বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারদিন নূরের হত্যা ও তদন্ত নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁর বাবা কাজী নূর উদ্দিন। গত রোববার তাঁর সাক্ষাৎকার নেন নুরুল আমিন।
প্রথম আলো: নিখোঁজের তিন দিন পর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা থেকে ফারদিন নূরের (পরশ) মরদেহ উদ্ধার হলো। কিন্তু ঘটনার ২৪ দিন পরও ছেলেকে হত্যার প্রকৃত রহস্যের কিনারা হলো না। এ তদন্ত নিয়ে আপনি কতটা সন্তুষ্ট?
কাজী নূর উদ্দিন: মামলার বাদী হিসেবে তদন্ত সংস্থাগুলোকে যেসব বিষয়ে সাহায্য করা দরকার, তা করেছি। ফারদিন হত্যার ঘটনাটি জাতীয় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। একাধিক সংস্থা তদন্ত করছে। অথচ ভিসেরা প্রতিবেদন পাওয়া যাচ্ছে না। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেতে দেরি হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে এসব প্রতিবেদন কি দ্রুত দেওয়া যায় না? সব মিলিয়ে তদন্ত নিয়ে ততটা সন্তুষ্ট নই। তবে আস্থা রাখতে চাই। আমি এদেশের নাগরিক। যারা তদন্ত করছে, সেগুলোও এদেশের প্রতিষ্ঠান। আমি আস্থা হারিয়ে ফেললে, এসব সংস্থার প্রতি অসম্মান করা হবে।
প্রথম আলো: ঘটনার দিন ফারদিনের এভাবে ছুটে চলা আপনি কীভাবে দেখেন?
কাজী নূর উদ্দিন: তদন্ত সংস্থাগুলো ফারদিনের মুঠোফোন বিশ্লেষণ করে তাঁর সর্বশেষ অবস্থান নারায়ণগঞ্জের চনপাড়াকে প্রাধান্য দিয়েছে।
ছেলেটা যে এত রাতে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটেছে, এর কারণ কেউ খুঁজছেন না। সেসব এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়া গেছে, সেখানে কারা তাঁর সঙ্গে ছিল, তা এখনো খুঁজে বের করা হয়নি। কোনো কিছু বের না করেই কোনো কোনো সংস্থা ও গণমাধ্যম আমার মৃত ছেলের চরিত্র হনন করেছে। আমার এমন ছেলেটা মারা যাওয়ার পরও আমি জানি না কারা বিভ্রান্তি ছড়াল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও প্রমাণ ছাড়া এমন সব তথ্য দিল, সেটি খুবই বেদনাদায়ক। সেটি বড় বিস্ময়। সামাজিকভাবে আমার পরিবারকে হেয় করা হয়েছে। এসব ঘটনা আমার পুরো পরিবারকে খুব কষ্ট দিয়েছে।
ওই ফারদিনের গতিবিধি দেখে আমার মনে হয়েছে, তাঁকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করেছে। অথবা এমন কিছু তাঁর ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে, যে কারণে ফারদিন এভাবে ছুটে চলেছে। এটা তাঁর নিজস্ব ছুটে চলা নয়।
প্রথম আলো: ঘটনার দিন ফারদিনের গতিবিধির সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব ফুটেজ কি আপনাকে দেখানো হয়েছে?
