাঁকেই হাসিনা গং বাজাবেন জঙ্গিবাদের পুরানা কেসেট। অনন্ত যুদ্ধের প্রোজেক্টে হাসিনা নিজেকে আইরন লেডি প্রমাণ করার জন্য এই সকল রেফারেন্স পয়েন্ট ক্রিয়েট করছেন। ইউনূস এবং মার্কিন আপত্তির প্রতি সরকারের থোরাই কেয়ার ভাবের রাজনৈতিক পাঠ এখানেই নিহিত। এর প্রমাণ হিসেবে আপনারা মনে করে দেখতে পারেন, হাসিনা যখন নিজ দেশে নাগরিকদের গুলি করে মারছেন। তখন হোয়াইট হাউস জঙ্গি দমনে হাসিনার প্রসংশা করে তা আবার হল্লা করে প্রচার করেছে। এই ধারাবাহিকতায় রাজনীতির মাঠে হাসিনা সরকার টিকে যাবে কি না তা আগাম বলার কিছু নাই।
রাজনীতির সংঘাতময় পরিস্থিতি এড়ানোর রাস্তা যেহেতু সরকার খোলা রাখে নাই। কোনো দাবির প্রতিই তার সায় নাই। সন্ত্রাসের বয়ান উৎপাটনে কাজে লাগনো হচ্ছে, মিডিয়া, চেতনা, ধর্ম, ডিজিটাল বয়ান, বিলবোর্ড ইত্যাদি নানা কৌশল।
জনগণের অধিকার হরণ করে কোনো সরকার টিকে থাকতে পারে না। এই অধিকার হরণের রাজনীতির পরেও যদি জনগণের হুস না হয় তাইলে ফ্যাসিবাদের কবলে বাংলাদেশের রাজনীতি আটকা পড়বে। অদ্ভুত এক স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে কতিপয় লোকের লোটের রাজ্য।
এই অবস্থার জন্য আমরা নিজেরা কি প্রস্তুত হয়েই বসে আছি? আমার কেন এখনও নিজেদের মৌলিক তর্কগুলা হাজির করতে পারছি না। কেন আজও সব কিছু ধোয়াসা। পার্থ চট্রোপাধ্যায় যেমন বলেন, ভারতবর্ষের ইতিহাসে, তার নানা পরির্বতন, বিরোধ, নতুন ধর্মের প্রবর্তন, শাস্ত্রীয় ধর্ম আর লোকধর্মের নানা সংমিশ্রণের মধ্যে উচ্চ-নিচের পারস্পরিক ক্ষমতার বিরোধ দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এই ইতিহাস আমরা অনুসন্ধান করে দেখিনি। ফলে ভারতীয় সমাজের মৌলিক দ্বন্দ্বের চরিত্র এখনও আমাদের কাছে অস্পষ্ট[জাত-জাতি-জাতিয়তা: ইতিহাসের উত্তরধিকার]
কিন্তু বাংলাদেশে ব্যাপারটা এতো অস্পষ্ট না। গণতন্ত্র ঐতিহাসিকভাবে এখানে গণবিরোধী ধারা হিসেবে নিজেকে হাজির করেছে ফটকা কথা-বার্তা দিয়ে। বামরা হয়েছে হাস্যকর জীব। ৭১ চেতনা হয়েছে গণহত্যাকারী। শহুরে বা মধ্যবিত্ত সমাজ আধুনিকতার এমন এক আফিমের ঘোরে মত্ত যে এর দ্বারা কোনো রাজনীতি সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমন পরিসস্থিতিতে আমাদের ইতিহাসের নতুন ইভেন্টের দরকার পড়বে। আর ইসলামের সাথে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে আন্দোলনের যে অবহেলিত ইতিহাস এই জনগোষ্ঠী আজও লালন করে তার প্রত্যাবর্তন দেখতে পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তিতুমীর দুদ্দ শাহ ঘুমায় নাই এই শ্লোগান শুনা গেলে অবাক হবার কিছু নাই। ফলে ফ্যাসিবাদি কালচারাল মধ্যবিত্ত শক্তির বিরুদ্ধে যে শক্তি রাজনৈতিক হিম্মত নিয়ে আগাবে। যে নৈতিক এজেন্সি আকারে হাজির হবে। যে ইনসাফ প্রশ্নে আপোষহীন হবে আগামী বাংলাদেশর ইতিহাস হবে তাদের বিচরণ ক্ষেত্র। সে ইসলাম বা বৌদ্ধ যে চেতনারই হোক তা ধর্তব্য নয়। অন্যদিকে ইসলামের যে গ্লোবাল লড়াই জারি আছে তার আছড়ও বাংলাদেশে পড়বে। পড়াটাই