[ads1]পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানমকে (মিতু) এর আগেও একবার খুন করার চেষ্টা হয়েছিল।
হত্যাকাণ্ডের মাত্র পাঁচ দিন আগে সেই চেষ্টা করা হলেও রাস্তায় লোকজন বেশি থাকায় সেদিন খুনিরা সফল হতে পারেননি।
এ ছাড়া খুন করার আগ পর্যন্ত পুলিশের সোর্স কামরুল শিকদার ওরফে মুছা ছাড়া আসামিদের আর কেউ মাহমুদার পরিচয় জানতেন না। হত্যাকাণ্ডের পর টেলিভিশন দেখে মাহমুদার পরিচয় জানতে পারেন তারা।
আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তি-মূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য দিয়েছেন মাহমুদা হত্যায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামি মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম। গত রোববার চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মোহাম্মদ হারুন অর রশিদের আদালতে দুই আসামি ওয়াসিম ও মো. আনোয়ার জবানবন্দি দেন। এর আগের দিন শনিবার তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় পুলিশ।
দুই আসামির জবানবন্দি অনুযায়ী, তারা কিছুই জানতেন না, মাহমুদাকেও চিনতেন না। সবকিছু জানেন মুছা। তারা মুছার নির্দেশ পালন করেছেন মাত্র। কিন্তু মুছা কার নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করলেন? কোথায় সেই মুছা? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব মিলছে না। তবে চার-পাঁচ দিন আগেও মুছা পুলিশের হেফাজতেই ছিলেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গিয়েছিল। এখন এই সূত্রগুলো আর কিছুই বলছে না। তার ভাগ্যে আসলে কী ঘটেছে, সেটা জানা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আখতার কবির চৌধুরী গতকাল রাতে বলেন, পুলিশ বলছে মাহমুদা খুনের পরিকল্পনাকারী মুছা নামের এক ব্যক্তি। এই মামলার আসল রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন। নইলে ঘটনার নেপথ্যের নায়ক আড়ালে থেকে যাবে। পুলিশের উচিত যথাযথ তদন্ত করে জাতির সামনে আসল রহস্য তুলে ধরা।
আদালত ও পুলিশ সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে আসামি ওয়াসিম বলেন, ঘটনার (হত্যাকাণ্ডের) পাঁচ দিন আগে মাহমুদা বাসা থেকে বের হওয়ার পর আবদুল নবী (এখনো গ্রেপ্তার হননি) ছুরি হাতে তার পিছু নেন। কিন্তু লোকজনের কারণে অন্য আসামিরা ঠিকভাবে তৎপর না থাকায় সেই চেষ্টা সফল হয়নি। এ জন্য মুছা বাসায় এসে ওয়াসিমকে গালাগাল করেন এবং ঘুষি মারেন। মাহমুদাকে মারতে না পারলে ওয়াসিমকে মেরে ফেলারও হুমকি দেন মুছা।
পুলিশ সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে ওয়াসিম বলেছেন, ঘটনার (মাহমুদা হত্যা) ১৫ দিন আগে ওয়াসিম, নবী, কালু, শাহজাহানসহ সাতজনকে নিয়ে পরিকল্পনা করেন মুছা। ঘটনার আগের দিন রাতে তারা সবাই মুছার বাসায় ঘুমান। ওই দিন মুছা সবাইকে ৫০০ টাকা করে দেন। ঘটনার পর তারা আবার মুছার বাসায় যান। সেদিন মুছা সবাইকে এক হাজার টাকা করে দেন। সেখান থেকে যে যার মতো চলে যান।
আদালত সূত্র জানায়, ওয়াসিমের জবানবন্দি অনুযায়ী ঘটনার ৮-১০ দিন আগে তারা জিইসি এলাকায় বাবুল আক্তারের বাসার আশপাশের এলাকা ঘুরে (রেকি) আসেন। সেদিন সকাল ছয়টায় তারা জিইসি মোড়ে যান। তারা দেখতে পান, এক নারী একটি বাচ্চাকে স্কুলগাড়িতে তুলে দিয়ে চলে যাচ্ছেন। [ads1]