কাজী নূর উদ্দিন: আমাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে একটি ফুটেজ দেখানো হয়েছে। সেটি যাত্রাবাড়ী এলাকার ছিল। সেটিকে আমি ফারদিন বলে ৯০ শতাংশ নিশ্চিত করেছি। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফুটেজ তারা আমাকে মুঠোফোনে দেখিয়েছে। ফুটেজটা যদি বড় কোনো স্ক্রিনে দেখানো হতো, তাহলে আরও স্পষ্ট বোঝা যেত।
ফুটেজে দেখা যাচ্ছিল ফারদিন হাঁটছে, তবে তার হাঁটা স্বাভাবিক ছিল না। লেগুনায় ওঠার আগে কালো পোশাক পরা একজনের সঙ্গে কথা বলেছে আমার ছেলে। পরে কালো পোশাক পরা ছেলেটি সাদা গেঞ্জি পরা ছেলেটিকে কী যেন নির্দেশনা দিল। এরপর সাদা গেঞ্জি পরা ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে ফারদিন লেগুনায় উঠল। সেখানে দুই ব্যক্তির সঙ্গে ফারদিনের কথা হলো। সাদা গেঞ্জি পরা ছেলেটি ও ফারদিনকে ফুটেজে শনাক্ত করা হলো। কিন্তু আরেকজন যে ছিলেন, তিনি কোথায় চলে গেলেন, তাঁকে খোঁজা হলো না।
প্রথম আলো: আপনার এসব সন্দেহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছেন?
কাজী নূর উদ্দিন: শুরুতে পুলিশ ও র্যাব আমাকে ডেকে কথা বলেছে। তারপর আমার সঙ্গে তদন্ত সংস্থাগুলো কমই যোগাযোগ করেছে। ফারদিনের ব্যবহৃত ল্যাপটপ নেওয়ার ক্ষেত্রে যোগাযোগ করেছে। এ ছাড়া ঘটনার দিনের গতিবিধি নিয়ে জানতে চেয়েছে এবং কোনো বিষয় নিয়ে ছেলের মধ্যে হতাশা ছিল কি না, জানতে চেয়েছে।
ফারদিনের প্রায় ছয় ফুট দেহটার মধ্যে শুধু বুকে আর মাথায় আঘাত করা হলো। আর কোথাও আঘাত করার জায়গা পেল না। তাহলে কি তার হৃদয় যা বলে এবং তার মস্তিষ্কে যা আছে, সেটা কি কেউ সইতে পারেনি? সেটিই কি হত্যার কারণ?
প্রথম আলো: সর্বশেষ ফারদিনের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল?
কাজী নূর উদ্দিন: ৪ নভেম্বর দুপুরে মায়ের সঙ্গে ভাত খেয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিল ফারদিন। বের হওয়ার সময় ওর মাকে বলেছিল, পরীক্ষা শেষ করে শনিবার দুপুরে বাসায় ফিরে একসঙ্গে খাবে। ঘটনার দিন রাত ১১টার দিকে ফারদিনের নম্বর থেকে ওর মায়ের নম্বরে কল এসেছিল। তখন ব্যস্ততার কারণে ফোন ধরতে পারেনি ওর মা। কিছুক্ষণ পরে ওর মা ফোন দিলে ফারদিন আর ফোন ধরেনি।
আমি বাসার বাইরে থাকায় আমার সঙ্গে ছেলের কথা হয়নি। তা ছাড়া ফারদিন ওর মাকে সবকিছু জানাত। সব সময় চাইত মায়ের মুখে হাসি দেখতে।
প্রথম আলো: ফারদিনের বেড়ে ওঠা, এরপর বুয়েট ভর্তি হওয়া। বাবার চোখে ছেলের এই বেড়ে ওঠা কেমন ছিল?
কাজী নূর উদ্দিন: একটা খুব মজার ব্যাপার ছিল যে আমি যখন বাইরে থেকে বাসায় ফিরতাম, আমার ছোট দুই ছেলে ব্যাগে খাবার খুঁজত, আর ফারদিন খুঁজত বই কিংবা পত্রিকা। আমার ব্যাগে বই বা পত্রিকা না পেলে ওর মন খুব খারাপ হতো। ছেলেটা পুরোপুরি একজন পাঠক ছিল। ফারদিন ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যেত। টিএসসিতে আবৃত্তি শিখত। নিজের ব্যস্ততার কারণে ছেলের খুব বেশি খোঁজ রাখতে পারিনি, তবে সে নিজেই নিজেকে তৈরি করেছে। যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে চলতে পারত।
উৎসঃ প্রথমআলো