বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব পণ্যের উচ্চমূল্য এবং আমদানির তুলনায় কম রপ্তানির কারণে বড় অংকের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছর প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৫৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় (ডলারের গড় মূল্য ১০৪ টাকা দরে) যার পরিমাণ প্রায় ৭৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
একই সময় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৬১ কোটি ডলার।
বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত বৈদেশিক লেনদেনে চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ হিসাব থেকে এ ঘাটতির ব্যাপারে জানা গেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ। এর মধ্যে করোনা পরবর্তী উচ্চ চাহিদা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয়ে উল্লম্ফন দেখা দেয়। তবে আমদানির বিপরীতে রপ্তানি আয় একই হারে বাড়েনি, যা বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়িয়ে তুলছে।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে প্রবাসী আয় কিছুটা বাড়তে দেখা গেলেও এরপর থেকে কমতে শুরু করেছে। ফলে চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও ঘাটতি বাড়ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বেড়েছে, সে সাথে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। সরকার আমদানি কিছুটা কমিয়ে এটা সমাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু হুন্ডি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে দাম কম দেখিয়ে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাওয়ায় তা সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন প্রতিবেদনে অর্থপাচারের তথ্য উঠে আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কথা বললেও আমরা তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে পাইনি। যে কারণে অবৈধ অর্থ উপার্জনকারীরা টাকা পাচারে উৎসাহিত হচ্ছে। এছাড়া খোলাবাজারে ডলার সংকটের পেছনেও অবৈধ অর্থ উপর্জনকারীদের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে মনে করছেন এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১ হাজার ৯৩৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য আমাদানি হয়েছে। তার বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য। এতে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৫৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
এছাড়া সদ্য সমাপ্ত অক্টোবর মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমে ১৫২ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। যেখানে অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি করে রেমিট্যান্স এসেছিল। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে রেমিট্যান্স আসে ৫৬৭ কোটি ৩৬ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েছে। সেপ্টেম্বর মাস শেষে সেবা খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ২২৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। অন্যদিকে এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৩৩৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। অথাৎ খাতটিতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্যে ঘাটতি ছিল ৬০ কোটি ডলার।
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস শেষে চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬১ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে একই সময়ে এ ঘাটতি ছিল ২৫৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের ৩ মাসে ঘাটতি বেড়েছে ১০৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
সামগ্রিক লেনদেনেও (ওভার অল ব্যালান্স) ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। সেপ্টেম্বর শেষে সামগ্রিক লেনদেনের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৪৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এই সূচকে গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ৮১ কোটি ডলারের ছিল।
অবশ্য এই সময়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ১১৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯০ কোটি ৭০ লাখ ডলার। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ২৫ কোটি ২০ লাখ ডলার বা ২১ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
গত দুই মাস ধরে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি খাতে ধারাবাহিক সংকট তৈরি হয়েছে। এতে রিজার্ভে চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ কমে দাড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ উঠেছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে।