মুসা ইব্রাহীমের বিবৃতি

0

musa-ibrahim-everest-winer-intro-311x186সম্প্রতি নেপাল মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রকাশনা ‘নেপাল পর্বত’-এ এভারেস্টজয়ীদের নাম থাকা বা না থাকা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে এবং সেই তালিকায় মুসা ইব্রাহীমের নাম নেই, কাজেই তিনি এভারেস্ট জয় করেননি– এ ধরনের ব্যাখ্যা দিয়ে কয়েকজন পর্বতারোহী ও কয়েকটি গণমাধ্যম যে খবর প্রচার করেছে, তাতে আমি মুসা ইব্রাহীম, বাংলাদেশের হয়ে প্রথম এভারেস্টজয়ী, গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

‘নেপাল পর্বত’ প্রকাশনাটির ওই তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেখানে এভারেস্টজয়ী প্রথম নারী পর্বতারোহী জুনকো তাবেইয়ের নাম নেই। ১৯৭৫ সালে এভারেস্ট জয় করা জাপানের এই পর্বতারোহী ৩৮তম এভারেস্টজয়ী। ২০১০ সালের ২৩ মে বাংলাদেশের পতাকা এভারেস্টের চূড়ায় উড়েছিল। সেদিন আমার সঙ্গেই মন্টেনেগ্রোর তিন পর্বতারোহী- ব্লেকা, স্ল্যাগি ও জোকো তাদের দেশ থেকে প্রথম পর্বতারোহী হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন। ‘নেপাল পর্বত’ প্রকাশনায় তাদেরও নাম নেই। বাংলাদেশের এম এ মুহিত ২০১১ সালের ২১ মে এভারেস্ট জয় করেন। ‘নেপাল পর্বত’ স্মরণিকায় তার নামের পাশে লেখা আছে ২০১২ সাল। এ ধরনের আরও বেশ কিছু গুরুতর অসঙ্গতি ওই প্রকাশনায় রয়েছে।

এ বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ এপ্রিল আমার সংগঠন নর্থ আলপাইন ক্লাব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওই স্মরণিকার প্রকাশক নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি আং শেরিং শেরপার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান, চায়না-তিব্বতের দিক দিয়ে যারা এভারেস্ট জয় করেছেন, তাদের নাম নেপালের তালিকায় রাখা হয় না।

নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন ওই প্রকাশনাটি বের করে গত বছর। তালিকায় মুসা ইব্রাহীমের নাম না থাকা প্রসঙ্গে তখনকার সভাপতি জিম্বা জাংবু শেরপার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ওই প্রকাশনায় অসাবধানতাবশত কিছু ভুল হয়ে গেছে। তারা খুব শিগগিরই তা সংশোধনের উদ্যোগ নেবেন।

এভারেস্টজয়ীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয় সর্বজনস্বীকৃত আন্তর্জাতিক যে ওয়েবসাইটে, সেটির লিঙ্ক : http://www.himalayandatabase.com/2010 Season Lists/2010 Spring A4.html

এই তালিকাটি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, কোন দেশ থেকে কে কবে কখন এভারেস্ট জয় করেছেন, তা বিস্তারিত লেখা রয়েছে।

www.8000ers.com-এই ওয়েবসাইটটিও এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহীদের ছবির ভিত্তিতে এভারেস্টজয়ীদের তথ্য সংরক্ষণ করে।

২০১০ সালের ২৩শে মে এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে বাংলাদেশকে ৬৭তম এভারেস্টজয়ী দেশ হিসেবে পরিণত করার পর থেকেই কিছু মানুষ জাতীয় এ অর্জনকে খাটো করার চেষ্টা করে আসছেন। ২০১০ সালেই অনলাইনে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক ও গবেষণা হয়। যারা সন্দেহ করছিলেন, তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণের পর তারা শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নেন, মুসা ইব্রাহীম এভারেস্ট জয় করেছেন।

চার বছর পর আবারও একটি পক্ষ সন্দেহের আঙুল তুলেছেন। এদের মধ্যে আমার পরে এভারেস্ট জয় করা তিনজন এভারেস্টজয়ী পর্যন্ত রয়েছেন, তাদের সাফল্যে আমি আন্তরিকভাবে আনন্দিত ও গর্বিত। আমি বিশ্বাস করি, তারা সম্ভবত কারও প্ররোচণায় ঈর্ষাকাতর হয়ে এ সন্দেহমূলক বিবৃতিটি দিয়েছেন। আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করছি, তারা শুধু সন্দেহই প্রকাশ করেছেন। কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির করেননি।

