চট্টগ্রাম: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে উচ্চে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় বারাবার বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম। সফল বিশ্বকাপ আয়োজনের পথে এগিয়ে চলা আলোকিত বাংলাদেশকে অন্ধকার গলিতে নিয়ে যাচ্ছে বারবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট, হুটহাট ফ্লাড লাইট নিভে যাওয়া। আর এই কাজে মূল ভিলেনের ভূমিকায় কাজ করছে বিসিবির প্রভাবশালী দু’কর্মকর্তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকারী একটি জেনারেটর! প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘অমনি পাওয়ার’। আর এটির স্বত্বাধিকারী বিসিবির পরিচালক আকরাম খান ও প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ। অমনি পাওয়ারের চেয়ারম্যান আকরাম খানের স্ত্রী সাবিনা আকরাম আর পরিচালক হচ্ছেন নির্বাচক ফারুক আহমেদ।
জানা যায়, শনিবার দিনের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে। খেলা চলার সময় অল্প ব্যবধানে দুইবার ফ্লাড লাইট নিভে যায়। ফলে প্রায় ২৫ মিনিট বন্ধ রাখতে হয় খেলা। বারবার মাঠ ছেড়ে সাজঘরে ফিরতে হয় মরণপণ যুদ্ধে নামা দুই দলের খেলোয়াড়দের। আর এ কারণে লজ্জিত হতে হয়েছে দেশবাসীকে।
এর আগে একই ভেন্যুতে শ্রীলঙ্কা ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যকার ম্যাচটিও একই সমস্যায় পড়ে। খেলা বন্ধ রাখতে হয় প্রায় ১০ মিনিট। তারও আগে ১২ মার্চ আফগানিস্তান-নেদারল্যান্ডসের প্রস্তুতি ম্যাচ চলাকালীন দু’দফা বিদ্যুৎ বিভ্রাটে নিভে যায় ফ্লাড লাইট। এর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় দিনের আলো কম থাকায় প্রায় ২০ মিনিট খেলা বন্ধ রাখা হয়।
এ রকম ঘটনা যে শুধু চলতি আসরেই ঘটছে তা কিন্তু নয়। এর আগে ২০১২ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের সময় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে খেলা বন্ধ রাখা হয়েছিল।
এদিকে বিশ্ব আসরে বারবার ফ্লাড লাইট নিভিয়ে চট্টগ্রামকে কলঙ্কিত করার পেছনে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিশ্বকাপের মতো এত বড় আসরে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিতব্য মোট ১৬টি ম্যাচ সুষ্ঠু সফলভাবে সম্পন্ন করতে আইসিসির নির্দেশনা অনুযায়ী বিসিবি নিরবছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে জেনারেটর ক্রয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান করে।
দেশের বেশিরভাগ স্টেডিয়ামে শক্তিশালী ও উন্নতমানের এই জেনারেটর সরবরাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাদৃত ‘বাংলাক্যাট পাওয়ার’ এই দরপত্রে অংশগ্রহণ করে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে জেনারেটর সরবরাহের অর্ডার পায়। কিন্তু বিসিবির প্রভাবশালী দুই কর্মকর্তা আকরাম খান ও ফারুক আহমেদ প্রভাব কাটিয়ে তাদের মালিকানাধীন ‘অমনি পাওয়ার’ থেকে অত্যন্ত নিম্নমানের একটি জেনারেটর সরবরাহ করে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অর্ডারকৃত জেনারেটরের দাম সাড়ে ১৩ হাজার ডলার।
তবে অপর কার্যাদেশ পেয়ে প্রভাবমুক্ত থাকায় সিলেট স্টেডিয়ামে ঠিকই জেনারেটর সরবরাহ করেছে বাংলাক্যাট পাওয়ার। যার সুফলও পেয়েছে সিলেট স্টেডিয়াম। সেখানে গত দু’দিন আগে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলেও শক্তিশালী এই ব্যাকআপ জেনারেটর থাকার কারণে ফ্লাড লাইট বন্ধ হয়নি।
রাতের বেলায় ম্যাচ চলার সময় সব মিলিয়ে জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামে ২শ’ কেভি বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। এরমধ্যে প্রায় ১৪০ কেভি বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয় ফ্লাড লাইটগুলো জ্বালানোর জন্য। বারবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বিসিবি এই ব্যাকআপ জেনারেটর স্থাপন করলেও তা অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়ায় সেটি কোনো কাজে আসছে না। ফলে পিডিবির লাইনে কোনো সমস্যা করলেই আর লোড নিতে পারছে না ব্যাকআপ জেনারেটরটি। এই সমস্যার কারণে ফ্লাড লাইট নিভে যাওয়ায় মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিশ্বকাপ আসরের ম্যাচগুলো। এনিয়ে আইসিসি, সফররত খেলোয়াড়দের মধ্যেও ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে।
