সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে বিএনপির ভেতরে আপাতত কোনো নড়চড় নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলকে সংগঠিত করে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরুর যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা এখনো ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। উপরন্তু নানামুখী সংকটের কারণে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, একটি লম্বা সময় ক্ষমতার বাইরে থাকতে হবে ধরে নিয়েই দলের নীতি-নির্ধারকেরা কর্মপরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু করেছেন। এসব নেতা বলেন, ৫ জানুয়ারির পর সরকার বিরোধী দলের প্রতি যে এতটা কঠোর হবে, তা তাঁদের ধারণায় ছিল না। এত দিন যেসব দেশের কূটনীতিকদের ওপর বিএনপির নেতৃত্ব ভরসা করেছিল, একতরফা নির্বাচনের পরও সেসব দেশ বর্তমান সরকারের সঙ্গে আগের মতোই সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এটাও বিএনপির হতাশার একটি বড় কারণ।
অবশ্য নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরুর পর গত তিন বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে বিএনপি পেরে ওঠেনি। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সময় বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা এই প্রতিবেদককে বলেছেন, তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, বিএনপি মাঠের আন্দোলনে সফল হোক বা না হোক, শেখ হাসিনার সরকার একতরফা নির্বাচন করতে পারবে না। শেষ মুহূর্তে হলেও দেশি-বিদেশি চাপে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতে বাধ্য হবে সরকার। আর তা না হলে ২০০৭ সালের এক-এগারোর মতো পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা এমনও বলেছেন, কোনো কারণে একতরফা নির্বাচন করে ফেললেও আওয়ামী লীগ খুব বেশি দিন টিকতে পারবে না। তাঁর যুক্তি, এর আগে বিএনপি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এমন একতরফা নির্বাচন করে দেড় মাসও টিকতে পারেনি। আওয়ামী লীগ বড়জোর তিন মাস বা ছয় মাস টিকবে।
বিএনপির নেতাদের এ জাতীয় সব ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, আওয়ামী লীগ এ মেয়াদের পরের দফায় আবার ক্ষমতায় আসার পাঁয়তারা করছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও কীভাবে জয় ছিনিয়ে নিতে হবে—সে বিষয়ে এবারের উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আগাম মহড়া দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে বলে তাঁরা মনে করছেন। এ অবস্থায় সরকারকে চাপে ফেলার মতো আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য দলকে সংগঠিত করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নিতে পারেনি বিএনপি।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির নেতা-কর্মীদের হতাশার আরেক কারণ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে নিজেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে রেখেছেন। বেশির ভাগ নেতাই জানেন না সামনে তাঁদের দল কী করবে। দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার দেখা পাওয়াও তাঁদের জন্য বিরাট ভাগ্যের বিষয়। দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমান চিকিৎসার নামে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে। কিন্তু নেতা-কর্মীরা এখন জানেন বিএনপি ক্ষমতায় না যাওয়া পর্যন্ত তারেকের দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম।
এরই মধ্যে খালেদা জিয়া ও তারেকের বিরুদ্ধে দুটি মামলায় আদালতে অভিযোগ গঠন ও বিচার শুরু হয়েছে। বিএনপির একজন আইনজীবী নেতা বলেছেন, এ দুটি মামলা বিএনপিকে ভাবাচ্ছে। আন্দোলন বা রাজনীতির কর্মকৌশল নির্ধারণেও তাঁদের বেগ পেতে হচ্ছে। তাঁরা মনে করছেন, বিএনপির গতিবিধি লক্ষ্য করে সরকার এ দুটি মামলার ব্যাপারে সর্বোচ্চ কঠোর সিদ্ধান্ত নেবে।
এ ছাড়া শীর্ষস্থানীয় আরও কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা সচল হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজনের জামিন বাতিল করে আদালত কারাগারে পাঠিয়েছেন। অবশ্য ফখরুলসহ কয়েকজন ইতিমধ্যে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।
আকস্মিক বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করে বিতর্ক সৃষ্টির কারণও বুঝে উঠতে পারছেন না বেশির ভাগ নেতা। এ বিতর্কের পর নির্দলীয় সরকারের অধীন মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি চাপা পড়ে গেছে। আটকে গেছে বিএনপির পুনগর্ঠনের কাজও। ফেব্রুয়ারির শুরুতে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন এক মাসের মধ্যে ঢাকা মহানগর বিএনপি ও ছাত্রদল পুনর্গঠন করা হবে। কিন্তু তা আর বাস্তবায়ন করতে পারেননি। উল্টো এ নিয়ে দলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। মে মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করার কথা থাকলেও তা আদৌ হবে কি না, সে ব্যাপারে দলটির কোনো নেতাই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঘন ঘন সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমে দলের উপস্থিতি ধরে রেখেছেন। দলীয় চেয়ারপারসনের কর্মসূচি বলতে গুলশানে নিজের বাসা ও কার্যালয়ে বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, কূটনীতিক এবং বিএনপি-সমর্থক পেশাজীবীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ। নির্বাচনের পর দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মাত্র তিনটি বৈঠক হয়েছে। খালেদা জিয়ার বিভিন্ন জেলা সফর কর্মসূচিও স্থগিত করা হয়েছে।
বিএনপির রাজনীতির বিষয়ে লক্ষ রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি একটা সংকটকালীন সময় পার করছে, এটা ঠিক। তবে তাদের বুঝতে হবে দেশের মানুষের বড় অংশ তাদের সমর্থন করছে। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দুই পর্বে সেই চিত্র ফুটে উঠেছে। তাঁর মতে, হতাশা আসা স্বাভাবিক। তবে মানুষের ব্যাপক সমর্থনের কথাটা মাথায় রেখে হতাশা ভুলে বিএনপিকে এগোতে হবে। মানুষের কাছে যেতে হবে, তাদের কাছে টানতে হবে।
বিএনপির একটি সূত্র বলেছে, নতুন কৌশল নির্ধারণ করতে গিয়ে বিএনপি পেছনে পড়ে গেছে। তবে এপ্রিলের শেষ দিকে খালেদা জিয়ার বিভিন্ন জেলা সফরের মধ্য দিয়ে আন্দোলন শুরুর চেষ্টা করা হবে।
অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেছেন, তাঁদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড থেমে আছে এটা ঠিক নয়। ভেতরে ভেতরে কাজ চলছে। দলের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর কমিটি নিয়ে সংকট: এ কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে দলের মধ্যে বিভেদ সুস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর কমিটির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা নিজেই সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এরপর কমিটি নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা সংকট।
ঢাকা মহানগর কমিটি নিয়ে সংকটের কারণে অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের সংস্কারও থমকে গেছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টুকে আহ্বায়ক ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খানকে সদস্যসচিব করে একটি কমিটি গঠনের কথা ভাবা হচ্ছে।
Next Post