মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট আরোহণ নিয়ে ৭১ টেলিভিশনে প্রচারিত একটি প্রতিবেদনের সূত্র ধরে দেশব্যাপী শুরু হয় বিতর্ক। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, এভারেস্ট বিজয়ীদের তালিকায় মুসা ইব্রাহীমের নাম নেই। মুসা আদৌ এভারেস্ট জয় করেছে কিনা এমন প্রশ্নও তোলা হয়। আর সেই সূত্র ধরেই সামাজিক মাধ্যমগুলোতে দেখা দেয় বিতর্ক। তবে যে প্রতিবেদনের সূত্র ধরে এই বিতর্ক সরগরম হয়ে ওঠে, খোদ সেই প্রতিবেদন নিয়েই দেখা দিয়েছে এবার বিতর্ক।
৭১ টেলিভিশনে প্রচারিত নিজস্ব প্রতিবেদনটির ভিডিও ফুটেজের একটি অংশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের একটি অপ্রকাশিত ফুটেজ থেকে ব্যবহৃত হয়েছে বলে দাবি করেন সাংবাদিক মঞ্জুরুল করিম। টেলিভিশনটির ‘তালাশ’ টিমের জন্য এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি করা হয়েছিল বলে জানান তিনি। এমনকি ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের লোগোসহ বুম (মাইক্রোফোন)।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের অনুষ্ঠান ‘তালাশ’-এর জন্য বছর দুইয়েক আগে মুসা ইব্রাহীমকে নিয়ে অনুসন্ধানে নামে তালাশ। তখন এই প্রতিবেদন করা হয়েছিল বলে মঞ্জুরুল করিম জানান। তিনি তার ফেসবুক পেজেও এই মন্তব্য করেন।
মঙ্গলবার দুপুরে ‘তালাশ’ টিমের প্রধান মঞ্জুরুল করিম তার ফেসবুক ওয়ালে একাত্তরের ফুটেজ নিয়ে লেখেন- “মাহবুব স্মারক সহকর্মী এবং বন্ধু হিসেবে আমার খুব কাছের। সাংবাদিক হিসেবে তো ভালো বটেই। কিন্তু তার পক্ষে এমন নৈতিকতা বিরোধী কাজ করা সম্ভব হবে কখনো ভাবিনি। মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্ট বিজয় নিয়ে বিতর্ক চলছে বেশ কয়েকদিন ধরে। কোনো কোনো যুক্তিতে বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে তা আগে থেকেই জানি। কারণ, প্রায় ২ বছর আগেই এটি নিয়ে ‘তালাশ’-এর জন্য অনুসন্ধান সম্পন্ন করেছিলাম আমরা। কিন্তু দেশের এত বড় অর্জন নিয়ে কোনো বিতর্ক তৈরি করার ইচ্ছে না থাকায় এ নিয়ে আর এগোনো হয়নি। তবে, কয়েকদিন থেকেই স্মারকের রিপোর্ট নিয়ে কথা শুনছিলাম। যারা দেখেছে তারা বলেছে, এই রিপোর্টের জন্য তারা নেপাল পর্যন্ত গেছে। শুনে ভালো লেগেছে। আজ সকালে অফিসে এসে নিজের ডেস্কে বসে হঠাৎ করেই কেন যেন মাহবুব স্মারকের রিপোর্টটা দেখতে ইচ্ছে হলো। ফেসবুকে তার প্রোফাইলে ঢুকে রিপোর্ট দেখছি। রিপোর্টের এক পর্যায়ে বলা হলো, তারা ঘটনা অনুসন্ধানের স্বার্থে ‘নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন’ প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলে। ঐ অ্যাসোসিয়েশন ভবনটি আমি চিনি। কিন্তু প্রেসিডেন্টের পোষাক দেখে খটকা লাগলো। প্রায় ২ বছর আগে তো, ঠিক এই পোশাকেই তিনি আমার সাথে কথা বলেছেন! সেই প্রেসিডেন্ট কথা বলছেন, আর