জানা যায়, গত ১২ মার্চ আফগানিস্তান-নেদারল্যান্ডসের প্রস্তুতি ম্যাচ চলাকালীন দু’দফা বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ফ্লাড লাইট নিভে যাওয়ার কারণে জেনারেটর সরবারহকারী প্রতিষ্ঠান অমনি পাওয়ারের স্থানীয় তত্ত্বাবধায়ক হাবিবকে ডেকে পাঠায় বিসিবি। এ সমস্যা আর হবে না মর্মে বিসিবির কাছে বন্ড দিলেও দু’বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। আর জেনারেটর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি বিসিবির দু’প্রভাবশালী কর্মকর্তার হওয়ায় বিসিবির কর্তাব্যক্তিদের মধ্যেও উদাসীন ভাব লক্ষ্য করা গেছে। বিসিবির পরিচালক আকরাম খানের সঙ্গে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে ভালো যোগাযোগ থাকার কারণে তিনি এ ঘটনার পরও পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
তবে অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক আকরাম খান বলেন, ‘এই জেনারেটরটি আমার কিংবা ফারুক ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানটির সরবরাহকৃত নয়। এটি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের। বিশ্বকাপের মতো আসরে এই ধরনের ঘটনা কাম্য নয়। বিষয়টি আমরা সিরিয়াসলি দেখছি।’ ক্রিকেট বোর্ডে থেকে এসব বাণিজ্যের সাথে যুক্ত থাকা যায় না বলেও মন্তব্য করেন আকরাম খান।
জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের সিনিয়র বৈদ্যুতিক কর্মকর্তা মো. সালেক বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় জেনারেটর দিয়ে ফ্লাড লাইটগুলো জ্বালানো হয়। ৭টা ৩৫ মিনিটের দিকে হঠাৎ জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে ২ নম্বর টাওয়ারের ফ্লাড লাইট বন্ধ হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। পরে পিডিবির লাইনেও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা ঘটে। ফ্লাড লাইট একবার বন্ধ হলে জ্বলতে প্রায় ১০ মিনিট সময় নেয়।’
এ প্রসঙ্গে পিডিবি চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বকাপের ম্যাচ চলার সময় যে চারটি ফ্লাড লাইট চালু রাখা হয় তা বিসিবির নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে। আজকে ফ্লাড লাইট নিভে যাওয়ার পেছনে পিডিবির কোনো ভূমিকা নেই। এটি তাদের জেনারেটরের ফল্ট। পিডিবি এখন স্টেডিয়ামের আনুষঙ্গিক বিদ্যুতের ব্যবস্থা করছে।’
আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতো মর্যাদাপূর্ণ একটি টুর্নামেন্টে এ ধরনের ঘটনা দেশকে বারবার লজ্জায় ফেলছে।
আর বিসিবি ও স্থানীয় আয়োজক কমিটির এমন দায়িত্বহীন আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ আইসিসির একাধিক কর্মকর্তা। আইসিসির এক কর্মকর্তা বিসিবির সাবেক পরিচালককে বলেই দিলেন, ‘আন্তর্জাতিক আসর চলার সময় বারবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা এবারই প্রথম দেখলাম। এ ধরনের ঘটনায় চট্টগ্রাম ভেন্যু নিয়ে আইসিসিকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিবির সাবেক ওই পরিচালক বলেন, ‘আইসিসির ওই কর্মকর্তার বক্তব্যে আন্দোলন করে চট্টগ্রামবাসী যে ভেন্যু পেয়েছিল তা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ম্যাচ হলেও বিকল্প ভেন্যু হিসেবে ঢাকার পর সিলেট, খুলনা, নারায়ণগঞ্জকে বেছে নিতে পারে আইসিসি। এ বিষয়ে আয়োজকদের বাড়তি খেয়াল রাখা উচিৎ।’
এ বিষয়ে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম ভেন্যু কমিটির চেয়ারম্যান ফজলে বারী খান রুবেল বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা বৈঠকে বসেছি। ফ্লাড লাইট চলে গেছে এটি একটি দুর্ঘটনা। পরে কথা বলবো।’
তবে আইসিসির মতো আয়োজনে নতুন যুক্ত হওয়া ভেন্যু কমিটির চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আ জ ম নাছিরের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি এর আগেও স্টেডিয়ামের এই অব্যবস্থাপনাসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা উঠলে মিডিয়াকে এড়িয়ে গেছেন।
চট্টগ্রামের ক্রীড়া সংগঠক ও ভক্তরা এত বড় বিশ্বমানের আয়োজনে আ জ ম নাছিরের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। সফল সংগঠক হিসেবে চট্টগ্রামে এর আগে বিপিএলসহ বিশ্বকাপের অনেক আসর সম্পন্ন করেছেন বিসিবির সাবেক পরিচালক সিরাজুদ্দীন মোহাম্মদ আলমগীর। তারা এ পরিস্থিতিতে বারবার আলমগীরের কথাই স্মরণ করছেন।