[ads2]তখন মুছা তাকে বলেন, ‘ওই দেখ, মহিলা (মাহমুদা) জঙ্গির অর্থদাতা। সে সারা ওয়ার্ল্ডে যায়।’ পরে তারা কালামিয়া বাজারে চলে আসেন। ঘটনার চার-পাঁচ দিন আগে মুছা নবীকে বলেন, ‘ওই মহিলাকে মারতে পারবি?’ নবী রাজি হন। পরে নবী ছাড়া সবাইকে মুছা বলেন, ‘নবী যদি ধরা পড়ে যায়, তাহলে কেউ যেন না যায়, গণপিটুনিতে যেন নবী মরে যায়।’
পরদিন সকালে মুছা সবাইকে ৫০০ টাকা করে দেন। নবীকে একটা ছুরি দেন। ওয়াসিমসহ তারা সাতজন সকাল ছয়টায় জিইসি মোড়ে যান। ওই নারী সকাল সাতটার দিকে আসেন। নবী ভয় পেয়ে মাহমুদাকে মারতে পারেননি। এ ঘটনার পর মুছা বলেন, ‘এ রকম হলে হবে না, রিস্ক নিতে হবে।’ তখন নবী বলেন, ‘একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে তার স্ত্রী বলে ওই মহিলাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেবেন।’ তখন মুছা তাকে বলেন, এ কাজ করা যাবে না।
পুলিশ সূত্র জানায়, অপহরণের পরিকল্পনা বাতিল হওয়ার পর মুছা একটা মোটরসাইকেল সংগ্রহ করেন। ওয়াসিমকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি অস্ত্র চালাতে পারেন কি না। ‘না’ বলায় কীভাবে পিস্তল চালাতে হয়, মুছা তা ওয়াসিমকে শেখান। পরে ওয়াসিম ফাঁকা গুলি করেন। মাহমুদার খুনে অংশ নেওয়া সবাইকে মুছা হুমকিও দেন কাউকে কিছু না বলার জন্য। জবানবন্দিতে ওয়াসিম স্বীকার করেন, ‘আমাদের ভয় দেখায় মুছা, কাউকে বললে বা ওই নারীকে না মারলে মেরে ফেলবে।’
যেভাবে খুন: পুলিশ সূত্র জানায়, ওয়াসিম জবানবন্দিতে স্বীকার করেন, ঘটনার আগের দিন রাতে কালু, শাহজাহান, নবী, আনোয়ারসহ সাতজন মুছার বাসায় ঘুমান। তারা সবাই একই কক্ষে ছিলেন। মুছা ছিলেন আরেক কক্ষে। ভোর পাঁচটায় মুছা তাদের ডেকে তোলেন। সবাইকে ৫০০ টাকা করে দেন।
ওয়াসিমকে পিস্তল দেন। ওয়াসিম স্বীকারোক্তিতে বলেন, ‘মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল মুছা। সঙ্গে ওয়াসিম ও নবী ছিল। জিইসি মোড়ে পৌঁছার পর যে যার মতো অবস্থান নেয়। কালু, মুছা ও রাশেদ ছিল ফলের দোকানের পাশে। ওখানে মোটরসাইকেল রেখে তারা অপেক্ষা করছিল। যে গলি থেকে মাহমুদা বের হবে, সে গলির মুখে নবী বসা ছিল। শাহজাহান ছিল একটি হোটেলের নিচে।’
আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে ওয়াসিম উল্লেখ করেছেন, মাহমুদা সকাল সাড়ে ছয়টায় বাসা থেকে বের হন। সঙ্গে ছিল তার শিশুপুত্র। যে গলি থেকে মাহমুদা বের হন, সেই গলির উল্টো দিকে ছিলেন তিনি। মাহমুদা বের হওয়ার পর মুঠোফোনে কথা বলার ভান করে রাস্তা পার হন তিনি। নবী পেছন দিক দিয়ে মাহমুদাকে ছুরিকাঘাত করেন।
এ সময় মাহমুদা দৌড় দিতে চাইলে কালু ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন তাকে। রাস্তায় পড়ে গেলে তাকে ছুরি মারেন কালু। মাহমুদাকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ওয়াসিমের মায়া হয় বলেও জবানবন্দিতে তিনি উল্লেখ করেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, মহিলা রাস্তায় পড়ে গেলে বাচ্চাটা নবীর পা ধরে কান্না করতে থাকে। সে বলে, ‘আমার আম্মুকে মেরো না।’ এ সময় মুছা বাচ্চাটিকে ধরে রাখে।
আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে ওয়াসিম বলেছেন, মাহমুদার কপালে গুলি করেন মুছা। পরে মুছা, নবী ও তিনি মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যান। প্রবর্তক মোড়ের আগে নবী রাস্তায় ছুরি ফেলে দেন। এরপর তারা বাদুরতলায় যান। সেখানে মুছা মোটরসাইকেল রাখেন।
তখন তারা দুজন অটোরিকশায় করে রাজাখালীতে মুছার বাসায় যান। বাসায় পৌঁছার আগে আবাসিক এলাকায় মুছা কাকে যেন ফোন করে কিছু বলেন। তখন এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা (সোমবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে) এসে দুটি পিস্তল নিয়ে যান। তারা দুজন আলাদাভাবে কথা বলেন।
ভোলা চলে যাওয়ার পর তারা সাতজন কালামিয়া বাজারে যান। এর আগে মুছা তাদের শার্টগুলো খুলে নিয়ে খালে ফেলে দেন। বাজারে যাওয়ার পর সবাইকে এক হাজার টাকা করে দেন মুছা। এরপর তারা যার যার মতো চলে যান।
বাসায় যাওয়ার পর ওয়াসিম টেলিভিশনের খবরে দেখতে পান, যে নারীকে তারা খুন করেছেন, তিনি পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী। সঙ্গে সঙ্গে মুছাকে ফোন করেন ওয়াসিম। তখন মুছা ফোনে ধমক দিয়ে বলেন, ‘চুপ থাক। বেশি কথা বললে তোকেও মার্ডার কেইসে ঢুকাইয়া দিব।’
পুলিশ সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া আরেক আসামি মো. আনোয়ার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, মাহমুদাকে মুছা নয়, ওয়াসিমই গুলি করে হত্যা করেছেন। মুছার কথামতো ঘটনার দিন ভোরে জিইসি এলাকার রয়েল হসপিটালের সামনে দাঁড়ান আনোয়ার। পুলিশ দেখলে মুছাকে জানানোর দায়িত্ব ছিল তার।
মাহমুদাকে হত্যার প্রস্তুতি আগে থেকে নেওয়া এবং ঘটনাস্থল ঘুরে দেখার বিষয়টিকে নিরাপত্তার ঘাটতি মনে করেন কি না, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য্য বলেন, পুলিশের নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি ছিল না। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ঘটনার দিন রাস্তায় লোকজন থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। একজন লোকও পুলিশকে খবর দেয়নি, খুনিদের ধরার চেষ্টা করেনি। পুলিশ আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করেছে। মুছাসহ পলাতক অন্য আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দর খান প্রথম আলোকে বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হোক, এটাই সবাই চায়। পুলিশের উচিত সুষ্ঠু তদন্ত করা।
৫ জুন সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় চট্টগ্রামের জিইসি এলাকায় গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা।
হত্যাকাণ্ডের পর তার স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় তিন ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন। পুলিশ অভিযান চালিয়ে এই মামলার আসামি ওয়াসিম, আনোয়ার, অস্ত্র সরবরাহকারী ভোলা ও তাঁর সহযোগী মনিরকে গ্রেপ্তার করে। এখনো পলাতক রয়েছেন হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া মুছাসহ পাঁচ আসামি।[ads2]