তার বিপরীতে আমার গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের মাইক্রোফোনটাও টেবিলে দেখা যাচ্ছে। স্মারক, যেভাবেই তুমি ফুটেজটা পেয়ে থাকো, তোমার নিশ্চই বুঝতে কষ্ট হয়নি যে কাজটা আমার ছিল। খুব কষ্ট পেলাম স্মারক। সৌজন্যে শব্দটা ব্যবহার করলেও তোমার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতো না। চুরি করলে আরো ভালোভাবে চুরি করতে হয়। টেবিলের উপর যে মাইক্রোফোন রাখা আছে সেটা এডিট করে মুছে দিলেও পারতে…”
জবাবে মাহবুব স্মারক লেখেন, “তোমার টেলিভিশনের তোলা কোনো ছবি আমরা একাত্তর টেলিভিশন ব্যবহার করিনি।
ইন্টারভিউ-এর ভিডিও, যা আমি ব্যবহার করেছি, তা তোমার নয়। তোমরা সবাই যখন সেখানে ছিলে, অন্য একজন তা ভিডিও করেছে, এবং পরে তা আমার হাতে এসেছে। এবং আমরা তা ব্যবহার করেছি। তাতে কোনো অন্যায় বা নীতি গর্হিত কাজ হয়নি কোনোভাবেই। তুমি চাইলে দেখতে পারো যে, সেই ভিডিওতে তোমার ক্যামারাম্যানও কাজ করছে। এতে তুমি অন্যায় কী দেখলে আমি জানি না।”
জবাবে মঞ্জুরুল করিম লেখেন, “ভালো যুক্তি স্মারক। কিন্তু অনুসন্ধান কি তোমার?”
মাহবুব স্মারক জবাব লেখেন- “স্টোরি দেখে বলো, বলতে চাও তোমার অনুসন্ধান আমি ব্যবহার করেছি? আমি কি তোমার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে রিপোর্ট বানিয়েছি? তুমি কি তা দাবি করতে পারো? আমি জানি এটা তুমি বলতে পারবে না। আমি নিজে আট মাস ধরেই অনুসন্ধান করেছি, গত বছর আগস্টে ‘নেপাল পর্বত’ আমাদের হাতে এসেছে, তারপর থেকেই আমি এই নিয়ে কাজ করেছি, সবার সাথেই কথা বলেছি, রিপোর্ট তার সাক্ষী। রিপোর্টেই আছে আমি কী অনুসন্ধান করেছি।”
এ বিষয়ে মঞ্জুরুল করিম পরিবর্তনকে বলেন, “দুই বছর আগে আমরা তালাশ টিম এই রিপোর্টটি নিয়ে অনুসন্ধান করি। অনেক বিষয়ে প্রশ্ন থাকলেও আমরা মুসার এভারেস্ট জয় না করার বিতর্ক নিয়ে নিশ্চিত হতে পারিনি। তার ওপর তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। তাই অযথা বির্তক যাতে না হয় সেজন্য আমরা আর রিপোর্টটি প্রচার করিনি।”
তিনি বলেন, “৭১ টিভিতে ইন্টারভিউতে নেপাল মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের যে প্রেসিডেন্টর কথা দেখানো হয়েছে সেটি আমি নিয়েছিলাম। প্রশ্নকর্তার যে ভয়েজ শোনা যায় সেটিও আমার। আর উনিতো বর্তমানে প্রেসিডেন্ট নন। সেই সময়ে ছিলেন। তার পরিহিত ড্রেসটি দেখেই প্রথম আমি বিষয়টি খেয়াল করি গভীরভাবে। কারণ আমি যখন সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলাম তখন তিনি এই ড্রেসে ছিলেন।”
তিনি আরো বলেন, “রিপোর্টার আমার বন্ধু মানুষ। আমি তার কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে সে আমাকে বলেছে যে, আমার ইন্টারভিউটি থার্ড পারসন কেউ ভিডিও করেছিল। সেই অংশটিই তার ফুটেজে কিছুটা দেখা গেছে। তবে এখানে রিপোর্টার তার সততার জন্য বিষয়টি উল্লেখ করতে পারতো।”