আমার এভারেস্ট অভিযান ও চূড়া জয় নিয়ে যেসব তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, তা আমি বহুবার দিয়েছি। আমি তা বারবার দিয়েই যাব, যতবার জাতি আমার কাছে চাইবে। কিন্তু একই সঙ্গে আমি অভিযোগকারীদের উদ্দেশে বলছি, আপনাদের হাতে যদি কোনো তথ্যপ্রমাণ থাকে যে, ২০১০ সালের ২৩ মে বাংলাদেশের পতাকা এভারেস্টের চূড়ায় ওড়েনি, তাহলে সেই প্রমাণ জাতির সামনে প্রকাশ করুন। নইলে বাংলাদেশের এই অর্জন স্রেফ সন্দেহের বশে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো অধিকার কারও নেই। এটা শুধু একজন মুসা ইব্রাহীমের ভাবমূর্তির বিষয় নয়; এটা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিরও বিষয়।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আমার একটি বই রয়েছে ‘পাহাড়-চূড়ার হাতছানি : কেওক্রাডাং থেকে এভারেস্ট’। এই বইতে আমার পুরো অভিযানের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।

আমার একটি ওয়েবসাইট রয়েছে www.musaibrahim.com.bd নামে। সেখানে আমার এভারেস্ট-সহ অন্যান্য অভিযানের সব ছবি ও তথ্য রয়েছে।

আমার সঙ্গে যেসব বিদেশি অভিযাত্রী একই সময়ে এভারেস্ট জয় করেছেন, তাদের বিবৃতি এরই মধ্যে ফেসবুক-সহ অন্যান্য অনলাইন মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে। কয়েকটি টেলিভিশনেও তা প্রচারিত হয়েছে। সেখানে তারা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারা আমাকে এভারেস্ট চূড়ায় দেখেছেন।

আমার এভারেস্ট জয় নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বারবার অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, মন্টেনেগ্রো, সার্বিয়াসহ অন্য দেশের পর্বতারোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। প্রতিবারই তারা বিব্রত হয়েছেন, এ ধরনের অভূতপূর্ব একটি অর্জন নিয়ে যে বিতর্ক উঠতে পারে, তা তাদের কল্পনার অতীত।

আমার এভারেস্টে জয়ের সপক্ষে প্রমাণ, ছবি, বর্ণনা অনেক আগে থেকেই ছড়িয়ে রাখা আছে। কিন্তু আমার পরে যারা এভারেস্ট জয় করেছেন, তাদের দাবির সত্যতা নিয়ে আমি তো কোনোদিন প্রশ্ন তুলিনি। জানতে চাইনি, তাদের সার্টিফিকেট জাল কিনা। তাদের ছবিতে সম্পাদনা করা হয়েছে কিনা। তাদের পক্ষে কোনো বিদেশি পর্বতারোহীর সাক্ষ্য আছে কিনা। তাদের প্রতি আমার বিশ্বাস ও আস্থা থেকেই বিনা প্রশ্নে তা বিশ্বাস করেছি।

অভিযোগকারীদের বলছি, সবকিছুতেই যদি ‘প্রথম’ হতে হয়, তাহলে পৃথিবীতে আরও অনেক বিষয় আছে, যেখানে আপনারা বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে প্রথম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। আমরা যদি ভালো কাজের প্রতিযোগিতা বেশি বেশি করে করি, তাহলে দেশেরই লাভ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। আমার পরে আরও যারা এভারেস্ট জয় করেছেন, তাদের কিন্তু জাতি শ্রদ্ধার চোখেই দেখে। সামান্য কোনো প্রমাণ ছাড়া স্রেফ ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে এমন একটি অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে, ভবিষ্যতে শুধু পর্বতারোহণ কেন, অন্য কোনো ক্ষেত্রেই কাউকে উৎসাহিত করা যাবে না।

আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে সবাইকে আবারও বলছি, বারবার বলে যাব- ২০১০ সালের ২৩ মে রোববার বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা ৫ মিনিটে এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছে ৫টা ১৬ মিনিটে আমি যখন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা সেই চূড়ায় উড়িয়েছি, তখন থেকেই বাংলাদেশ পৃথিবীর মাঝে ৬৭তম এভারেস্টজয়ী দেশ। এটাই আমাদের জন্য গর্বের। আমাদের লক্ষ ছিল বাংলাদেশকে এভারেস্টজয়ী দেশ হিসেবে পরিণত করার, সেই সফল অভিযানের প্রমাণ বারবার আমি উপস্থাপন করব দেশের কাছে, দেশের মানুষের কাছে।

সবার কাছে আমার আহ্বান- প্রিয় বাংলাদেশকে বারবার যেন হেয় না করি। আমাদের প্রতিযোগিতা হোক বাংলাদেশের বেশি বেশি সাফল্যের জন্য, যাতে করে পৃথিবীর সামনে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি।

সবার মঙ্গল কামনায়, সবাইকে ধন্যবাদ।

(মুসা ইব্রাহীম)
এভারেস্টজয়ী প্রথম বাংলাদেশি;
চেয়ারম্যান, এভারেস্ট একাডেমি
সাধারণ সম্পাদক, নর্থ আলপাইন ক্লাব বাংলাদেশ (Estd: October 29, 2007; এভারেস্টজয়ী প্রথম সংগঠন)

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More