স্বাভাবিক। ফলে আমাদের জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও নৈতিক ঐক্য ছাড়া আমরা আগামী দিনের লড়াইয়ে টিকতে পারবে না। এই দিকগুলো খেয়ালে রেখে আমাদের আগামী দিনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করাই এখন জরুরি কাজ। মজলুমের ঐক্যবদ্ধ লড়াই জালেমের জমানার অবসান ঘটাতে পারে। অন্যায় বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটাই ন্যায় যুদ্ধ। পাল্টা বলপ্রয়োগের বৈধতাও এভাবে তৈয়ার হয়। এর মধ্য দিয়ে সমাজে কায়েম হয় নতুন ন্যায়। এটা ডিনার পার্টি বা প্রবন্ধ লেখার মতো কাজ না। ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য পাল্টা ক্ষমতা তৈরি করার মামলা। এর জন্য প্রথম প্রয়োজন মতাদর্শ ও সাংস্কৃতিক লড়াইকে সংগঠিত করা। ফ্যাসিবাদের সমস্ত দুর্গ ধসিয়ে দেয়া। আর এই লড়াইয়ে ইসলাম অবশ্যই মজলুমের পক্ষে।
‘জালেম ও শোষক যে কোনো ধর্মের, যে কোনো বর্ণের, যে কোনো দেশের বা সমাজের হউক না কেন তাহারা আল্লাহর শত্রু, সমাজের দুশমন। ইহা সর্বদাই শোষিত ভাই-বোনেরা মনে রাখিবেন। অন্তঃকরণ হইতে সর্বপ্রকার ভয়ভীতি দূর করিয়া জালেম ও শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে জেহাদ করিতে না পারিলে শোষিত মজলুম মানুষের দুঃখ দুর্দশা কিছুতেই দূর হইবে না এবং শোষণমুক্ত সমাজ গঠনও সম্ভব হইবে না’ [মওলানা ভাসানী ‘হক কথা’ প্রথম বর্ষ ২৬ তম সংখ্যা, ১৯৭২ সাল ২৫ আগস্ট]
আমাদের জনগণের লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে হাজির করতে হবে নতুন ন্যায়। ইনসাফ ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে আমরা নিজেদের রাষ্ট্র দাঁড় করাতে না পারলে খুনের রাজত্বে লাশ পাশে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। লাশ…আমার আপনার আপনজনের লাশ। নিজেও লাশ হয়ে যেতে পারেন যে কোনো সময়। আপনার লাশ হওয়ার জন্য আদলতই যথেষ্ট। আছে পুলিশ লীগ, দলীয় ক্যাডার। মৃত্যু ফাঁদে আটকে পড়ছে বাংলাদেশ।
এই অবস্থায় নাগরিক অধিকার হরণের যেকোনো রাজনীতিকে সরাসরি প্রতিহত করা ছাড়া মানুষের মানবিক সম্মান রক্ষা হতে পারে না। প্রতিরোধের সংস্কৃতি আমাদের আছে। ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আমাদের প্রতিরোধের পথে ফিরতে হবে। মানবিক মর্যাদর রক্ষার লাড়াই সবচেয়ে পবিত্র লড়াই। অধিকার হরণ করলে মানুষের মান থাকে না। নি:সন্দেহে বাংলাদেশ এখন লড়াইয়ের দ্বারপ্রান্তে অপেক্ষা করছে। মানুষ বেরিয়ে আসবে তার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। কোনো দলের না কোনো গোষ্ঠীর না বাংলদেশের মানুষের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই। জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই। এই লড়াইয়ে বাংলাদেশই জিতবে কোনো ফ্যাদিবাদি স্বৈরতান্ত্রিক অপশক্তি নয়।
রেজাউল করিম রনি
কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব। এর দায় কোনোক্রমেই পরিবর্তন ডটকমের নয়।]