এ বিষয়ে ৭১ টিভির রির্পোটার মাহবুব স্মারক পরিবর্তনকে বলেন, “আমি স্পষ্টভাবে বলেছি, যখন মঞ্জুরুল করিম নেপাল যায় সে গিয়েছিল মুহিত ও নিশাতকে স্বাগত জানাতে। সেই সময়ে মুসার বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে বাংলাদেশ থেকে মীর শামসুল আলম বাবু ও শাহজাহান মৃধা বেনু যায় তদন্ত করতে। তখন তাদের সাথে মঞ্জুরুল করিম যুক্ত হয়। যখন সাক্ষাৎকার নেয়া হয় সেখানে মঞ্জুরুল করিম ও মীর শামসুল হকরাও ছিল। সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় তারা উভয়ই ভিডিও করেছে। আমাকে সেই ভিডিও ফুটেজ শাহজাহান মৃধা দিয়েছে। আর এটা কোনোভাবেই সম্প্রচার নীতিমালা বিরোধী নয়।”
তিনি আরো বলেন, “রিপোর্টটি ভালো করে খেয়াল করে দেখলে বোঝা যাবে, আমার রিপোর্টে কোথাও বলিনি মুসা এভারেস্ট জয় করেছে না করেনি। তবে তার এই অভিযান নিয়ে যে সন্দেহ আছে, আমি সেটাকেই তুলে ধরেছি মাত্র।”
মাহবুব স্মারক যার কাছ থেকে ফুটেজ পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন, সেই শাহজাহান মৃধা বেনুর সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “হা, স্মারক আমার কাছ থেকে ফুটেজ নিয়েছেন। ওই সময় আমরা কয়েকজন বিষয়টি অনুসন্ধানে গিয়েছিলাম। মঞ্জুরুল করিম অন্য কাজে গিয়েছিলেন, পরে তিনি আমাদের সাথে যোগ দেন।”
শাহজাহান মৃধা জানান, ওই সময় তিনটি ক্যামেরায় বিষয়টি ধারণ করা হয়েছিল।
অস্ট্রেলীয় এভারেস্ট জয়ীর ভাষ্য :
মুসা ইব্রাহীম যেসময় এভারেস্টে যান সেই সময় অস্ট্রেলিয়ার পর্বতারোহী ব্রেন্ডন ও’ম্যাহনি গিয়েছিলেন। তার একটি প্রামাণ্যচিত্রে মুসা ইব্রাহীমের নামও এসেছে। তিনি দুর্ঘটনার পর মুসাকে রক্ষা করেন বলে জানিয়েছেন। পরিবর্তন-এর পাঠকদের জন্য তার ভাষ্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
“আমি নিচে নামার সময় একজন পর্বতারোহীকে পড়ে থাকতে দেখলাম। আমি তার মাস্ক চেক করলাম, দেখলাম তার অক্সিজেন ট্যাংকের মেইন ভাল্বে বরফ জমে আছে। যার কারণে সে অক্সিজেন ঠিকমতো নিতে পারছিলো না। আমি আমার পকেট ছুরি দিয়ে অক্সিজেন প্রবাহ ঠিক করে দিলাম। তার ট্যাংকে তখনও অক্সিজেন ছিল। আমি তার মাস্ক মুখে লাগিয়ে দিলাম। এরপর আমি এবং শেরপা দড়ির সাহায্যে তাকে নিচে নিরাপদ জায়গায় নামিয়ে আনলাম। বেস ক্যাম্পে আসার পর জানতে পারলাম, সে ছিল বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্টজয়ী মুসা ইব্রাহীম। পুরো দেশ তাকে অভিনন্দন জানায়। আমি কাঠমান্ডুতে অনেক কনফারেন্সে যোগ দেই এবং বাংলাদেশের দূতাবাসের পার্টিতেও যাই। জাতীয়ভাবে যখন তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয় তখনও আমি আমন্ত্রিত হই। আমি মুসা ইব্রাহীমকে বাঁচানোর ঘটনাটি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম খুব গুরুত্ব সহকারে ছাপায়।”
পরিবর্তন.কম