ঢাকা: চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো তদন্তের জন্য গঠিত পুলিশের বিশেষ ইউনিট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কার্যক্রম আটকে আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। গত বছরের নভেম্বর মাসেই পিবিআই পুরোদমে মামলার তদন্তকাজ শুরু করার কথা ছিল। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে থানা পুলিশ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে বিরোধিতা এবং সংশোধনী মতামত দেয়ার কারণে এর বিধিমালা চূড়ান্ত হয়নি। তাই চূড়ান্তভাবে মাঠেও নামতে পারছে না পিবিআই।
যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের (ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) আদলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে তৈরি এ বিশেষ ইউনিট কার্যক্রম শুরু করলে থানা পুলিশ মামলার তদন্তভার হারাবে। এ কারণেই শুরু হয়েছে অভ্যন্তরীণ বিপত্তি। তবে সম্প্রতি মাঠ পর্যায়ের পুলিশের নানা অপকর্মের অভিযোগ এবং তদন্তের দুর্বলতার প্রসঙ্গ ধরে সামনে চলে এসেছে পিবিআই।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছেন, কিছু সুপারিশ বিবেচনা করে শিগগিরই মাঠে নামানো হবে পিবিআইকে। প্রথমদিকে জেলা পর্যায়ে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ইউনিট যাত্রা শুরু করবে। পর্যায়ক্রমে মেট্রোপলিটন এলাকায় কাজ করবে। মূলত থানায় মামলাজট কমাতে ও তদন্ত সুষ্ঠু করার জন্যই এই ইউনিটের গঠন। তবে এখন মামলার তদন্তের পুরো দায়িত্বই পিবিআইয়ের ওপর ন্যস্ত করার চিন্তাভাবনাও করা হচ্ছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, ‘পিবিআইয়ের বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই। মামলা তদন্তে নীতিমালা রয়েছে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী শিগগিরই কার্যক্রম শুরু করা হবে।’
তবে পিবিআইয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বাংলামেইলকে বলেন, ‘বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়ার কারণে অনেকটা অলস সময় কাটাচ্ছি আমরা। থানা পুলিশকে সহায়তা করার জন্য এটি গঠিত হয়েছে। তবে এখানে কিছু বিষয় ভুল বোঝাবুঝি আছে। আশা করি এসব কেটে যাবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তারা বলেন, ‘সারাদেশের বিভিন্ন থানা পুলিশ, ডিবি এবং সিআইডিতে মামলার জট লেগে আছে। এ পরিস্থিতির উত্তরণই পিবিআইয়ের লক্ষ্য। তদন্তের জন্য পাওয়া মামলার দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা এবং বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত নিশ্চিত করবে পিবিআই। ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা লাভের জন্য তারা এরই মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের বিভিন্ন থানায় জেলা পুলিশের পাশাপাশি পিবিআই মামলা তদন্ত শুরু করেছে। এই ইউনিট মূলত খুন, ডাকাতি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়, চোরাচালান ও কালোবাজারি, মানবপাচার, সাইবার ক্রাইম, ধর্ষণ, অস্ত্র এবং বিস্ফোরক দ্রব্য সংক্রান্ত মামলাগুলো তদন্ত করবে।’
সূত্র জানায়, পিবিআইয়ের প্রস্তাবিত বিধিমালা প্রাথমিকভাবে সরকারের অনুমোদন হয়েছে। অপেক্ষায় রয়েছে চূড়ান্ত অনুমোদনের। তদন্তের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা, থানা পুলিশের ভূমিকা ও পিবিআইর ক্ষমতার কিছু বিষয় নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ সমস্যা দ্রুত সমাধান হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে মামলার তদন্তের কাজ বাদ দিলেও থানার দৈনন্দিন অনেক কাজ থাকে এবং সাধারণ মামলা ও জিডির তদন্ত থানা পুলিশই করবে। এসব বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা এখন শেষ পর্যায়। বর্তমানে আবদুল গণি রোডে রেল ভবনের পাশে ডিএমপি কন্ট্রোল রুমের দোতলায় সদর দপ্তরে পিবিআইয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয় করা হয়েছে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ১৪ নম্বর রোডের ৩৫ নম্বর বাড়িতে। সদর দপ্তরের জন্য ভবন খোঁজা হচ্ছে। পিবিআইয়ের জন্য এ পর্যন্ত জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৮৫৩ জন।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর সরকারের এক আদেশে পিবিআই গঠন হয়। ডিসেম্বরের ২২ তারিখে নতুন ইউনিট পিবিআইতে পদায়ন শুরু হলে কিছু পুলিশ সদস্য নির্দেশিত হয়ে কাজ শুরু করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশে পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোয় গঠিত এই পৃথক তদন্ত ইউনিট পরিচালনার জন্য জনবল মঞ্জুরি করা হয় ৯৭০ জনের। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদও সৃষ্টি করা হয়েছে।
পদবিন্যাস অনুযায়ী একজন উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ইউনিটটির নেতৃত্ব দেবেন। এরপর আছেন দু’জন অ্যাডিশনাল ডিআইজি। যারা পিবিআইয়ের পূর্ব এবং পশ্চিম জোনের নেতৃত্বে তদন্তের কাজ তদারকি করবেন। এরপর আছেন- নয় জন পুলিশ সুপার (এসপি), ৭০ জন অ্যাডিশনাল এসপি, চারজন এএসপি, ২১০ জন ইন্সপেক্টর, ২৮০ জন এসআই, ১২১ জন এএসআই এবং ২৪২ জন কনস্টেবল।
সূত্র জানায়, একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তিনবছর সারাদেশে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত এবং বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ শেষে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা গেছে, সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে প্রায় ৭৫ শতাংশ মামলা খালাস হয়ে যায়। এ কারণে অনেক আসামি খালাস পেয়ে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে ২০১১ সালে ‘পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন’ নামে একটি পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠনের প্রস্তব করা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী এ প্রস্তাবে সম্মতি দিলে পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬১-এর সেকশন ১২-এর ক্ষমতাবলে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশক্রমে ২০১২ সালের অক্টোবরে পিবিআই গঠিত হয়।
সূত্র আরো জানায়, প্রতিবছর দেশে গড়ে এক লাখ ৬০ হাজার মামলা হয়। এসব মামলার মধ্যে চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার পাশাপাশি ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মামলাগুলোসহ ১৫ ধরনের মামলার তদন্ত পর্যায়ক্রমে শুরু করবে পিবিআই। পুরো জনবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের পর প্রতিবছর ৭০ হাজার মামলা তদন্ত করতে সক্ষম হবে এ বিশেষ ইউনিট।
বর্তমানে সিআইডি তফসিলভুক্ত অপরাধগুলোর তদন্ত আইজিপির লিখিত নির্দেশে পরিচালনাসহ মামলা তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বস্তুগত সাক্ষ্য যেমন হস্তরেখা, পদচিহ্ন, ব্যালেস্টিক, রক্তের দাগ রাসায়নিক পরীক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়ে থাকে। বর্তমানে থানা পুলিশেই মূলত মামলা তদন্ত করে থাকে। কিন্তু থানায় পর্যাপ্ত জনবল, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা চাহিদা অনুযায়ী না থাকায় এবং নানা ধরনের কাজে সবসময় ব্যস্ত থাকায় যথাযথ মনোযোগ ও একনিষ্ঠতায় তদন্ত কার্যক্রমের প্রত্যাশিত মান অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। একই সঙ্গে সিআইডির কাজ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তাও যথাসময় মিলছে না।