নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হওয়ার পর বিচার বিভাগ কি স্বাধীন হয়েছে?

0

বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথক হয়েছিল এখন থেকে ১৫ বছর আগে ২০০৭ সালে। এখন বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপ্রীম কোর্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হওয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাব মুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এমন লক্ষ্য ছিল।

কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ বিচার বিভাগ এখনো সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ীই পরিচালিত হচ্ছে, এবং এটি আসলে স্বাধীন নয়।

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ ইতিহাস

মূলত বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য ১৯৯৪ সালে একটি রিট মামলা করেছিলেন জেলা জজ ও জুডিশিয়াল এসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মাসদার হোসেন।

সেই মামলাটি ‘মাসদার হোসন মামলা’ নামে পরিচিত, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে যার চূড়ান্ত রায় হয়েছিল ১৯৯৯ সালে।

রায়ের আট বছর পর ২০০৭ সালে মূল নির্দেশনাটি বাস্তবায়ন করে বিচার বিভাগকে আলাদা করা হয়েছিল।

তবে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার কথা দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসছে।

বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া বলছে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের শুরু থেকে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার বিতর্ক বা আলোচনা শুরু হয়।

১৭৯৩ সালে প্রণীত রেগুলেশন ৩-এর মাধ্যমে গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস কালেক্টরের বিচার করার ক্ষমতা রহিত করেন। এর ফলে দেওয়ানি আদালতের বিচারক জজ-ম্যাজিস্ট্রেট নামে অভিহিত হন।

জেলা পর্যায়ে এ দুই বিভাগকে পৃথকীকরণের বিষয়টি ১৮২৮ সাল পর্যন্ত বহুল বিতর্কিত ছিল বলে বলছে বাংলাপিডিয়া।

এরপর আরো অনেক বছর আলোচিত হবার পর অবশেষে ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়।

‘লক্ষ্য সম্পূর্ণ অর্জন হয়েছে বলা যাবে না’

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেছেন, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার পর ১৫ বছরে লক্ষ্য সম্পূর্ণ অর্জন হয়েছে সেটি বলা যাবে না।

তিনি বলছেন, এ ক্ষেত্রে দুইটি বিষয় আছে, এক হচ্ছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ।

স্বাধীনতা বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হয় যে কোন চাপ ছাড়া বিচারকেরা নিশ্চিন্তভাবে তাদের রায় দিতে পারবেন। আর বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ হলো বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করবে কে, অর্থাৎ এই বিভাগের বদলি পদোন্নতি বা শৃঙ্খলাজনিত ব্যাপার—এটা কে নিয়ন্ত্রণ করবে বা কোন প্রতিষ্ঠান।

শাহদীন মালিক বলেন, “বিচারের স্বাধীনতা আমাদের বিচারকদের আছে, মানে তারা স্বাধীনভাবে বিচার করার স্বাধীনতা তাদের আছে। কিন্তু পৃথকীকরণের জায়গায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।”

তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করছিলেন এভাবে, “বিচার বিভাগের কোন নিয়ন্ত্রণ যদি নির্বাহী বিভাগে থাকে, অর্থাৎ সোজা কথায় আইন মন্ত্রণালয় যদি বিচারকদের নিয়োগ-পদোন্নতি এগুলোর ওপর কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ থাকে, তাহলে বলতে হবে যে পৃথকীকরণ হয়নি।”

“আমাদের অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ যৌথভাবে আইন মন্ত্রণালয় এবং সুপ্রিম কোর্টে আছে। সেজন্য আমি বলবো যে এখানে পৃথকীকরণটা হয়নি। মানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগ স্বাধীন না,” বলেন তিনি।

তিনি উল্লেখ করেন ১৯৭২ সালের সংবিধানে লেখা ছিল যে, অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে বিচার বিভাগ মানে সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে।

“কিন্তু চতুর্থ সংশোধনীতে ওটা বদলে রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলো। কিন্তু এরপরে এখনো আমরা ১৯৭২ এর সংবিধানে ফেরত যেতে পারিনি,” বলছিলেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী।

‘বিচার কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত?’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডীন অধ্যাপক সীমা জামান মনে করেন, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের চেয়ে আলাদা করার যে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিচার বিভাগ যেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে, সেটি পুরোপুরি অর্জন হয়নি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক

তিনি মনে করেন, এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি এখনো সরকারের হাতে অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগের হাতে রয়ে গেছে।

অধ্যাপক জামান বলেন, “বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে এন্ট্রি পয়েন্টে অর্থাৎ একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় একজন বিচারক নিয়োগ পায়।

কিন্তু হাইকোর্ট ডিভিশন বা অ্যাপিলেট ডিভিশনে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি অনেকটাই রাজনৈতিক।”

“রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির জাজমেন্ট অর্থাৎ বিচার প্রভাবিত হওয়ার আশংকা থাকে, রায় দেয়ার সময় বিচারকদের ভাবতে হয়।

এটা কেবল এখনকার বিষয় নয়, বরং ২০০৭ সালে জুডিশিয়ারিকে যখন আলাদা করা হয়, তখন থেকেই যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকুক না কেন বিচারকদের এটা ভাবতে হয়,” বলেন তিনি।

অ্যাটর্নি জেনারেল যা বলছেন : বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন মনে করেন, বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন।

তবে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ এবং বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত যুক্তির বিপরীতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, বিচার বিভাগের নিয়োগ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন করে।

“কমিশনের প্রধান হন আপীল বিভাগের একজন বিচারপতি। এখানে হাইকোর্ট বিভাগের দুইজন বিচারপতি থাকেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে আমি থাকি এবং অন্যান্য সরকারি আমলারা থাকেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় মাননীয় প্রধান বিচারপতি থাকেন, সেখানে আমিও থাকি না। এ প্রক্রিয়ায় প্রশাসনিক বিভাগের হস্তক্ষেপের প্রশ্নই আসে না,” বলেন তিনি।

এছাড়া হাইকোর্ট ডিভিশন বা অ্যাপিলেট ডিভিশনে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টিও সংবিধানের বিধান মেনে করা হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন বিবিসিকে।

“এটার সাথে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কোন প্রশ্ন নাই, কারণ মাজদার হোসেন মামলা হয়েছে নিম্ন আদালত নিয়ে। উচ্চ আদালতের ক্ষেত্রে কিন্তু যেটা সংবিধান নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেভাবেই করা হচ্ছে,” বলেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন।

উৎসঃ বিবিসি বাংলা

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More